উত্তরের সীমান্তবর্তী অবহেলিত একটি জেলার নাম লালমনিরহাট। এ জেলার মানুষজন অত্যান্ত সহজ-সরল। এই অবহেলিত জেলায় বসবাসকারী মানুষজন বেশির ভাগই কৃষি কাজের উপর নির্ভরশীল।
৫টি উপজেলা, ২টি পৌরসভা, ৪৫টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত এ জেলা। প্রায় ২০ লাখ মানুষের বসবাস। এসব মানুষের স্বাস্থ্য সেবার মান নিশ্চিত করতে জেলা সদর হাসপাতাল রয়েছে। ৫০ শয্যার হাসপাতালটি পর্যায়ক্রমে ১০০ শয্যা, এরপর সর্বশেষ ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট উন্নীতকরণ করা হয়।
২৫০ শয্যায় উন্নতিকরণ করা হলেও বাড়েনি স্বাস্থ্য সেবারমান। শয্যা সংকটের কারনে ভবনের বারান্দা, সিঁড়ি ও মেঝোতে থাকতে হচ্ছে রোগী ও তাদের স্বজনদের। প্রয়োজনীয় ওষুধ সরকার সরবরাহ করলেও তা কালোবাজারে বিক্রি'র অভিযোগ অনেক আগ থেকে।
সাধারণ অসুস্থতা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেই ডাঃ রেফার্ড করেন রংপুর অথবা কোন ক্লিনিকে। যে ক্লিনিকে সময় দেন হাসপাতালের ওইসব ডাঃ। সরকার দেওয়া নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত হাসপাতালে রোগী দেখার নিয়ম থাকলেও এবং সপ্তাহে-৭ দিন হাসপাতালে স্বাস্থ্য সেবা দেওয়ার কথা হলেও ডাঃ গণ মানছেন না সে নিয়ম। সপ্তাহে ২/৩ দিন ২ ঘন্টার জন্য নামমাত্র স্বাস্থ্য-সেবা দিয়ে চলে যান বিভিন্ন ক্লিনিকে। কথায় কথায় প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে রোগীর স্বজনদের ভয়ভীতি দেখিয়ে রেফার্ড করা হয় ক্লিনিক বা রংপুর হাসপাতালে। তাই চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা ক্ষোভের সাথে জেলা সদর হাসপাতালের নাম রেখেছেন রেফার্ড হাসপাতাল।
জানা গেছে, ২৫০ শয্যার অবকাঠামো তৈরি হলেও ১০০ শয্যার অবকাঠামো ও জনবল দিয়ে চলছে সদর হাসপাতালটি। ১০০ শয্যার জন্য অনুমোদিত চিকিৎসকের পদ সংখ্যা ৪১ জন। তার বিপরীতে হাসপাতালে কর্মরত আছে ২২ জন এবং শূন্য আছে ১৯টি পদ। এছাড়াও নার্সদের মন্জুরীকৃত পদ আছে ৭৩ টি। তার বিপরীতে কর্মরত আছে ৬৫ জন। শূন্য আছে ৮টি পদ। মেডিকেল টেকনোলজিষ্ট (ফিজিও) মেডিকেল টেকনোলজিষ্ট (রেডিও) ফার্মাসিষ্ট, টিকিট ক্লার্ক, ওয়ার্ড মাষ্টার, ল্যাব অ্যাটেন্ডেন্ট, বাবুর্চি, ডোম, অফিস সহায়ক, স্টেচার বেয়ারার, সুইপার এবং ওয়ার্ড বয়সহ তৃতীয় এবং চতুর্থ শ্রেণির পদগুলোর বেশির-ভাগই আছে শূন্য। অদক্ষ জনবল জোড়াতালি দিয়ে চলছে হাসপাতাল, হচ্ছে না কোন প্রকার পরিক্ষা-নিরিক্ষা, ফলে অকেজো হয়ে পড়েছে হাসপাতালের দামী-দামী এক্সে মেশিন গুলো। ফলে কাঙ্ক্ষিত স্বাস্থ্য সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে জেলার মানুষজন।
জেলাবাসীর স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে সরকার ২০১৭ সালে নভেম্বর মাসে প্রায় ৩৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ২৫০ শয্যার হাসপাতালের নতুন ভবনটির নির্মান কাজ শুরু করে। ২০১৯ সালের জুন মাসে ভবনটির কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। কয়েক দফায় সময়
বাড়ালেও পুরো কাজ শেষ হয়নি। তবে চলতি বছরের জুন মাসে ভবনটির কাজ শেষে হস্তান্তর করা হবে।
অভিযোগ উঠেছে, মেডিকেল জুড়ে ডাক্তারের সংখ্যা কম থাকায় ঠিকমতো চিকিৎসা সেবা দিচ্ছে না অন্যান্য চিকিৎসকগন। কেউ বেসরকারি ক্লিনিক নিয়ে ব্যস্থ, কেউ নিজস্ব ক্লিনিক নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন। হাসপাতালে জটিল কোন অপারেশন তো হচ্ছেই না, ছোট কোন অপারেশন করতে গেলেও কর্তৃপক্ষের কাছে শুনতে হয় নানা অজুহাত। তাহলে মেডিকেলের রোগীদের কি হবে? প্রশ্ন থেকেই যায়। রোগীদের দুর্ভোগ, চিকিৎসক ও নার্সদের দূর্ব্যবহার, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, দুর্গন্ধে ভরা যেন দেখার কেউ নেই।
চিকিৎসা সেবা নিতে আসা সদর উপজেলার মোগলহাট ইউনিয়ন দীঘলটারী গ্রামের মিঠু মিয়া (২৮) বলেন, আমার স্ত্রী মোর্শেদা বেগম সন্তান প্রসবের ব্যর্থা অনুভব হলে সদর হাসপাতালের গাইনী ওয়ার্ডে ভর্তি করি। কিন্তু ওই হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. তপন কুমার রায় সকাল ৯টা থেকে দুপুর ২টা দায়িত্বে থাকলেও রোগীকে দেখতে আসেন নাই। বাধ্য হয়ে স্ত্রীকে ক্লিনিকে নিলে বাচ্চা প্রসব করেন।
পৌরসভার নবীনগরের বাসিন্দা রাশেদা বেগম (৩৪) বলেন, গত ১৫ ডিসেম্বর আমার ছেলের পা কেটে
যাওয়ায় গুরুতর আহত হয়। সদর হাসপাতালে নিলে প্রাথমিক চিকিৎসার পরে ডাক্তার বলেন, এই হাসপাতালে অর্থপেটিক ডাক্তার নেই। রোগীকে রংপুরে নিয়ে যান। অন্য এক চিকিৎসক বলেন, ক্লিনিক থেকে চিকিৎসা নিলে তারাতারি সুস্থ হয়ে যাবে। রাশেদা অসহায় হয়ে এক পর্যায়ে রাত ১২ টায় ছেলেকে নিয়ে রংপুর মেডিকেল হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা দেন।
পৌরসভার ওয়াললেস কলোনির বাসিন্দা এম.এ হান্নান (৪৫) নামে এক অভিভাবক ক্ষোভ নিয়ে বলেন, গত মাসের ১৪ তারিখে আমার ১৫ দিন বয়সের নাতনি অসুস্থ হলে নিবীর পর্যবেক্ষনে রাখা হয়েছিলো। সেখানে ডাক্তার নার্সদের সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে শিশুরা। নার্সদের ব্যবহার অত্যন্ত খারাপ। শিশু ওয়ার্ডে ডাক্তার তপন কুমার রায় রোগীদের ঠিকমত চিকিৎসা সেবা দিচ্ছে না। হান্নান কাঁদতে কাঁদতে আরো বলেন, আমার ১৫ দিনের নাতনি সঠিক চিকিৎসা না পেয়ে ২৯ নভেম্বর মেডিকেলে মারা গেছে।
সদর হাসপাতালের তত্বাবধায়ক ডাঃ মোঃ রমজান আলী-কে উক্ত বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, হাসপাতালে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সেবা নিতে আসা রোগীদের ক্লিনিক মুখী করছেন ডাক্তারগণ এই বিষয়টি আমার জানা নেই। ডাক্তারগণ সপ্তাহে কয়দিন দায়িত্ব পালন করবেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, সপ্তাহে ৬/৭ দিনই হাসপাতালে স্বাস্থ্য সেবা দেয়ার নিয়ম। কিন্তু ৬/৭ দিনের পরিবর্তে সপ্তাহে ২/৩ দিন স্বাস্থ্য সেবা দিচ্ছেন ডাক্তারগণ এমন প্রশ্নে তিনি আরও বলেন, হাসপাতালে জনবল কম থাকায় একটু হেরফের হচ্ছে।