আজ বৃহস্পতিবার ০১ জুন বিশ্ব দুগ্ধ দিবস ২০২৩। দুধ এবং দুগ্ধজাত পণ্যের উপকারিতা বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার উদ্যোগে ২০০১ সাল থেকে প্রতি বছর জুন মাসের প্রথম দিন দিবসটি পালিত হচ্ছে। প্রতি বছরের মতো এবারও যথাযথভাবে দিবসটি পালন করা হবে। বিশ্ব দুগ্ধ দিবস ২০২৩-এর প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘টেকসই দুগ্ধ শিল্প :সুস্থ মানুষ সবুজ পৃথিবী। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) সর্বপ্রথম ২০০১ সালে বিশ্ব দুগ্ধ দিবস উদযাপনের জন্য ১ জুনকে নির্ধারণ করে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বছরের এই সময়েই দুগ্ধ দিবস উদযাপিত হতো। দিবসটি দুধ এবং দুগ্ধ শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত কার্যক্রমে আরো মনোযোগ দেয়ার সুযোগ প্রদান করে।
২০১৬ সাল নাগাদ বিশ্বের প্রায় ৪০টি দেশে দুধ দিবস উদযাপিত হয়। এ দিন জাতীয় অর্থনীতিতে দুগ্ধ শিল্পের গুরুত্ব তুলে ধরে বিভিন্ন কার্যক্রমের আয়োজন করা হয়। দুধ আমাদের সকলের পরিচিত। দুধের উপকারিতা যেমন আছে তেমনি অপকারিতাও আছে। আমরা অনেকেই দুধ খেতে পছন্দ করি আবার অনেকের কাছে এটি অপছন্দ একটি খাবার। দুধের মধ্যে আছে অনেক পুষ্টিগুন যা আমাদের শরীরের জন্য খুবই উপকারি।দুধ পুষ্টিগুণে ভরপুর। শিশু, প্রাপ্তবয়স্ক ও বৃদ্ধ–সবারই প্রতিদিন এক গ্লাস দুধ পান করা উচিত। দুধ ভিটামিন ডি ও ক্যালসিয়ামের উৎস। দুধে আছে প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, চর্বি, ওমেগা থ্রি, ওমেগা সিক্সসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। দুধকে বলা হয় সুপার ফুড। এতে আছে প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ, যা শরীরের জন্য জরুরি। এতে প্রচুর ভিটামিন বি-১২ আছে, যা মস্তিষ্কের জন্য প্রয়োজন। দুধ শরীরকে কর্মক্ষম রাখতে সাহায্য করে। এ ছাড়া দেহের টিস্যু ও কোষ মেরামতের জন্য দারুণ উপকারী।
এক নজরে জেনে নিন দুধের উপকারিতা ও অপকারিতা
>দুধের উপকারিতা :-
*স্মৃতি শক্তি বৃদ্ধিতেঃ কম চর্বিযুক্ত দুধ মস্তিষ্কের শক্তি বাড়াতে এবং আলঝেইমার রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে। এটি ভিটামিন বি 12 এর একটি ভাল উৎস, চিন্তা শক্তি বজায় রাখার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রোটিন। ভিটামিন B-12 এর অভাব থাকে তাদের স্মৃতিশক্তি হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
তাই আপনি স্কুলগামী শিশু বা 60 বছর বয়সী হোন না কেন, কম চর্বিযুক্ত দুধ পান করুন এবং আপনার মস্তিষ্কের শক্তি বাড়ান। এটি আপনাকে বার্ধক্যজনিত জ্ঞানীয় হ্রাস থেকেও রক্ষা করবে।
* ওজন কমাতেঃ দুধ ওজন কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি ক্যালসিয়াম এবং ভিটামিন ডি এর একটি ভাল উৎস যা শরীরে চর্বি পোড়ানোর প্রভাব ফেলে। দুধে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন এবং জল থাকে যা আপনার পেটকে দীর্ঘক্ষণ ভরা রাখে। এছাড়াও, এতে রয়েছে কনজুগেটেড লিনোলিক অ্যাসিড (সিএলএ), যা মোটা ব্যক্তিদের অতিরিক্ত চর্বি থেকে মুক্তি পেতে সহায়তা করে। ওজন কমাতে প্রতিদিন স্কিম দুধ পান করুন, স্বাস্থ্যকর খাবার খান এবং প্রচুর ব্যায়াম করুন।
* হাড় ও পেশিকে শক্তিশালী করতেঃ দুধে আছে প্রচুর পরিমানে ক্যাসলিয়াম ও ভিটামিন ডি যা আমাদের শরীর হাড় ও পেশিকে শক্তিশালী করতে সাহায্য করে। প্রতিদিন এক গ্লাস করে দুধ খেলে আমাদের হাড় মজবুদ ও শক্তিশালী হবে। শিশু থেকে শুরু করে বয়স্ক পর্যন্ত সবারই দুধ খাওয়া উচিত কারন দুধের উপকারিতা অনেক।
* ফিটনেস ভালো ও সুস্থ রাখেঃ ফিটনেস ঠিক রাখতে আমরা কতকিছুই না করে থাকি। অনেকে জিম করে, কেই জগিং করে। আপনি কি জানেন শরীর সুস্থ রাখার একমাত্র উপায় হলো স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া। স্বাস্থ্যকর খাবারের মধ্যে দুখ খুবই উপকারি। নিয়মিত দুধ খেলে আপনার শরীর সুস্থ থাকবে এবং মন সতেজ থাকবে। তাই আমাদের প্রতিদিন একগ্লাস করে দুধ খাওয়া উচিত।
* শরীরের শক্তি যোগায় এবং ক্লান্তি দুর করেঃ শরীরে শক্তি যোগাতে দুধের উপকারিতা অনেক। আপনি হয়তো জানেন না দুধ খেলে আপনার শরীলে শক্তি সঞ্চয় হয় এবং আপনার ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। আমরা প্রতিদিন কত কাজেই না ব্যস্ত থাকি। আমাদের শরীর অনেক ক্লান্ত হয়ে পরে। আপনি যদি নিয়মিত দুধ খেতে পারেন তাহলে এই ক্লান্তি দূর হয়ে যাবে। গরুর দুধে আছে ভিটামিন, প্রাটিন, ক্যালসিয়াম, পটাসিয়াম ও ফসফরাস সহ নানান পুষ্টিগুন।
* মানসিক চাপ দূর করতেঃ দুধে থাকা পুষ্টিগুন আমাদের মানসিক চাপ দূর করতে সাহায্য করে। আমরা যখন মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পরি বা দুশ্চিন্তা করি তখন আমরা অনেক ক্লান্ত এবং ভেঙ্গে পরি। আমরা যদি প্রতিদিন দুধ খাই তাহলে এই ক্লান্তিগুলো দূর হয়ে যাবে ফলে মন এবং শরীর তাজা থাকবে। তাই আমাদের প্রতিদিন দুধ খাওয়া অভ্যাস করা উচিত।
* শরীরের ওজন হ্রাস করেঃ প্রতিদিন দুধ খেলে শরীরের ওজন হ্রাস করতে সাহায্য করে। আমাদের প্রতিদিন দুধ খাওয়া উচিত।
* হার্টের স্বাস্থ্য ভালো রাখেঃ প্রতিদিন দুধ খেলে হার্ট ভাল থাকে। কম ফ্যাট যুক্ত দুধ খেলে রক্তে ভালো কোলেস্টেরলের পরিমান বৃদ্ধি পায় ও খারাপ কোলেস্টেরলের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। হার্ট ভাল রাখতে প্রতিদিন দুখ পান করুন।
* ডায়াবেটিসের সমস্যা কমাতেঃ দুধের উপকারিতার মধ্যে এটি অন্যতম। আমরা জানি দুধে ক্যালশিয়াম ও ভিটামিন ডি তে ভরপুর। যাদের ডায়াবেটিস আছে তারা যদি প্রতিদিন দুধ খায় তাহলে এই সমস্যা কমবে বলে জানা যাচ্ছে। তবে কম ফ্যাট যুক্ত দুধ খেতে হবে।
* পেটের সমস্যা ও অ্যাসিডিটি কমায়ঃ পেটের সমস্যা ও অ্যাসিডিটি কমাতে দুধের উপকারিতা অনেক। দুধে থাকা ক্যাসলিয়াম ও ভিটিমিন ডি সমস্যা ও অ্যাসিডিটি দুর করে কিন্তু লো ফ্যাট যুক্ত দুধ খাওয়া উচিত।
* রাতে ভাল ঘুম হয়ঃ অনেকেরই রাতে ঘুম হয় না। রাতে ঘুম ভাল করতে গরম দুধ খুবই উপকারি একটি খাদ্য। ঘুমানোর আগে এক গ্লাস গরম দুধ পান করুন দেখবেন ঘুম ভাল হচ্ছে।
* দাঁত ভাল রাখেঃ বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমাদের দাঁত ক্ষয় হতে শুরু করে। অনেকেরই আবার ছোট থেকেই ক্ষত শুরু হয়ে যা। দুধে থাকা ক্যালসিয়াম হারের পাশাপাশি দাঁতের ক্ষয় রোধ করে এবং দাঁত ভাল রাখে।
* শরীরে ক্যালসিয়ামের অভাবঃ আমরা তো জানি যে দুধে আছে প্রচুর ক্যালসিয়াম তাই নিয়মিত দুধ খেলে ক্যালসিয়ামের অভাব দূর হয়ে যাবে নিমিশেই।
* ব্লাড প্রেসার ঠিক রাখতেঃ ব্লাড প্রেসার ঠিক রাখাতে নিয়মিত দুধ খান।
* স্ট্রেস দূর করতেঃ রিসার্সে জানা যায় দুধ স্ট্রেস কমাতে সাহায্য করে। তাই যারা স্ট্রেসে ভুগছেন তারা প্রতিদিন অনতত এক গ্লাস করে দুধ পান করুন।
* ত্বককে পরিষ্কার ও উজ্জ্বল রাখেঃ আপনি না জানলে জেনে রাখুন ত্বক ভালো রাখতে দুধের উপকারিতা আছে। নিয়মিত লো ফ্যাট দুধ খেলে নাকি ত্বক কম ফাটে, এর কারণ হল কম ফ্যাট যুক্ত দুধে থাকে ট্রাই-গ্লিসারাইড। নিয়মিত ত্বকে দুধ লাগালে ত্বকের থেকে অতিরিক্ত তেল কমে যায়।
* চুলকে স্বাস্থ্যকর করে তোলেঃ দুধ চুলকে স্বাস্থ্যকর করে তুলতে সাহায্য করে। এছাড়া চুলের নানা প্যাক দুধ দিয়ে বানান।
* পাকস্থলী পরিষ্কার রাখে এবং হজম শক্তি বাড়ায়ঃ পাকস্থলী পরিষ্কার রাখতে দুধ খুবই উপকারি একটি খাদ্য। দুধ যেহেতু পানীয় খাবার তাই এটি খুব সহজেই পাকস্থলী পরিষ্কার করতে সাহায্য করে। যাদের হজমে সমস্যা তারা নিয়মিত দুধ খাওয়ার অভ্যাস করুন।
* ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়ঃ দুধে প্রচুর পরিমানে ভিটামিন ডি থাকার জন্য আমাদের শরীরের কোষের বৃদ্ধিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। একটি গবেষণায় দেখা যায় যে যে দুধ নাকি ওভারিয়ান ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। তাই দুধ নিয়মিত খাওয়া খুবই ভালো ।
* রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়ঃ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে দুধের উপকারিতা অধিক। দুধে থাকা ভিটামিন ও ক্যালসিয়াম আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
* গলা ব্যথাঃ আপনি যদি গলা ব্যথা অনুভব করেন তবে এক কাপ গরম দুধ ব্যথা উপশম করতে সাহায্য করে।
> দুধ খাওয়ার অপকারিতা
১। যাদের কিডনিতে পাথর হয়েছে তাদের দুধের ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত। কিডনি রোগীদের জন্য কম খাওয়া এবং রাতে দুধ না খাওয়াই উত্তম।
২। যাদের শরীরে ‘ল্যাক্টেজ’ (lactase) নামক এনজাইমের অভাব আছে, তাদের উচিত দুধ খাওয়ার ব্যাপারে সাবধান হওয়া।
৩। এলার্জি থাকলে, দুধ খাওয়ার ব্যাপারে সাবধান হোন। কারণ, এলার্জির রোগীদের দুধ খেতে নিষেধ করেন সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা। অকেনের আবার দুধে এলার্জি আছে বলে জানা যায়।
৪। যারা পাকস্থলীর আলসার তথা গ্যাস্ট্রিক আলসারের রোগী, তাদেরও দুধ খাওয়া উচিত নয়। এই সকল রোগীদের দুধ খেলে পেটে ব্যথা ও ডায়রিয়া হতে পারে।
৫। যাদের পেটে অপারেশান করা হয়েছে, তাদের দুধ খাওয়া উচিত না যখন পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠছেন তখন দুধ খেতে পারে।
অতি মাত্রায় দুধ খাওয়া উচিত না। অনেকে আছেন প্রতিদিন অনেক দুধ খেয়ে থাকেন। প্রতিদিন নিয়ম করে এক গ্লাস বা ২ গ্লাস দুধ খেতে পারেন। কিন্তু অতিরিক্ত দুধ খেলে উপকারের চেয়ে অপকারি বেশি হতে পারে। তবে দুধের উপকারিতা ও অপকারিতা হিসাবে করলে দেখা যাচ্ছে দুধের উপকারিতার পরিমানি বেশি।
> ছাগলের দুধের উপকারিতা১. হার্ট ভালো রাখে।২. পুষ্টিগুণ মায়ের বুকের দুধের কাছাকাছি।৩. এলার্জি প্রবণতা কম।৪. উচ্চ ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ।৫. ত্বকের যত্নে উপকারী।৬. ল্যাকটোজ অসহিষ্ণু।৭. হজম করা যায় সহজেই।৮. এলার্জি নিয়ন্ত্রণ করে।৯. হাঁড়ের গঠনকে শক্তিশালী করে।১০. কোলেস্টেরল কম।১১. বাড়ন্ত শিশুর জন্য উপকারী।
পরিশেষে বলতে চাই, উপরিউক্ত লেখাটি দুধের পুষ্টি গুনাগুন উপকারিতা অপকারিতা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ইত্যাদি বিষয়ে বিশদ ভাবে তুলে ধরা হয়েছে। আশা করি আপনি বুঝতে পারবেন দুধের উপকারিতা কি। কখন কিভাবে খেতে হবে এবং দুধকে আদর্শ খাদ্য বলা হয়। তাই আমাদের প্রতিদিন দুধ খাওয়ার অভ্যাস করা উচিত।
লেখক :
কলাম লেখক ও গবেষক
প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।