সূর্যোদয় অনলাইন ডেস্ক,
বাদশাহ ও মন্ত্রীর শ্রীমান এবং বিপ্রতীপ বিজেপি
মাসের ঠিক জন্মলগ্নে দুই বিশিষ্ট এবং সর্বজনবিদিত ব্যক্তিত্বের পুত্রের কর্মকাণ্ড নিয়ে গোটা ভারত উত্তাল। একটি ঘটনা এক বর্ণাঢ্য সন্ধ্যেবেলার। দুরন্ত আরব সাগরের বক্ষতটে। ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন, দেশের সব অধিবাসীর আয়ত্তের বাইরে, আমোদ ও আভিজাত্যের স্রোতে বহতা, আয়েশের উচ্ছ্বাস আছড়ে পড়া এক প্রমোদতরীতে। কোলাহল ও কল্লোলিনী মুম্বাই থেকে গোয়াগামী সেই জলশকট থেকে, বলিউডের বাদশাহ শাহরুখ খানের পুত্র আরিয়ান এবং অন্যদের মাদকদ্রব্যসহ গ্রেপ্তার করলেন সমীর ওয়াংখেড়ে নামে ভারতের মাদকনাশক কেন্দ্রীয় সংস্থা নারকোটিকস কন্ট্রোল ব্যুরোর এক আধিকারিক। এ আধিকারিকের পত্নী এক মারাঠি অভিনেত্রী। গোটা অভিযানটি মজবুত টান টান উত্তেজনার এক সবল চিত্রনাট্যকেও হার মানায়। এনসিবির সিজারস লিস্টে ছিল ১৩ গ্রামের মতো কোকেইন, ২১ গ্রামের মতো চরস এবং অন্যান্য মাদকদ্রব্য।
আরিয়ান খান দ্রুত গ্রেপ্তার হন। তাকে চালান করা হলো কোর্টে। কোর্ট তাকে পাঠালেন শ্রীঘরে। কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন মাদক নিয়ন্ত্রণ সংস্থার এ বিষয়ে এত দ্রুত, উদ্যোগপূর্ণ এবং মসৃণ পদক্ষেপ অবশ্যই বাহবার আবেদন রেখে যায়।
তবে দ্বিতীয় ঘটনায় আটটি প্রাণ বলি হলেও সরকারের গাফিলতি ও শিথিলতা ভারতজুড়ে ক্ষোভ এবং দ্রোহের সঞ্চার করে। ঘটনাটি দিবালোকে এবং স্থলভাগে। পশ্চিম সমুদ্রকূল থেকে দূরে। উত্তর ভারতে। সমুদ্রপৃষ্ঠের কিঞ্চিৎ ওপরে, জনসমুদ্রের উপকেন্দ্র্রে, উত্তরপ্রদেশের লখিমপুর-খেরির শ্যামলা-সুফলা জমিতে। আন্দোলনরত কৃষকদের ওপর অতর্কিতে দ্রুতবেগে গাড়ি চালিয়ে চলে যায় কারা? অভিযোগ, বিজেপির কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অজয় মিশ্রের শ্রীমান আশীষ মিশ্র গাড়িটি চালনায় ছিলেন এবং ধূমকেতুর দ্রুতিতে আছড়ে পড়েন আন্দোলনরত কৃষকদের ওপর। ঘটনা রূপ নেয় হিংসায়। চারজন কৃষকসহ সর্বমোট আটজন মারা যান। আশীষ মিশ্রের স্বগতোক্তিতে, প্রথমে ঘটনাস্থলে তার উপস্থিতির কথা স্বীকার করলেও পরে তা অস্বীকার করেন।
এই হিংসালীলার পর উত্তরপ্রদেশ পুলিশ অনেককে গ্রেপ্তার করলেও আশীষ মিশ্র থেকে যান অধরা। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর তথা কেন্দ্র সরকারের বাৎসল্য-স্নেহ আশীষকে সাময়িকভাবে দিয়ে দেয় রাজনৈতিক অনাক্রম্যতা। পলিটিক্যাল ইমিউনিটি এবং তার অবস্থানে অবিচল। ঘটনা সুপ্রিম কোর্টে গেলে পুলিশকে ভর্ৎসনা করা হয় এবং অনেক পরে আশীষ মিশ্র গ্রেপ্তার হন। গত শনিবার উত্তরপ্রদেশ পুলিশের একটি বিশেষ তদন্তকারী দল আশীষ মিশ্রকে ৯ ঘণ্টা ধরে জেরা করে।
রোষানলে ফুঁসতে থাকা লখিমপুরে অনেক বিরোধী দলের নেতা-নেত্রী আছেন। তবে প্রধানমন্ত্রী মোদি এ বিষয়ে টুঁ শব্দটিও করেননি এখন পর্যন্ত। করেননি একটি টুইট। কৃষিপ্রধান এবং কৃষিমাতৃক দেশ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মৃত কৃষকদের প্রতি সমবেদনা জানাতে বা কোনো রকম দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়ার অঙ্গীকার এখন পর্যন্ত করেননি। তবে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ ঘটনার সমাধান করার অভিপ্রায়ে মৃতদের পরিবারকে ৪৫ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেন।
দেশজুড়ে এ ঘটনার নিন্দা মানুষের মনে গভীর এক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করলেও ভারতের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অজয় মিশ্র কোনোরকম অনুশোচনা বা অনুতাপ করেননি। বরং আন্দোলনকারীদের দেখিয়েছেন তার দোর্দণ্ড প্রতাপ ও রক্তচক্ষু। বিজেপির অবস্থানও মোটামুটি পরিস্কার। তারা তাদের মন্ত্রী অজয় মিশ্রকে কোনোভাবেই বহিস্কার করছে না। অন্যদিকে বিজেপির সাংসদ বরুণ গান্ধী এ ঘটনার নিন্দা ও সমালোচনা করলে তার মা মানেকা গান্ধীকে দ্রুত সরিয়ে দেওয়া হয় বিজেপির জাতীয় কার্যকরী কমিটি থেকে।
প্রথম ঘটনাটিতে, শাহরুখ খানের পুত্রকে গ্রেপ্তারে সরকারের এত দ্রুত পদক্ষেপ এবং কঠোর অবস্থান সত্ত্বেও উঠে আসছে বেশ কিছু প্রশ্ন। ঠিক একই দোষ যদি শাহরুখ খানের ছেলে না করে বিজেপির কোনো মন্ত্রীর ছেলে করতেন, তার প্রতিও কি সরকার এ অবস্থানে অবিচল থাকত?
মাঝ দরিয়ায় জন্মানো এক বিতর্ক উপকূল বেয়ে উঠে এলো দেশের হূৎপিণ্ডে। ছড়িয়ে পড়ল দিল্লি থেকে চেন্নাই- ঢাকাতে, প্যারিসে। দুনিয়ার নানা প্রান্তে বলিউড বাদশাহ শাহরুখ খানের সুবিস্তৃত সাম্রাজ্যে ছিটিয়ে দিল সমুদ্রের নোনাপানি-মিশ্রিত কাদামাটি।
লখিমপুরের ঘটনাও বাড়িয়ে নিয়েছে তার ব্যাপ্তি। তার জ্যা; সর্বোপরি রাজনৈতিক গুরুত্ব ও গভীরতা। উত্তরপ্রদেশের প্রায় নাম-না শোনা জনপদ লখিমপুর এখন রাজনীতির চর্চার কেন্দ্র্রবিন্দু। রাজনৈতিকভাবে এ মাটি এখন উর্বর। লখিমপুরে যা হলো, এখনও ঘটমান, তার ব্যাপ্তি ছড়িয়ে পড়বে উত্তরাখণ্ড ও পাঞ্জাবে। ভোটের আগে দমকা হাওয়া ছড়িয়ে দেবে লখিমপুরের আবহ, উষ্ণতা, উত্তাপ। রুটি-রুজির সংগ্রামে দিন আনতে পান্তা ফুরোনো মানুষের এই রোষ জমা না হলে, তারা রাস্তায় না নামলে, রাজনৈতিক অনাক্রম্যতার আবরণে আজীবন থেকে যায় অভিযুক্ত ঘাতক আশীষ মিশ্ররা। মন্ত্রীদের অপত্য স্নেহে। রাজার আশিসে।
আইনের চোখে সবাই সমান; প্রত্যেকে। প্রশাসনের চোখে ছানি পড়লে স্বচ্ছ দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে আনেন এভাবেই। মানুষ মাঠে নেমেছে। প্রজাতন্ত্রে রাজার আশীষের চেয়ে, প্রজার রোষ পরাক্রমশালী।