বিশেষ প্রতিনিধি:
কেরানীগঞ্জের কোনাখোলা -খোলামোড়া সড়কে ছাদ ছাড়া বেবি ট্যাম্পু চালক থেকে গ্রিল মিস্ত্রি, রং মিস্ত্রি অতঃপর বাবার পেশা মাছ ধরে অফিসে অফিসে ঘুরে বিক্রিকালীন সময় পরিচয় হয় ছোট-বড় আবাসন ও ল্যান্ড ব্যবসায়ীদের সাথে। সেই থেকে পরিচয় জমি আর দলিলের সাথে, সে পরিচয় তাকে দিয়েছে দু’হাত ভরে!
যে জয়নাল একদিন কাজে না গেলে চলতো না সংসার সে জয়নাল আজ ঘুরে বেড়ান হুন্ডা কোম্পানির দামী সিআরভি প্রাইভেটকারে, হাতে দামী ঘড়ির সাথে তিন লাখ টাকার আধুনিক মোবাইল, ছেলে,মেয়ে আর স্ত্রীর হাতেও লাখ টাকার আই ফোন! আর নতুন চার তলা বাড়ির কাজ চলছে দ্রুত গতিতে আর এর সব টাই আসে অদৃশ্য খাত থেকে।
কোনাখোলা এলাকার বিশাল এলাকা জুড়ে তার রাজত্ব, সে রাজ্যে রাতের আঁধারে ভেকু ও নিষিদ্ধ মিনি ড্রেজার দিয়ে গভীর গর্ত করে মাটি কাটার মহোৎসব চলছে। এতে করে চোখের সামনেই হারিয়ে যাচ্ছে শতশত বিঘা কৃষি জমি, ফসলি মাঠ মুহূর্তেই পরিণত হচ্ছে জলাশয়ে।
কোন নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে মাটি কেটে জমির শ্রেণি পরিবর্তন করলেও দেখেও না দেখার ভান করছে সংশ্লিষ্টরা। স্থানীয় ভুক্তভোগীরা বলছে এভাবে মাটি কাটতে থাকলে অচিরেই হারিয়ে যাবে কৃষি জমি। পাশাপাশি গভীর গর্তে শুরু হবে মাটি ধস! আর এ মাটি কাটা ও বিক্রিকে কেন্দ্র করে তার রাজ্যে গড়ে উঠেছে বিশাল এক দস্যু বাহিনী, যারা মাটি বিক্রির কাঁচা টাকায় বেপরোয়া জীবনযাপন করে। দিনে জুয়া রাতে মাদক সেবনের সাথে চলে নানা অপকর্ম, যার কেন্দ্রবিন্দু কথিত রাষ্ট্রপতি ভবন!
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, কেরানীগঞ্জ উপজেলার অফিস পাড়া খ্যাত কোনাখোলা এলাকার বোয়ালী মৌজার বিশাল এলাকা জুড়ে মাটি কাটার উৎসবে মেতেছে স্থানীয় শ্রমিকলীগ নেতা জয়নাল ও তার বাহিনী। দিনের বেলায় সময় সুযোগ বুঝে মাটি কাটলেও রাত বাড়ার সাথে সাথেই ভেকু ও ডজন খানেক ড্রাম ট্রাক দিয়ে শুরু হয় মাটি চুরির ধুম!
অপহরণ, চাদাবাজি, মারামারি, দস্যুতা, হত্যার হুমকি, মাদক, জুয়াসহ চলমান দশ মামলার আসামি এই জয়নালের কুকীর্তির শেষ নেই। স্থানীয় জনসাধারণ থেকে শুরু করে জনপ্রতিনিধি এমনকি প্রশাসনও তার কাছে অসহায়! উপজেলার প্রাণ কেন্দ্র কোনাখোলা ও তার আশপাশের বিশাল এলাকা জুড়ে জমি দখল,কেনা-বেচা, মাদক, জুয়া এমনকি সিএনজি স্টেশনের লাইনও চলে জয়নালের ইশারায়।
গতবছরের একটি ঘটনা কেরানীগঞ্জ জুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে, রাতের আধারে মাটি চুরিতে বাধা দেওয়ায় পুলিশ সদস্যদের মেরে কয়েকদিন জেল খেটেই ছাড়া পেয়ে যায় এই দস্যু নেতা। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে ফের শুরু করে মাটি কাটা, চাঁদাবাজি, অপহরণ, দস্যুতাসহ নানা অপকর্ম। অভিযোগ রয়েছে নিয়মিত মদ ও জুয়ার আসর বসে তার রাষ্ট্রপতি ভবন ছাড়াও বিভিন্ন আস্তানায়। উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশ ফাঁড়ির চৌহতিতে থেকেও একের পর এক অপরাধ সংগঠিত করে পার পেয়ে যাওয়ায় ভয়ে মুখ খুলেনা ভুক্তভোগীসহ স্থানীয়রা।
আর এসব কাজে তার প্রধান সহযোগী হিসেবে কাজ করছেন মেহেদী,শাহীন, সাগর,হরি, রবিন, ছাত্রদল নেতা সেলিম, মিলন,নুরু, আল আমিন সহ তার বিশাল বাহিনী।
এব্যাপারে এস এম কামাল নামে এক ব্যবসায়ীর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বক্তব্য দিয়ে লাভ নেই, জয়নালের কিছুই হবে না বরং ঝামেলা বাড়বে। তার অপরাধের প্রতিবাদ করতে গিয়ে নির্যাতিত হওয়ার পাশাপাশি আজ আমি এলাকা ছাড়া। জয়নালের কারণে এলাকায় মানুষ ব্যবসা বানিজ্য করতে পারে না। অনেক বড় বড় আমলা-কামলারাও তার কাছে শিশু। এলাকাবাসী তার থেকে মুক্তি চায়।
শুধু পুলিশ আর কামাল নয় তার হাতে লাঞ্চিত অপমানিত আর নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বহু প্রতিষ্ঠিত মানুষ!
বাস্তা ইউনিয়ন সেচ্ছাসেবকলীগের সাধারণ সম্পাদক মাসুদ রানা মুন্না হিন্দু সম্প্রদায়ের জায়গা দখলে বাধা দেওয়ায়সহ তুচ্ছ কারণে বেধড়ক মারধরের শিকার হন বছর তিনেক আগে।
বাস্তা গ্রামের রুপচান সরকার (রুপে)কে কোনাখোলার একটি চায়ের দোকান থেকে তুলে নিয়ে তার কথিত রাস্ট্রপতি ভবনে নিয়ে মারধর শেষে খালি স্ট্যাম্পে সাইন রেখে ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগও তার বিরুদ্ধে।
তাছাড়া শাক্তা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতির সিরাজুল ইসলাম ছেলে রানাকে মেরে হাত-পা ভেঙে দেয় এবং মাথায় একাধিক জখম করে। কেরানীগঞ্জের প্রভাবশালী এক ইউপি চেয়ারম্যান এর ভাইও রেহায় পায়নি তার নির্মমতা থেকে।
তার নিশানা হয়েছে দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মাদ্রাসাও।
মাদ্রাসার দেয়াল ভেঙে ব্যক্তি মালিকানাধীন আবাসনের রাস্তা করে দিয়েও হয়েছেন পত্রিকার শিরোনাম
সাম্প্রতি সেনাবাহিনীর কর্মকর্তার পরিবারের এক সদস্যকে মারধর করে রয়েছেন এলাকা ছাড়া। তবে এলাকা ছাড়া হলেও তার অপরাধ কর্মকাণ্ড তেমে নেই, নিউজ লেখাকালীন সময় খবর আসে (২০ মে সোমবার) দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের দড়িগাও গ্রামের ভেকু ব্যবসায়ী মহসিন ফোন করে জানান, বেলা ৩ টার দিকে তেঘরিয়া এলাকায় ভেকু ভাড়া না দেওয়ায় জয়নাল ও তার সহযোগীরা তাকে বেধড়ক মারধর করেছে, ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেন দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মামুন অর রশিদ।
জয়নাল তার অপকর্ম পর্যপেক্ষণ করতে শেখ রাসেল স্মৃতি সংসদ নামে একটি অবৈধ সংগঠনে সিসি ক্যামেরা বসিয়ে ঘরে বসেই সব দেখবাল করেন জয়নাল।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তার এক বিশ্বস্ত সহযোগী জানান, জাল দলিল করে অসংখ্য মানুষের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন ভূমিদস্যু জয়নাল। তার ইশারায় চলে এলাকার সব কিছু। তাকে চাঁদা না দিলে এলাকায় কোন কাজ হয় না, তার কাছে থেকে ইট,বালি, সিমেন্ট না নিলে হয়না বিল্ডিং এমনকি রাস্তা ব্যবহার করতেও তাকে দেওয়া লাগে টাকা। মোট কথা সব কিছুর পেছনে রয়েছে জয়নাল।
তবে জয়নাল বলছেন এসব তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, আমি সাধারণ মানুষ কাজ করে ভাত খাই। এসব মিথ্যা বানোয়াট কাহিনি।
এব্যাপারে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (কেরানীগঞ্জ সার্কেল) শাহাবুদ্দিন কবির জানান, জয়নাল একজন চিহ্নিত সন্ত্রাসী, মাদক কারবারি এবং ভূমিদস্যু। তার বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে প্রায় ১২/১৫ টি মামলা হয়েছে, যার প্রতিটিতেই চার্জশিট দিয়েছে পুলিশ। সে নতুন একটি মামলায় পলাতক রয়েছে এবং তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে বলেও জানান এ কর্মকর্তা।