কামরুল হাসান মহানগর প্রতিনিধি,
অনলাইনে কিডনির ‘দোকান’ ২ লাখে কিনে ২০-এ বিক্রি
শাহরিয়ার ইমরান আহম্মেদ। বয়স ৩৬ বছর। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে দুটি পেজ খুলে হয়ে উঠেছিলেন বড় ‘ব্যবসায়ী’। কেনাবেচা করে কামিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। গ্রাম থেকে কম দামে কিডনি কিনে দশ গুণ বেশি দামে বিক্রি করে পকেটে পুরেছেন উচ্চ মুনাফা। দেশের পাশাপাশি বিদেশেও ‘রপ্তানি’ করেছেন তার এই ‘পণ্য’।
বেআইনি এ ব্যবসায় প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে বিদেশ পর্যন্ত চার ধাপে গড়ে তুলেছেন ১৫ থেকে ২০ জনের শক্তিশালী চক্র। এ চক্রের মাধ্যমে গত কয়েক বছরে শতাধিক ব্যক্তিকে প্রতিবেশী দেশে নিয়ে কিডনি বিক্রি করেছেন। এ ঘটনার মূল হোতা শাহরিয়ার ইমরানসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন-র্যাব।
র্যাব জানিয়েছে, গত সোমবার মধ্যরাত থেকে গতকাল মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত জয়পুরহাট ও রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। ‘বাংলাদেশ কিডনি ও লিভার পেশেন্ট চিকিৎসাসেবা’ এবং ‘কিডনি-লিভার চিকিৎসাসেবা’ নামে দুটি ফেসবুক পেজের মাধ্যমে তাদের কারবার চলত। দুটি পেজেরই অ্যাডমিন শাহরিয়ার ইমরান। গ্রেপ্তার হওয়া বাকি চারজন হলেন- মেহেদী হাসান (২৪), সাইফুল ইসলাম (২৮), আব্দুল মান্নান (৪৫) ও তাজুল ইসলাম ওরফে তাজু (৩৮)। তাদের কাছ থেকে কিডনিদাতাদের চারটি পাসপোর্ট, মেডিকেল চিকিৎসার জন্য পাসপোর্ট এবং ভিসা সম্পর্কিত কাগজপত্র, পাঁচটি মোবাইল ফোন এবং দেশি-বিদেশি মুদ্রা জব্দ করা হয়েছে।
গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন সংস্থাটির কর্মকর্তারা। সেখানে র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, মানবদেহের কিডনিসহ বিভিন্ন অঙ্গের অবৈধ প্রতিস্থাপনের সঙ্গে কয়েকটি চক্র সক্রিয় রয়েছে। এসব চক্রের ফাঁদে পড়ে অসহায় নিম্ন আয়ের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
তিনি জানান, সাম্প্রতিক সময়ে র্যাবের সাইবার মনিটরিং সেল ভার্চুয়াল স্পেসে কিডনিসহ অন্যান্য অঙ্গ ক্রয়-বিক্রয় চক্রের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে। এতে দেখা যায়, একটি চক্রের সদস্যরা অনলাইনে বিভিন্ন প্রচারণার মাধ্যমে গ্রাহক ও বিক্রেতাদের আকৃষ্ট করছে। একই সঙ্গে অপরাধের নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করেছে। এর পরই গোয়েন্দা নজরদারি বাড়িয়ে কিডনি বিক্রি চক্রের পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
চার ধাপে কিডনি সংগ্রহ ও বিক্রি :গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে র্যাব কর্মকর্তারা বলছেন, ১৫ থেকে ২০ জনের চক্রটি চারটি ধাপে কিডনিদাতাদের সংগ্রহ থেকে শুরু করে রোগীর দেহে প্রতিস্থাপন পর্যন্ত কাজ করত। প্রথম ধাপে দায়িত্ব পাওয়া সদস্যরা ঢাকায় অবস্থান করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিডনি প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন- এমন বিত্তশালী রোগীদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে। দ্বিতীয় ধাপের গ্রুপটি প্রথম গ্রুপের চাহিদা অনুযায়ী দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের গরিব ও অভাবী মানুষদের চিহ্নিত করে এবং তাদের অর্থনৈতিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে অর্থের বিনিময়ে কিডনি দেওয়ার জন্য দাতা হতে প্রলুব্ধ করে ঢাকায় নিয়ে আসে।
তৃতীয় ধাপের গ্রুপটি প্রলোভনের শিকার কিডনি বিক্রেতাদের ঢাকায় বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রক্তের ক্রসম্যাচিংসহ অন্যান্য পরীক্ষা সম্পন্ন করে। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় উপযুক্ততা নিশ্চিত হলে পাসপোর্ট, ভিসা প্রসেসিংসহ সব কাগজপত্র তৈরির মাধ্যমে বিক্রেতাকে প্রতিবেশী দেশে পাঠানোর জন্য প্রস্তুত করে। চতুর্থ ধাপে প্রতিবেশী দেশে অবস্থানকারী আরেকটি চক্র কাজ করে থাকে। যারা তৃতীয় স্তরে দায়িত্ব পালন করা সদস্যদের সঙ্গে সমন্বয় করে কিডনি বিক্রেতাকে বিদেশে বিমানবন্দর বা স্থলবন্দরে অভ্যর্থনা জানানো থেকে শুরু করে হাসপাতালে সহায়তা, অস্ত্রোপচারসহ প্রয়োজনীয় কাজ শেষ করে।
দুই লাখে কিনে ২০ লাখে বিক্রি :র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন বলেন, গ্রেপ্তার চক্রটি বিক্রেতাকে বিদেশ নিয়ে কিডনি পাচার করে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে। প্রতিটি কিডনির জন্য তারা রোগীর কাছ থেকে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা নিত। বিপরীতে তারা কিডনি ডোনারকে তিন থেকে চার লাখ টাকা দেওয়া হবে বলে আশ্বস্ত কর। অগ্রিম দুই লাখ টাকা দিত। কিন্তু কিডনি প্রতিস্থাপন শেষ হয়ে গেলে প্রতিশ্রুত অর্থ না দিয়ে ভয়ভীতি দেখাত।
র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, চক্রের মূল হোতা ইমরান প্রতিটি কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য পাঁচ থেকে ১০ লাখ টাকা নিতেন। তিনি স্বীকার করেছেন, গত কয়েক বছরে শতাধিক কিডনি বিদেশে বিক্রি করেছেন। আইনের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তারা ডোনারকে কোনো ধরনের রশিদ, পাসপোর্ট বা প্রমাণ হয়- এমন কোনো কাগজপত্র দিত না।
চক্রের কার কী কাজ :র্যাব কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মূল হোতা শাহরিয়ার ইমরান অনলাইনে বিত্তশালী কিডনি রোগীদের আকৃষ্ট করতেন। পাশাপাশি বিভিন্ন এলাকা থেকে স্থানীয় দালালদের মাধ্যমে কিডনি বিক্রেতা সংগ্রহ থেকে শুরু করে সব কাজের সমন্বয় করতেন। আগ্রহীদের খুঁজতে দুটি ফেসবুক পেজও চালাতেন তিনি।
মান্নান অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে নিম্নবিত্ত মানুষদের কিডনি বিক্রিতে উদ্বুদ্ধ করতেন। কিডনিদাতা সংগ্রহ করে প্রতিজনকে তিন থেকে পাঁচ লাখ টাকা নিতেন। এর আগেও এমন অভিযোগে তিনি গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। তার বিরুদ্ধে মানবদেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংযোজন আইনে ছয়টির বেশি মামলা রয়েছে। অপর আসামি তাজুল ইসলাম ওরফে তাজু মান্নানের সহযোগী হিসেবে কাজ করতেন। জয়পুরহাটের কালাই এলাকার এই তাজু নিজ এলাকা থেকে কিডনিদাতা সংগ্রহ করে প্রতিজনের জন্য তিন লাখ করে টাকা নিতেন। তার বিরুদ্ধেও একাধিক মামলা রয়েছে। আর সাইফুল ও মেহেদী কিডনি বিক্রেতাদের প্রতিবেশী দেশে নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় পাসপোর্ট, মেডিকেল ভিসা এবং অন্যান্য কাগজপত্র জালিয়াতির মাধ্যমে তৈরি করতেন। এ কাজে তারা জনপ্রতি ১০ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা করে নিতেন।
র্যাবের এক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, এই
প্রতিষ্ঠাতা : মেজর (অব) মোঃ মোদাচ্ছের হোসাইন, সম্পাদক মন্ডলির সভাপতি: বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুজ্জামান আহমেদ এমপি, ব্যবস্থাপনা সম্পাদক: তৌহিদ আহমেদে রেজা, বার্তা সম্পাদক: আসমা আহমেদ কর্তৃক ৫৪ কামাল আতাতুর্ক এভিনিউ সৈয়দ ভবন, ঢাকা-১২১৩ থেকে সম্পাদিত ও প্রকাশিত
© All rights reserved 2020 Daily Surjodoy