হুমায়ুন কবির:
মশাবাহিত ডেঙ্গু রোগ সারাদেশেই আশঙ্কাজনক হারে ছড়াচ্ছে। প্রথমদিকে রাজধানীতে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেশি থাকলেও এখন দেশের অন্যান্য স্থানেও তা ছড়িয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যে রেকর্ডসংখ্যক ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। আর চলতি মাসে রাজধানীতে যে হারে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ঘটেছে, তার চেয়ে দ্বিগুণ হারে রাজধানীর বাইরে সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। মূলত অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও ডেঙ্গু প্রতিরোধে কার্যকরী পদক্ষেপের দুর্বলতার কারণেই এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। রোগতত্ত্ব ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং স্বাস্থ্য অধিদফতর সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশে ইতোমধ্যে প্রায় ১৬ হাজার ডেঙ্গু রোগী সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে। তার মধ্যে ৫৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর চলতি মাসের ১৯ দিনে রাজধানীতে ৪ হাজার ১৫৪ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। আর এ মাসে রাজধানীর বাইরে ৯০০ জনের বেশি ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। মূলত গত মাসে রাজধানীর বাইরে ডেঙ্গুর সংক্রমণ বিস্তার হতে শুরু করে। তবে চলতি মাসে রাজধানীর চেয়েও দ্বিগুণ গতিতে অন্যান্য এলাকায় ডেঙ্গু সংক্রমণ ঘটেছে। চলতি মাসের শুরুতে মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, টাঙ্গাইল, শেরপুর, নেত্রকোনা, কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, শরীয়তপুর, কুমিল্লা, চাঁদপুর, নওগাঁ, পটুয়াখালী, বরিশাল, হবিগঞ্জ, নোয়াখালী, চুয়াডাঙ্গা, রাজশাহী, নাটোর, জয়পুরহাট, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজারে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ঘটতে দেখা গেছে। রোগী বৃদ্ধির এ ধারা অব্যাহত থাকলে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা ২০১৯ সালের মতো ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন। ওই সময় ডেঙ্গুতে সারা দেশে ১৭৯ জনের মৃত্যু হয় এবং আক্রান্তের সংখ্যা ছিল লক্ষাধিক।
সূত্র জানায়, বর্তমানে ডেঙ্গু জ¦রে আক্রান্তরা এর অতিসংক্রামক ধরন ডেন-৩-এ আক্রান্ত হচ্ছে। আর এ ধরনটির কারণে দ্রুত রোগীর অবস্থার অবনতি হয়। তাতে মৃত্যুর হার বেশি। এর কারণেই মূলত সারা দেশে ডেঙ্গু ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে। মশাবাহিত এ রোগ দেশের সব জেলায় যেভাবে ছড়িয়েছে, তা অন্য সময় দেখা যায়নি। মূলত অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে ডেঙ্গুর বিস্তার ঠেকাতে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়া ছাড়া বিকল্প নেই। কিন্তু দেশজুড়ে তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। পরিস্থিতি সামাল দিতে হলে পৌরসভা, ইউনিয়ন থেকে শুরু করে সব এলাকায় স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাকে কাজে লাগিয়ে ডেঙ্গু নির্মূল করা ছাড়া বিকল্প নেই। আর বিশেষ করে শিশুদের সাবধানে রাখতে হবে। করোনা মহামারীর কারণে ডেঙ্গু রোগের বিষয়টি যথাযথভাবে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়নি। তবে যতোটুকু পর্যবেক্ষণ ছিল তাও ছিল রাজধানীকেন্দ্রিক। ফলে এ সুযোগে জেলা পর্যায়ে ডেঙ্গুর বিস্তার ঘটেছে।
এদিকে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, এডিস ও এলবোপিকটাস মশা মানুষের শরীরে ডেঙ্গু ভাইরাস ছড়ানোর জন্য দায়ি। যখনই রোগী বাড়ছে তখনই তা নজরে আসছে। সারা দেশে একযোগে সপ্তাহব্যাপী এডিস মশা নিধনের কর্মসূচি পালন করা গেলে তা নির্মূল হতো। কিন্তু তা করা হয়নি। ডেঙ্গুর সঙ্গে নগরায়ণের একটা নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। কারণ অনিয়ন্ত্রিত ও অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধি পায়। মূলত স্থানীয় সরকার বিভাগেরই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কাজ করার কথা। কিন্তু সংশ্লিষ্ট সিটি করপোরেশন বা পৌরসভা অপেশাদারিত্বের সঙ্গে ওই কার্যক্রমটি করছে। পরিকল্পনাও ঠিক হচ্ছে না। কীটতত্ত্ববিদ, রক্তরোগ, ভাইরোলজিস্টসহ বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ পরামর্শক দল নিয়ে পরিকল্পনামাফিক ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তা করা হয়নি।
অন্যদিকে ডেঙ্গু আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য রাজধানীতে ৩০টি বেসরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি ১২টি সরকারি হাসপাতালকে নির্ধারণ করা হয়েছে। একই সঙ্গে সারা দেশে সেকেন্ডারি ও টারশিয়ারি পর্যায়ের হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি করা হচ্ছে। তবে রোগতত্ত্ববিদদের অভিযোগ, ডেঙ্গু চিকিৎসায় এখন পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিতে পারেনি স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে শুধু সচেতনতা বাড়িয়ে ডেঙ্গু প্রতিরোধ করা যাবে না। সেজন্য কেমিক্যাল পদক্ষেপ প্রয়োজন। হাসপাতালে ভর্তি রোগীর তথ্য নিয়ে বাড়িতে গিয়ে সেখানে মশা নিধনে পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। অথচ ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো একরকম প্রতারণা করছে। কারণ ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের জন্য আধুনিক কোনো প্রযুক্তি বা পরিকল্পনা স্থানীয় সরকার বিভাগের নেই। কেবল জমা পানি ফেলে দেয়াই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের উপায় নয়।
এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র ও লাইন ডিরেক্টর (অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন জানান, ডেঙ্গুকে কখনই রাজধানী বা রাজধানীর বাইরের বিষয় হিসেবে সীমাবদ্ধ করা যাবে না। যেখানেই এডিস মশা থাকবে সেখানেই ডেঙ্গু রোগ ছড়াবে। মশা নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় সরকার বিভাগ কাজ করে। বিষয়টি সম্পূর্ণ তাদের কার্যক্রমের আওতায়। স্বাস্থ্য বিভাগ চিকিৎসা ও গবেষণা করে থাকে। আগেই ডেঙ্গু বাড়ার বিষয়টি দেশের সব সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাকে চিঠি দিয়ে সতর্ক করা হয়েছিল। কিন্তু তারা সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারেনি। যার ফলে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
প্রতিষ্ঠাতা : মেজর (অব) মোঃ মোদাচ্ছের হোসাইন, সম্পাদক মন্ডলির সভাপতি: বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুজ্জামান আহমেদ এমপি, ব্যবস্থাপনা সম্পাদক: তৌহিদ আহমেদে রেজা, বার্তা সম্পাদক: আসমা আহমেদ কর্তৃক ৫৪ কামাল আতাতুর্ক এভিনিউ সৈয়দ ভবন, ঢাকা-১২১৩ থেকে সম্পাদিত ও প্রকাশিত
© All rights reserved 2020 Daily Surjodoy