জন্মিলে মরিতে হইবে এটা একটা চিরন্তন বাণী। পৃথিবীতে এমন কোন প্রাণীর অস্তিত্ব পাওয়া যাবে না যে অমর, যার কোন দিন মৃত্যু হবে না। আমার জানা মতে পৃথিবীর সকল ধর্ম গ্রন্থেই বলা আছে প্রতিটি জীবকে মৃত্যুর স্বাদ উপভোগ করতে হবে। আর মানুষ যেহেতু সৃষ্টির সেবা জীব সেক্ষেত্রে তাদো ক্ষেত্রে এ বিষয়ে কোন বলার অবকাশ রাখে না। এই চিরন্তন কথার সাথে তাল মিলিয়ে আমরা বলতে পারি প্রতিটি মানুষকে প্রবীণের স্বাদ উপভোগ করতে হবে। মানুষের আয়ুক্কাল যদি আমরা বিশ্বাস কাে থাকি তাহলে মহান রাব্বুল আলামিন বা ভগবান বা ঈশ্বর আমাদের যে আয়ু দিয়ে এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন সেই অবধি যদি আমরা বেঁচে থাকি তাহলে অবশ্যই আমাদের প্রত্যেককে প্রবীণের স্বাদ উপভোগ করতে হবে। তাই আমাদের সকলেরই উচিত হবে পরিবার ও সমাজে বসবাসরত প্রবীণ মানুষের জীবণাচার উপলদ্ধি করে সেখান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে ভবিষৎ এর জন্য নিজেদের প্রস্তুত করা। যাতে প্রবীণ বয়সে আমরা সকলেই নিরাপদে থাকতে পারি।
একটা বিষয় আমাদের মনে রাখা দরকার যে পৃথিবীর সকল প্রবীণরাই একই সমস্যায় ভুগছে। ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে বিশ্বের সকল প্রবীণই প্রান্তিক। জোয়ান বয়সের সম্পদশালী আর দাপুটে মানুষটিও প্রবীণ বয়সে অসহায় হয়ে পড়ে। কারণ এ সময় সে কর্মশক্তি হারিয়ে ফেলে, সন্তান বা নিকট আত্বীয়ের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, চোখের পাওয়ার কমে যায়, মনের বল হারিয়ে যায়, নিজে আর্থিক কর্মকান্ডের সাথে সম্পৃক্ত থাকার শক্তি হারিয়ে ফেলে। সঙ্গত কারণেই এই প্রবীণ ব্যক্তির নামে অনেক সম্পদ আর ব্যাংক ব্যালেন্স থাকলেও পরনির্ভশীলতার কারণে সে প্রান্তিক হয়ে পড়ে। তাহলে দেখা যাচ্ছে বিশ্বের সকল প্রবীণই প্রান্তিক। আর প্রান্তিক প্রবীণদের ভালো রাখার জন্য প্রয়োজন হয় পরিবারের সদস্যদের বাড়তি মনোনিবেশ আর সংবেদনশীলতা। যদিও এটা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হয়ে ওঠে না।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ২০১৩ সালের ১৭ নভেম্বর “জাতীয় প্রবীণ নীতি” অনুমোদন করেছে। প্রণীত জাতীয় প্রবীণ নীতিমালায় ষাটোর্ধ ব্যক্তিদের প্রবীণ হিসাবে গণ্য করা হয়েছে। প্রবীণ নীতিমালায় প্রবীণদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও সুরক্ষা বিষয়ে সরকারের নানারুপ উদ্যোগের কথাও বলা হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো-বাংলাদেশে প্রবীণ ব্যক্তিদের অবস্থা, সংবিধানে প্রবীণ ব্যক্তি, আন্তঃ প্রজম্ম যোগাযোগ ও সংহতি, প্রবীণ ব্যক্তির সামাজিক সুযোগ-সুবিধা, জীবণ ও সম্পত্তির নিরাপত্তা, দারিদ্র দুরীকরণ, আর্থিক নিরাপত্তা, প্রবীণ ব্যক্তিদের স্বাস্থ্য পরিচর্যা ও পুষ্টি, জলবায়ু পরিবর্তন ও দূর্যোগে প্রবীণ ব্যক্তি, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, বিশেষ কল্যাণ কার্যক্রম, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, কমিটিসমুহ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। অন্যদিকে ২০১৪ সালের ২৭ নভেম্বর মহামান্য রাষ্ট্রপতি প্রবীণ জনগোষ্ঠীকে “সিনিয়র সিটিজেন” বা “জ্যেষ্ঠ নাগরিক” হিসাবে ঘোষণার মাধ্যমে তাদের স্বীকৃতি প্রদান করেছে।
এটা প্রাকৃতিক সত্য, মানুষ যখন প্রবীণ হয় তখন তারা শিশুর মতো আচরণ করতে শুরু করে। এক কথা বার বার বলা, অল্পতে কথা ভূলে যাওয়া, নানা জিনিস খেতে চাওয়া, পরিবারের সদস্যদের শাসনে আবদ্ধ করে রাখতে চাওয়া, সাথে ঘুরতে যেতে চাওয়া ইত্যাদি। এ কারণে আমরা পরিবারের সদস্যরা অনেক ক্ষেত্রেই বিরক্তি বোধ করি। প্রবীণদের উপর নানা ভাবে আমরা অবহেলা প্রদর্শন করি। আমরা এটা ভুলেই যাই যে, আজকের এই সাজানো গোছানো পরিবারটির পেছনে লেগে আছে আজকের প্রবীণের রক্ত ঝরানো ঘামের দাগ। আমরা বেমালুম ভুলে যাই এক সময়ের পরিবারের কর্তা প্রবীণ মানুষটির অতীত কির্ত্তীর কথা। আর তাই কারণে অকারণে পরিবারের প্রবীণদের অবহেলা আর লাঞ্ছনা করতে আমরা কুন্ঠাবোধ করিনা। আমরা অনেকেই প্রবীণকে পরিবারের জঞ্জাল মনে করি পাঠিয়ে দেই প্রবীণ নিবাস নামক রুপকী জেল খানায়। আমরা কখনো ভেবে দেখিনা প্রবীণ নিবাসে বসবাসের অন্তরালে কি ব্যথা লুকিয়ে থাকে প্রবীণ মানুষটির অন্তরে। আমরা কখনও এই চিন্তা করিনা যে, একদিন আমাদেরও প্রবীণের খাতায় নাম লিখাতে হবে আর একই পরিস্থিতির মুখাপেক্ষি হতে হবে।
বর্তমানে বিশ্বে মানুষের গড় আয়ু তর তর করে বাড়ছে। যার অর্থ হলো বিশ্বে প্রবীণ মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এটা প্রযোজ্য। পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রমে সফলতায় মানুষ আর আগের মতো বেশী সন্তান নিচ্ছে না। “ছেলে হোক আর মেয়ে হোক দুটি সন্তানই যথেষ্ট” বা “দুয়ের বেশী সন্তান নয়, একটি হলে ভালো হয়” এমন উদ্বুদ্ধমুলক প্রচারণার সফলতায় মানুষ এখন কম সন্তান নিচ্ছে। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতির কারণে শিশু ও মাতৃ মৃত্যুহার ব্যাপকহারে হ্রাস পেয়েছে। অন্যদিকে আধুনিক আর উন্নত চিকিৎসার সুযোগ বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষের বেঁচে থাকার পথ সুগম হয়েছে। সঙ্গত কারণেই শুধু বাংলাদেশেই নয় সারাবিশ্বে প্রবীণ মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে সারা বিশ্বে মোট জনগোষ্ঠীর শতকরা ৭ভাগ প্রবীণ। ২০৩০ সালে বিশ্বে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা দাঁড়াবে ১১.৫% এ এবং ২০৫০ সালে এই হার হবে ২১.৫%। অন্যদিকে ২০১১ সালের আদমশুমারীর হিসাব অনুযায়ী দেশের মোট জনগোষ্ঠীর শতকরা প্রায় ৮ভাগ প্রবীণ। সে হিসাবে বাংলাদেশে প্রায় ১কোটি ২০ লাখ প্রবীণ মানুষের বাস। এই ক্রমবর্ধনশীল প্রবীণ জনগোষ্ঠী অর্থনৈতিক, সামাজিক, স্বাস্থ্য, পেশা মর্যাদা, বিনোদনসহ জীবণ ধারণের নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে, যা ক্রমাগত জটিল রুপ ধারণ করছে। বিশেষজ্ঞরা ধারণা পোষণ করছেন যে, এভাবে বিশ্বে প্রবীণের সংখ্যা বাড়তে থাকলে একসময় তা যুবদের সংখ্যাকে ছাড়িয়ে যাবে।
বাংলাদেশে প্রবীণ জনগোষ্ঠী নানা সমস্যার সম্মুখিন। আমরা পত্রিকার পাতায় বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিনিয়তই দেখতে পাই দেশের বিভিন্ন স্থানে পরিবারের সদস্য কর্ত্তৃক প্রবীণ নির্যাতনের ঘটনা। পরিবারে প্রবীণের প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়ায় বা সম্পত্তি কুক্ষিগত করার জন্য প্রবীণদের উপর অবহেলা, হয়রানি ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটে থাকে। আমরা যারা প্রবীণদের উপর নির্যাতন করছি তাঁরা একবারও ভেবে দেখছি না যে, পরিবারে যে শিশুগুলো বেড়ে উঠছে তাঁরাও কিন্তু আপনার নিকট থেকে প্রবীণদের অবহেলা আর অবজ্ঞা করার শিক্ষাই লাভ করছে। আপনিও যখন প্রবীণ বয়সে উপনীত হবেন তখন আপনি আপনার পিতা-মাতা বা মুরব্বীদের উপর যে আচরণ করছেন আপনার সন্তানরাও আপনার উপর একই ধরণের আচরণ করবে। কারণ ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না। তাই অন্যেও প্রয়োজনে নয় বরং নিজের ভবিষৎ এর কথা চিন্তা করে, প্রবীণ বয়সে নিজেদের নিরাপত্তার কথা ভেবে পরিবারের প্রবীণদের প্রতি আমরা সদয় হই এবং ভবিষৎ প্রজন্মকে প্রবীণ সংবেদনশীল করে তুলি।
প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সুরক্ষার কথা চিন্তা করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ২০১৩ সালে “পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ আইন” পাশ করেছে। কোন সন্তান যদি পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ করতে না চায় তাহলে এই আইনের বলে সংক্ষুব্ধ পিতা-মাতা আদালতে মামলা দায়ের করতে পারবে। আইনে আরো বলা আছে যে, কোন সন্তান তাঁর পিতার অবর্তমানে দাদা দাদীকে এবং মাতার অবর্তমানে নানা-নানীকে ভরণ-পোষণ দিতে বাধ্য থাকবে। এই আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে ১ (এক) লাখ টাকা অর্থদন্ড বা অর্থদন্ড অনাদায়ে ৩ (তিন) মাসের কারাদন্ডের বিধান রয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো সন্তান কর্ত্তৃক কোন পিতা-মাতা লাঞ্ছিত হলে বা নির্যাতনের শিকার হলেও সব নীরবে সহ্য করে যায়। কোন পিতা-মাতাই তাঁর সন্তানের বিরুদ্ধে আদালতে যেতে চায় না। এ কারণে এই আইনে আদালতে মামলার সংখ্যাও খুবই কম।
মানুষ সৃষ্টির সেবা জীব। প্রতিটি মানুষকেই প্রবীণে উপনীত হতে হবে আবার মৃত্যুও বরণ করতে হবে। আমাদের লক্ষ্য থাকা দরকার একটি সম্মানজনক মৃত্যু। আমি যদি পরিবারের প্রবীণ পিতা-মাতা, দাদা-দাদী, নানা-নানী, প্রতিবেশী প্রবীণদের সাথে ভালো আচরণ করি, তাদের সম্মান দিই, তাদের সাথে আদবের সাথে কথা বলি, তাহলে ধরেই নেওয়া যায় যে, আমার সন্তানরা পরিবার থেকে সেই শিক্ষাই লাভ করবে। এতে প্রবীণ বয়সে আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক নিরাপত্তা বৃদ্ধি পাবে। আর এটা যদি আমরা না করতে পারি, প্রবীণদের প্রতি যদি আমরা সংবেদনশীলতার শিক্ষা লাভ ও তার প্রসার না করতে পারি তাহলে বলাই যেতে পারে যে, নচিকেতার বৃদ্ধাশ্রম গান থেকে শিক্ষা নিয়ে বৃদ্ধাশ্রমে নিজের বেডের পাশে আরো একটি বেড রেডি রাখতে হবে এটা ভেবে যে, প্রবীণ বয়সে আমারও পরিণতি হবে বৃদ্ধাশ্রমে ফেলে আসা আমার পিতা-মাতার মতোই। তাই আসুন আমরা প্রবীণের জায়গায় দাঁড়িয়ে তাদের চোখে সমাজকে দেখার চেষ্টা করি, তাইলেই প্রবীণদের প্রতি সংবেদনশীলতার প্রয়োজনীয়তা আমরা উপলদ্ধি করতে পারবো।
মো. আতাউর রহমান
উন্নয়নকর্মী ও সাংবাদিক