ফারহানা বি হেনা,
অন্ধ মুয়াজ্জিনের অসাধারণ প্রতিভা
দু’চোখে নেই কোনো আলো। লাঠি হাতে ধরে রাস্তায় ঠক ঠক করে চলছেন চল্লিশোর্ধ মো. মনির হোসেন। শারীরিক প্রতিবন্ধকতায় লেখাপড়ার সুযোগ না পেলে ও তার রয়েছে অত্যন্ত প্রখর স্মরণশক্তি। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে গ্রামের গণ্যমাণ্য ব্যক্তি, আলেম উলামা, মাশায়েখসহ অনেক লোকজনের মোবাইল নম্বর মুখস্থ বলতে পারেন তিনি। সেই সঙ্গে কারো মোবাইল নম্বর বলার সঙ্গে সঙ্গে নাম্বার লাগিয়ে বলতে পারেন কথা। মোবাইল ফোনে গলার কণ্ঠ শুনে বলে দিতে পারেন ওই ব্যক্তি কে। তাছাড়া স্থানীয় একটি মসজিদে মুয়াজ্জিন হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।
অসাধারণ প্রতিভাবান মনির হোসেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার দক্ষিণ ইউনিয়নের হীরাপুর বড় কুড়ি পাইকা গ্রামের আব্দুল হাকিমের ছেলে। তার পরিবারে ২ ছেলে ২ মেয়েসহ ৬ জন সদস্য রয়েছে। স্বাভাবিকভাবে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীর পক্ষে যা একেবারে অসাধ্য, তাই তিনি এক প্রকার সাধন করে দেখিয়েছেন।
স্থানীয়রা বলেন, প্রতিবন্ধী হয়েও ঘরে বসে থাকেননি তিনি। নিজের ইচ্ছা শক্তিকে কাজে লাগিয়ে কিছু ধর্মী শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে বড় কুড়িপাইকা জামে মসজিদের মুয়াজ্জিন হিসেবে দিচ্ছেন দৈনিক ৫ বেলা আজান। কোনো সময় ইমাম না থাকলে তাকে নামাজও পড়াতে হয়। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তিসহ অনেক আলেম উলামা ও তাবলীগ জামায়াতের অনেক লোকজনের নাম ও মোবাইল নম্বর হুবহু বলতে পারেন তিনি। তাছাড়া মোবাইল নম্বরের শেষ দুই ডিজিট বললেই তিনি বুঝতে পারেন ওটা কার নাম্বার।
মুয়াজ্জিন মনির হোসেনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মসজিদ থেকে ৫০০ গজ দূরে একটি বাড়িতে পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করছেন। এখানে কোনো তার জায়গা জমি বলেতে কিছুই নেই। অন্যের জায়গায় ছোট একটি ঘরে পরিবার নিয়ে থাকছেন। তার চলার একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে হাতে থাকা একটি লাঠি। সকাল বিকেল রাতে মসজিদ ও জরুরি প্রয়োজনে কোথাও যেতে হলে এ লাঠির সাহায্যে তাকে চলতে হয়। দৈনিক ৫ ওয়াক্ত মসজিদে আজান দিতে তাকে নির্ধারিত সময়ের আগে পৌঁছে যান তিনি।
মনির বলেন, তার বয়স যখন ৭ বছর তখন তার কপাল ও মাথায় বড় একটি ফোঁড়া হয়। অনেক চেষ্টা করার পর ভালো না হওয়ায় এক নিকট আত্মীয়ের পরামর্শে সদর উপজেলার ভাতশালা এলাকায় পল্লী চিকিৎসকের কাছে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে চলে তার চিকিৎসা। ভালো না হওয়ায় ওই চিকিৎসক একপর্যায়ে তার ফোঁড়া কেটে ফেলে। এরপর থেকে আস্তে আস্তে তার দুই চোখের আলো নিভে যায়। চোখের আলো ছাড়া বেঁচে থাকতে তাকে অনেক সংগ্রাম করতে হচ্ছে। স্থানীয় আলেম উলামার কাছ থেকে মুখে মুখে শুদ্ধ করে শিখেছেন পবিত্র কোরআন শরীফের সুরা কেরাত। পাশাপাশি তাবলীগ জামায়াতে সময় দিয়ে শিখেছেন মাসআলা মাছায়েল ও দোয়া। এরপর থেকে তার জীবন ধারা যেন পাল্টে যায়। এরই মধ্যে বড় কুড়ি পাইকা জামে মসজিদে দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে তিনি মুয়াজ্জিন হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
মনির ও পরিবারে বিকল্প কোনো অর্থ উপার্জনক্ষম লোক না থাকায় এ সামান্য আয় দিয়ে চলে সংসার। তাছাড়া তিনি পাচ্ছে না কোনো প্রতিবন্ধী ভাতা ও। নেই নিজের কোনো জায়গা জমিও। সরকার ভূমিহীনদের জন্য যে গৃহ নির্মাণ করে দিচ্ছেন আপনাকে তা দেওয়া হয়েছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন নাম নিয়েছে ঘর পাব কিনা এখন পযর্ন্ত কোনো খবর পাননি।
মসজিদের মুসল্লি মো. আশরাফ ভূইয়া বলেন, মনির খুবই অসহায়। তার দুই চোখ না থাকায় কোনো কাজ করতে পারছে না। মসজিদের মুয়াজ্জিনের কাজ ছাড়া তার আর কোনো উপার্জন না থাকায় খুবই কষ্ট করে তার চলতে হচ্ছে।
বড় কুড়ি পাইকা জামে মসজিদের সাধারণ সম্পাদক মো. মোবারক হোসেন বলেন, মনির অসাধারণ প্রতিভা সম্পন্ন ব্যক্তি। মানবিক দিক বিবেচনা করে তাকে এ মসজিদে মুয়াজ্জিনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কোরআন শরীফের বহু ছুরা তার মুখস্থ আছে। সে কখনো তার কর্তব্যে ফাঁকি দেয়নি।
তিনি আরো বলেন, এলাকাসহ বাইরের বহু লোকের মোবাইল নম্বর তার মুখস্থ রয়েছে। নাম বলে নম্বর লাগিয়ে মোবাইল করতে পারে। তাছাড়া মানুষের শব্দ শুনে বলে দিতে পারে সে কে।
পল্লী চিকিৎসক ডাক্তার মো. শাহজাহান বলেন, ধারণা করা হচ্ছে ভুল চিকিৎসায় তার দুটি চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। এখন সে লাঠির সাহায্যে চলাচল করছে। এলাকার বহুগণ্যমান্য লোকদের মোবাইল নাম্বার মুখস্থ রয়েছে তার।
আখাউড়া দক্ষিণ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. জালাল হোসেন বলেন, মনির হোসেনের একজন অসহায় দৃষ্টি প্রতিবন্ধী একজন গরিব মানুষ। প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পে আওতায় ঘরের জন্য তার নাম দেওয়া আছে। ঘর নির্মাণ হওয়া মাত্র তাকে ঘর বুঝিয়ে দেওয়া হবে। তাছাড়া বিভিন্নভাবে তাকে সহযোগিতা করা হচ্ছে।
উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা আফসানা পারভীন বলেন, বর্তমান সরকার প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এ উপজেলায় অনেক প্রতিবন্ধী রয়েছে, তাদের খোঁজ খবর নিয়ে প্রতিবন্ধীর ভাতার আওতায় আনা হবে।
প্রতিষ্ঠাতা : মেজর (অব) মোঃ মোদাচ্ছের হোসাইন, সম্পাদক মন্ডলির সভাপতি: বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুজ্জামান আহমেদ এমপি, ব্যবস্থাপনা সম্পাদক: তৌহিদ আহমেদে রেজা, বার্তা সম্পাদক: আসমা আহমেদ কর্তৃক ৫৪ কামাল আতাতুর্ক এভিনিউ সৈয়দ ভবন, ঢাকা-১২১৩ থেকে সম্পাদিত ও প্রকাশিত
© All rights reserved 2020 Daily Surjodoy