মোঃ শাহিনুর রহমান শাহিন, সাতক্ষীরা
নগরঘাটা ঈদগাহ বৃহত্তর খুলনা জেলার সাতক্ষীরা জেলা তালা উপজেলার পাটকেলঘাটা থানার পাঁচপাড়া ও নগরঘাটা গ্রামের সীমানায় নির্জন মাঠে অবস্থিত। অবস্থানগত ভাবে এটি সাতক্ষীরা-খুলনা সড়কের ত্রিশ মাইল মোড় থেকে সরসকাটিগামী রাস্তার সাড়ে ৩ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত।
খোঁজ খবর নিয়ে জানা যায়, এটা একটি ঈদগাহ। তবে ঈদগাহটি কত সনে কে নির্মাণ করেছিলেন তা সঠিকভাবে জানা যায়নি। এ ঈদগাহ সম্বন্ধে এলাকায় প্রচলিত প্রবল জনশ্রুতি হলো লস্কর উপাধিধারী একদল ইসলাম প্রচারক উত্তরাঞ্চল থেকে ইসলাম প্রচার করার মানসে এ এলাকায় আসেন। তারা ইসলাম প্রচারের সাথে সাথে এ এলাকায় মসজিদ, মাদ্রাসা, ঈদগাহ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করেন। যেমন সদর উপজেলার আলীপুরের মসজিদ, নগরঘাটা ঈদগাহ ও লস্কর দীঘি প্রভৃতি। এগুলোর নির্মাণ ও খননকাল প্রায় ৪০০ বছর আগে।
এ ঈদগাহটি সম্বন্ধে এলাকায় অন্য একটি জনশ্রুতিও প্রচলিত আছে যে, কোন এক রাতের শেষে অলৌকিকভাবে এ ঈদগাহ ও একটি বটগাছের অবস্থান এলাকাবাসী দেখতে পান, যা আগে ছিল না। ঈদগাহটিতে এক সময় প্রতি শুক্রবার পুণ্যার্থীরা একত্রিত হন। পুণ্যার্থীরা এখানে আসে মনোবাসনা পূর্ণ করার ইচ্ছাতে, রোগমুক্তি ও বিপদ-আপদ থেকে নিরাপদ থাকার মানসে। সে কারণে তারা এখানে এসে ছাগল, মুরগি, হাঁস ইত্যাদি জবাই করে রান্নাবান্না করে উপস্থিত লোকজনদের খাওয়ায়। যা বর্তমানে কিছুটা কমলেও মাঝে মধ্যে অনেকের উপস্থিতি চোখে পড়ে।
নগরঘাটা ঈদগাহটি সমতল ভূমি থেকে ৩ ফুট উঁচু করে নির্মিত। বর্তমানে এর চারপাশ ভরাট করা হয়েছে। ঈদগাহর পশ্চিম দেয়াল অর্থাৎ মেহরাবের দেয়ালটি প্রায় ৩০ ফুট উঁচু। সমতল ভূমি থেকে ঈদগাহ দেয়াল প্রথমে ৩ ফুট উঁচু চত্বর, এরপর ১৪ ফুট উঁচু একটি স্তর। যে স্তরে রয়েছে ৭টি বহুপত্র খিলানযুক্ত শৈল্পিক মেহরাব। এরপরের স্তর ৭ ফুট উঁচু যার মধ্যে সামনের দিকে ১৫টি ও পেছন দিকে ১৮টি মেহরাবের নকশা রয়েছে। মেহরাব ৭টির দুপাশের শুরুতে ইট কেটে নকশা করা হয়েছে। তবে মেহরাবের ওপরের নকশা নিচের নকশা থেকে অনেক নান্দনিক। ঈদগাহ দেয়ালটির চওড়া তিন ফুট আড়াই ইঞ্চি এবং কেন্দ্রীয় মেহরাবের গভীরতা তৈরির জন্য ঈদগা দেয়ালের পেছন দিকে ১ ফুট বাড়ানো হয়েছে। যা ঈদগাহ দেয়ালের চড়া পর্যন্ত বিস্তৃত। তার ওপরের স্তরে ৬ ফুট মতো উঁচু যা কেন্দ্রীয় মেহরাব বরাবর চূড়ায় গিয়ে শেষ হয়েছে। চূড়াতে গিয়ে গম্বুজাকৃতির নকশা রয়েছে।
নগরঘাটা গ্রামের আল মামুন বলেন, জন্মের পর থেখে এই ঈদগাহে ঈদের নামায পড়ছি। গুরুজনদের মুখে এই ঈদগাহ নিয়ে অনেক গল্প শুনেছি। তবে কবে কিভাবে নির্মিত সেটা বলতে পারবো না। এর সামনে একটি বিশাল আকৃতির বটবৃক্ষ ছিল । যেটার নিচে বসে পথচারী ও মাঠে কাজ করা চাষী ও দিনমজুরেরা শরীরের ক্লান্তি দূর করতো। জায়গা শংকটের কারণে গাছটি কেটে বিক্রয় করে সেই অর্থ ঈদগাহের কাজে খরচ করা হয়েছে।
মাওলানা সিরাজুল ইসলাম (বর্তমান ইমাম) জানান, আমার আগে এই ঈদগাহে মরহুম ডাঃ আব্দুর রউফ মুন্সি দীর্ঘদিন ঈদের জামাতে ইমামতি করেছেন। ঈদগাহটিতে ধানদিয়া ও নগরঘাটা ইউনিয়নের মুসল্লিরা ঈদ জামাত আদায় করেন।
নগরঘাটা ইউপি চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান লিপু বলেন, ঈদগাহটিতে আগে জায়গা সংক্লন ছিল বলে কমিটির সদস্যরা আমাকে অবহিত করলে সরকারি ভাবে আগেরটার আদলে নতুন ঈদগাহ নির্মানে যতটুকু সম্ভব চেষ্টা করেছি। আগামীতে এই চেষ্টা অব্যাহত থাকবে।
সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য পুরো দেয়ালের দু দিক থেকে পর্যায়ক্রমে চূড়ার দিকে উঁচু করে নির্মাণ করা হয়েছে। এ স্তরের শুরুতে দুটি বড় বড় দৃষ্টিনন্দন ফাঁকা জায়গা বা ছিদ্র রাখা হয়েছে। ঈদগাহ দেয়ালে নির্মিত কেন্দ্রীয় মেহরাবটি অর্ধবৃত্তাকারে তৈরি। কেন্দ্রীয় মেহরাবের উভয় পাশে যে ৩টি করে মেহরাব রয়েছে সেগুলি চওড়ায় ও উচ্চতায় কেন্দ্রীয় মেহরাবের মাপের হলেও গভীরতায় মাত্র ১ ফুট এবং এগুলি অর্ধবৃত্তাকার নয় বরং সমান করে তৈরি।
ঈদগাহ দেয়ালের ওপরে রয়েছে অনুচ্চ মোট ১১টি পিলার বা থাম, যার মাথায় কলস বসানো ছিল (বর্তমানে নেই) অর্থাৎ কলস চড়া মিনার ছিল। ঈদগাহ চত্বরে ওঠার জন্য ২টি সিঁড়ি ছিল, যার উপরিভাগ এখনও দেখা যায়। ২০১১ সালে পুরুষদের জায়গার সঙ্কুলান না হওয়ায় এর (ঈদগাহর) ঠিক পশ্চিম দিকে নতুন করে।
স্থানীয়রা অনেকটাই হুবহু আগের আদলে পুরাতন ঈদগাহ থেকে ৫০ ফুট মতো পশ্চিমে পাকা রাস্তা সংলগ্ন একটি ঈদগাহ দেয়াল নির্মাণ করেছেন। এ ঈদগাহ দেয়াল নির্মাণের সময় পুরো জায়গায় মাটি ফেলে আগের ঈদগাহ চত্বরের সমান্তরাল করতে গিয়ে পুরাতন সিঁড়ি ঢাকা পড়েছে, তবে সিঁড়ির ওপরের অংশ এখনো দৃষ্টিগোচর হয়। পূর্বের সিঁড়িটি চন্দ্রাকৃতির বাঁকানো ছিল। এটির দৈর্ঘ্য ৭ ফুট ৬ ইঞ্চি। তবে এটি কয় ধাপ বিশিষ্ট ছিল তা জানা যায়নি।
বর্তমানে নতুন করে একই ইমামের ইমামতিতে নতুন ঈদগাহে আহলে হাদীস মতাবলম্বী পুরুষেরা এবং পুরাতন ঈদগাহে নারী মুসল্লিরা ঈদের নামায আদায় করে থাকেন।