তানজিনা খাতুন মীর নিজস্ব প্রতিবেদকঃ
দেশের তিনটি বিশ্ব ঐতিহ্যের মধ্যে দুটির অবস্থান বাগেরহাট জেলায়। একটি প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা সুন্দরবন অপরটি মধ্যযুগের মুসলিম স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন ঐতিহাসিক ষাটগম্বুজ মসজিদ। অপার সম্ভাবনাময় পর্যটন এলাকা এই বাগেরহাট।
তবে দীর্ঘদিনেও দর্শনার্থীবান্ধব প্রয়োজনীয় কোনো সুযোগ-সুবিধা গড়ে ওঠেনি এখানে। নানা সংকট থাকা সত্ত্বেও দুই বিশ্ব ঐতিহ্যেকে ঘিরে আগ্রহের কমতি নেই দেশি-বিদেশি দর্শনার্থীদের।
স্থানীয়দের দাবি, জেলাকে পর্যটনবান্ধব জেলা হিসেবে গড়ে তুলতে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের পাশাপাশি আধুনিক মানের হোটেল-মোটেল গড়ে তোলা।
এদিকে সুন্দরবন ও ষাটগম্বুজ মসজিদকে পর্যটনবান্ধব হিসেবে গড়ে তুলতে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আজিজুর রহমান।
ষাটগম্বুজ এলাকার বাসিন্দা খুলনার একটি ট্যুর অপারেটরের ট্যুরিস্ট গাইড হাবিবুর রহমান বলেন, বাগেরহাট পর্যটনে সম্ভাবনাময় একটি জেলা। এখানে একদিকে সুন্দরবনের অপার সৌন্দর্য, অপরদিকে প্রায় সাড়ে ছয়শ’ বছর আগে নির্মিত ঐতিহাসিক ষাটগম্বুজ মসজিদ মুসলিম স্থাপত্যের এক অনন্য নিদর্শন। সুন্দরবন দেখতে ও প্রাচীনতম ষাটগম্বুজ মসজিদের ইতিহাস জানতে সব বয়সী দেশি-বিদেশি পর্যটকদের সমাগম লেগেই থাকে। তবে এসব স্থাপনা দেখতে এসে বিড়ম্বনায় পড়তে হয় দর্শনার্থীদের। নেই কোনো মানসম্মত খাবার হোটেল ও থাকার ব্যবস্থা। এ ছাড়া নেই কোনো ট্যুরিস্ট গাইড। যাতায়াত ব্যবস্থাও নাজুক। যার ফলে এখানে দর্শনার্থীর সংখ্যা খুবই কম।
ষাটগম্বুজ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শেখ আক্তারুজ্জামান বাচ্চু বলেন, শুধু ষাটগম্বুজ নয়, বাগেরহাটে দেখার মতো অনেক স্থাপনা রয়েছে। এগুলোকে মানুষের কাছে পরিচিত করতে আমাদের আরও কাজ করা প্রয়োজন। তবে দীর্ঘদিনেও আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা ও আবাসন সুবিধা গড়ে না ওঠায় বাগেরহাটে দর্শনার্থীদের আগ্রহ খুবই কম।
সংকটের সঙ্গে ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে দাবি করে এই জন প্রতিনিধি বলেন, পদ্মা সেতু এবং বাগেরহাট বিমান বন্দর চালু হলে এই এলাকার ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হবে। সেই সঙ্গে অবকাঠামোরও উন্নয়ন হবে। তখন বাগেরহাটের পর্যটনশিল্পের ব্যাপক উন্নয়ন ঘটবে। সঙ্গে সঙ্গে এই এলাকায় ট্যুরিস্ট গাইডও তৈরি হবে।
স্থানীয় ট্যুরিস্ট গাইড মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, পর্যটন করপোরেশনের এই ভবন বাগেরহাটের পর্যটন শিল্পকে এগিয়ে নিতে আরও সহায়তা করবে৷ কিন্তু এর পাশাপাশি স্থানীয় জনসাধারণকেও পর্যটকদের প্রতি সহযোগিতামূলক আচরণে উদ্যোগী হতে হবে৷ বিগত দিনগুলোতে দেখা গেছে দূর-দূরান্ত থেকে আগত পর্যটকরা স্থানীয়দের কাছ থেকে আশানুরূপ ভালো আচরণ পাননা৷ এক্ষেত্রে পর্যটন এরিয়ার মানুষদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে৷
“ষাটগম্বুজ-সুন্দরবন ট্যুরিজম” নামের ট্যুর অপারেটরের পরিচালক মীর ফজলে সাঈদ ডাবলু বলেন, বাগেরহাটে অনেক পর্যটন স্পট থাকলেও সুযোগ-সুবিধা খুবই কম। এই এলাকাকে পর্যটনবান্ধব করতে আশপাশের সব শ্রেণির মানুষকে প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে যাতে তারা পর্যটকদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেন। এ ছাড়া ষাটগম্বুজ, মাজার, মোংলাসহ যেসব স্থানের রেস্টুরেন্টে পর্যটকরা খাবার খায় সেব রেস্টুরেন্টের কর্মচারীদেরকেও প্রশিক্ষণ দেওয়ার দাবি জানান তিনি।
এদিকে পযটকদের আবাসন সুবিধা নিশ্চিতের জন্য বাগেরহাট সদর উপজেলার খানজাহান আলী (রহ.) এর মাজার মোড়ে ১২ কোটি ৭৭ লাখ ৬ হাজার টাকা ব্যয়ে পযটন করপোরেশনের মোটেল নির্মাণাধীন থাকলেও সময়মত কাজ শেষ না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছেন স্থানীয়রা। ২০১৯ সালের জুনে শুরু হওয়া সাততলা এই ভবনের কাজ ২০২১ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও মাত্র ৬০ শতাংশ কাজ হয়েছে ভবনটির। এ ছাড়াও কয়েক মাস ধরে কাজ বন্ধ রয়েছে।
৩৩ শতকের বেশি জমির ওপরে নির্মিত ৭ তলাবিশিষ্ট এই ভবনে ৩০টি কক্ষ, ৫০ আসন বিশিষ্ট রেস্টুরেন্ট, অফিস রুম, অভ্যার্থ্যনা কক্ষ, বারবি কিউ রুম ও গাড়ি পার্কিংয়ের সুবিধা থাকবে।পুরো ভবনের আয়তন হবে ২ হাজার ৭৬০ বর্গ মিটার। এর সঙ্গে সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য বাগানও করা হবে। এসব কর্মযজ্ঞে ব্যয় ধরা হয়েছে ১২ কোটি ৭৭ লাখ ৬ হাজার টাকা। খাজা রাব্বি বিলকিস নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এই কাজ করছেন।
করোনাকালীন লকডাউন শেষে প্রতিদিন শত শত দর্শনার্থীরা আসছেন এই ঐতিহ্য উপভোগ করতে। ষাটগম্বুজ মসজিদ দেখতে গত দুই মাসে এসেছেন প্রায় ৯ হাজার দর্শনার্থী। এ ছাড়া সুন্দরবনে এসেছেন প্রায় ৬ হাজার দর্শনার্থী।
বাগেরহাট জাদুঘরের কাস্টোডিয়ান মো. যায়েদ জানান, পর্যটন মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ অনুযায়ী স্থানীয়ভাবে দর্শনার্থীদের জন্য থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা গেলে যেমন দর্শনার্থী সংখ্যা বাড়বে তেমন রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পাবে।
সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. বেলায়েত হোসেন বলেন, করোনাকালেও ২০২০-২১ অর্থবছরে সুন্দরবনে ৮৩ হাজার ৫৩৯ জন দেশি এবং ২৯৯ জন বিদেশি পর্যটক সুন্দরবন ভ্রমণ করেছে। এতে সরকারের রাজস্ব আয় হয়েছে ৬৭ লক্ষ ৭ হাজার ৪৭৬ টাকা। সুন্দরবনকে পর্যটনবান্ধব করে গড়ে তুলতে সুন্দরবনের আলীবান্ধা ও আন্ধারমানিক দুটি পর্যটনকেন্দ্র নির্মাণকাজ চলছে।
বাগেরহাট জেলা প্রশাসক মো. আজিজুর রহমান বলেন, বাগেরহাটকে পর্যটনবান্ধব হিসেবে গড়ে তুলতে সরকার নানা উদ্যোগ নিয়েছে। পর্যটন করপোরেশনের অর্থায়নে তিন তারকা মানের হোটেল ভবন নির্মাণের কাজ প্রায় ৮০ ভাগ শেষ হয়েছে। এ ছাড়া ষাটগম্বুজের সামনের বিশ্রামাগার নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। পাশাপাশি মসজিদ সংলগ্ন ঘোড়াদিঘিকে নান্দনিক করতে ওয়াক ওয়ে তৈরি করা হয়েছে।