নিতিশ চন্দ্র বর্মন পঞ্চগড় প্রতিনিধিঃ
পঞ্চগড়ে নদী দখলমুক্তকরণের দাবিতে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত
তালমাসহ পঞ্চগড়ের সকল নদী দখলমুক্তকরণ ও নদী দখলকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিতে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে পঞ্চগড়-ঢাকা মহাসড়কের পাশে ঘন্টাব্যাপী এ মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) পঞ্চগড় জেলা শাখা, গ্রীণ ভয়েস, কারিগর ও দারিদ্র কল্যাণ সংস্থা এ কর্মসূচির আয়োজন করে।
বাপার জেলা শাখার আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট এ কে এম আনোয়ারুল ইসলামস খায়ের, জেলা উদীচীর সভাপতি শফিকুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক গোলাম কিবিরিয়া মুকুল, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক শহীদুল ইসলাম শহীদ, ভূমিজের মোস্তাফিজুর রহমান, জঙ্গিবাদবিরোধী মঞ্চের আহ্বায়ক আজহারুল ইসলাম জুয়েল, দারিদ্র কল্যাণ সংস্থার নির্বাহী পরিচালক মো. শাহজালাল, কারিগরের নির্বাহী পরিচালক সরকার হায়দার বক্তব্য রাখেন।
এদিকে, পঞ্চগড় জেলা শহর থেকে মাত্র ৩ কিলোমিটার দূরে তালমা এলাকায় অবস্থিত তালমা নদী। তালমা নদীর জমি দখল করে আগেই স্থাপনা তুলেছে সৌদি বাংলা এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ইকো ফ্রেন্ড লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান। নদী দখলদারদের উচ্ছেদে নদী কমিশনের প্রণিত তালিকায় এই প্রতিষ্ঠানের নাম থাকলেও দীর্ঘদিনেও তা উচ্ছেদে কোন ব্যবস্থা নেয়নি প্রশাসন। তাই নতুন তারা আবারও বাড়াচ্ছে দখলের পরিধি।
নদীর প্রবাহমান অংশে বাঁধ দিয়ে নদীর গতিরোধ করে দিন দুপুরে তারা প্রশাসনের নাকের ডগায় ভরাট করে যাচ্ছে নদীর বুক। ফেলা হচ্ছে শত শত জিও ব্যাগ। আর মাঠে থেকে জমি দখলের পাহাড়া দিচ্ছেন স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী।
পরে বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর সোমবার সকালে পঞ্চগড় সহকারী কমিশনার (ভূমি) আমিনুল ইসলাম ও সদর উপজেলার চেয়ারম্যান আমিরুল ইসলাম নদীর ওই স্থান পরিদর্শন করে কাজ বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন। একইসঙ্গে তারা জেলা প্রশাসক বরাবর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন।
এর পাশেই নদীর প্রায় সাড়ে ৮ একর জমি দখল করে হিমালয় বিনোদন পার্ক তৈরি করেছেন শাহীন নামে এক ব্যবসায়ী। দুটি স্থাপনাই বাংলাদেশ নদী কমিশনের প্রকাশিত নদী দখলদারদের উচ্ছেদের তালিকার মধ্যে থাকলেও সেখানে উচ্ছেদের কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি আজও। ওই নদীর কিছু অংশ দখল করে সীমানা প্রাচীর তুলেছেন জেলা কৃষক লীগ নেতা আপেল মাহমুদও।
বোদা উপজেলায় করতোয়া ও পাম নদীর ৩ একরেরও বেশি জমি দখল করে ইউক্যালিপটাসসহ বিভিন্ন গাছেন বাগান গড়ে তুলেছেন নাবিলা অরচার্ড এন্ড লিমিটেডের দাউদ খালিদ সারোয়ার। অথচ এসব প্রভাবশালী দখলদারদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থাই নিতে দেখা যায়নি।
এছাড়া, নদী রক্ষা কমিশনের তালিকায় কাজী এন্ড কাজী টি এস্টেট লিমিটেড, জেমকন টি এস্টেট লিমিটেড, পঞ্চগড় টি কোম্পানি লিমিটেড, কাঞ্চনজঙ্ঘা টি কোম্পানি লিমিটেডসহ বড় বড় প্রতিষ্ঠান ও প্রভাবশালীদের নাম রয়েছে। পঞ্চগড়ের করতোয়া, ডাহুক, পাম, ছেতনাই, তালমা, গবরা এই ৬টি নদীর ১৩৩ জন দখলদার প্রায় ৪০ একর জমি দখল করে রেখেছে বলে নদী রক্ষা কমিশনের তালিকায় প্রকাশ করা হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের যোগসাজসে শক্ত শেকড় গেড়েছেন এসব দখলদাররা। তারা প্রভাবশালী দখলদারদেরও উচ্ছেদের দাবি জানিয়েছেন।
গত বছরের ডিসেম্বরে জেলা শহরের তুলারডাঙ্গা এলাকায় করতোয়া নদীর তীর থেকে ৯৬টি দরিদ্র পরিবারের ঘর বাড়ি উচ্ছেদ করেই উচ্ছেদ অভিযানের ইতিটানে প্রশাসন। অন্যদিকে বহাল তবিয়তে প্রভাবশালী নদী দখলদারেরা তাদের শেকড় আরও পাকাপোক্ত করতে থাকে। প্রশাসনও এ ব্যাপারে তেমন কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি অদ্যাবধি।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিটি দখলদারদের যে তালিকা প্রকাশ করেছে তা অসম্পূর্ণ বলে মনে করেন স্থানীয়রা। জেলার প্রত্যেক নদীতেই দখল ও অবৈধ স্থাপনা রয়েছে বলে দাবি তাদের।
বামন পাড়া এলাকার কৃষক খতিবুল ইসলাম বলেন, অনেক দিন থেকেই প্রশাসনের নাকের ডগায় তালমা দখল হয়ে যাচ্ছে। এই সেচ ব্যবস্থার মাধ্যমে বিভিন্ন ফসলে পানি দেয়া হয়। নদীটি মরে গেলে এই এলাকায় কোন প্রকার কৃষি হবেনা। স্থানীয় কৃষকরা আরো জানান, নদী ভরাট করার ফলে পানিশুন্য হয়ে পড়েছে তালমা। ফলে আগামী দিনে চাষাবাদ করা কষ্টসাধ্য হয়ে যাবে। কৃষকেরা আর্থিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে। আমরা এর আশু সুরাহা চাই।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন পঞ্চগড়ের সভাপতি এ কে এম আনোয়ারুল খায়ের বলেন, তালমা নদীতে বাঁধ দিয়ে ভরাট করে দখল করছে সৌদি বাংলা এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ইকো ফ্রেন্ড লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান। তারা দিন দুপুরেই লুকোচুরি করে নদীর প্রবাহমান অংশে বালু ও মাটি ফেলে ভরাট করছে। সারাদেশে যখন নদী দখলদারদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে, নদী দখল মুক্ত করা হচ্ছে সেই মুহুর্তে পঞ্চগড়ে নতুন করে নদী দখল হচ্ছে। এরা পঞ্চগড়ের স্থানীয় কেউ না, এরা বাইরে থেকে এসে কলকারখানা করার নাম করে এভাবে নদী দখল করে যাচ্ছে। তারা আর যাই করুন না কেন তা নদী দখল করতে পারে না। সরকার যেখানে নদীর স্বাভাবিক গতিধারা রক্ষা করার জন্য নদী খনন করছে সেখানে দিন দুপুরে নদী দখল আমাদের বিস্মিত করেছে। আমরা অবিলম্বে এসব দখল উচ্ছেদের দাবি জানাচ্ছি। আর তা না হলে আমরা পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো প্রয়োজনে আন্দোলনে নামবো।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন পঞ্চগড়ের সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী বলেন, এমনিতেই নদীগুলো অস্তিত্ব সংকটে। এই সুযোগে কিছু প্রতিষ্ঠান স্থানীয় প্রভাবশালীদের ব্যবহার করে নদীর বুক ভরার করে দখল করছে। এটা আমরা কোনভাবেই মেনে নিতে পারি না। আমরা বিষয়টি প্রশাসনকে শক্তভাবে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানাচ্ছি।
এ বিষয়ে জানতে সৌদি বাংলা এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ইকো ফ্রেন্ড লিমিটেডের কাউকেই পাওয়া যায়নি।
তবে বালু সরবরাহের দায়িত্বে থাকা বালু ব্যবসায়ী আব্দুর রহিম বিন্দু বলেন, আমি বালুর ব্যবসা করি। বালু কিনে নিয়ে কে কোথায় ফেলবে এটা তাদের ব্যাপার।
পঞ্চগড় পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী ফইজুর রহমান বলেন, আমরা নদী নিয়ে কাজ করি কিন্তু নদীর মালিকানা ভূমি মন্ত্রণালয়ের। তাই আমরা প্রশাসনের সহযোগিতা ছাড়া কিছুই করতে পারবো না।
পঞ্চগড় জেলা প্রশাসক ড. সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, স্থানীয় এক ব্যক্তি আমাকে মোবাইলে বিষয়টি জানান। আমি সঙ্গে সঙ্গে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও সহকারী কমিশনার ভূমিকে বিষয়টি সরেজমিনে গিয়ে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছে। নদীর দখলে জড়িতদের কোন মতেই ছাড় দেয়া হবে না।