উন্নত জাতের গাভী পালনে স্বাবলম্বী চরাঞ্চলের মানুষ ;
রেখা মনি, নিজস্ব প্রতিবেদক
Facebook Twitter share
উন্নত জাতের গাভী পালনে স্বাবলম্বী চরাঞ্চলের মানুষ ।যুগের পর যুগ ধরে দেশি জাতের গরু লালন-পালন করে আসছিলেন কুড়িগ্রামের চরাঞ্চলের মানুষ। কিন্তু এই গরুতে তেমন লাভ হতো না।
এবার একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার সহযোগিতায় পাল্টাতে শুরু করেছে চরবাসীর জীবন। দেশি গুরুর পরিবর্তে উন্নত জাতের গরু লালন-পালনেই স্বাবলম্বী হয়ে উঠছেন তারা।
Surjodoy.com
এই বেসরকারি সংস্থার সহযোগিতায় জেলার রৌমারী ও রাজিরপুর উপজেলার চরাঞ্চলের ৩৫টি গ্রামের ৬ শতাধিক পরিবার ২০১৫ সাল থেকে উন্নত জাতের গাভী পালন শুরু করেন। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাদের। এখন প্রতিটি পরিবারে এই গাভীর দুধ থেকেই সব খরচ বাদে প্রতিদিন আয় ১ থেকে দেড় হাজার টাকা। ব্যাংক লোনের সুবিধাও পাচ্ছেন তারা।
The Daily surjodoy
জেলার রৌমারী উপজেলার বাইশপাড়া চড় গ্রামের গোলজার হোসেনের স্ত্রী ফিরোজা বেগমের (৪০) সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, আগে আমার খুব অভাব ছিল।
অন্যের বাড়িতে, জমিতে কাজ করতাম। তখন নিজেও ঠিকমতো খেতে পারি নাই, ছেলে-মেয়েদেরও খাওয়াতে পারি নাই। লেখাপড়া শেখাতে পারি নাই। পরে প্রশিক্ষণ ও ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে ৫ বছর ধরে উন্নত গাভী পালন করছি।
The Daily surjodoy
এই ৫ বছরে ১৬টি গরু হয়েছে। এরমধ্যে ৮টি বিক্রি করে দিয়েছি। প্রতিদিন নিজেরাই দুধ দোয়াই, বিক্রি করি। এখন খুব ভালো আছি। বাড়ির সবাই মিলে গরু দেখাশোনা করি। প্রতিদিন দুধ বিক্রি করে প্রায় দেড় হাজার টাকা পাই।
একই গ্রামের ৩৫ বছর বয়সী আমিনা বেগমের সঙ্গে কথা হয় তার নিজ বাড়িতে। বাড়ির উঠানে গোয়াল ঘর। সেখানে চোখে পড়ে ছোট-বড় মিলে ৯টি উন্নত জাতের গরু।
The Daily surjodoy
গরুর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ২০১৪ সাল পর্যন্ত আমাদের একটি দেশি গরু ছিল। পরে ২০১৫ সালে গণউন্নয়ন কেন্দ্রের মাধ্যমে ট্রেনিং নিয়ে দেশি গরুটি বিক্রি করে দেই। কিন্তু তাতে বিদেশি গাভী কেনা সম্ভব হয়নি।
পরে গণউন্নয়ন কেন্দ্রের সহযোগিতায় ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে কিছু টাকা লোন নিয়ে একটি উন্নত জাতের গাভী কিনে আনি। তারপর এই ৪/৫ বছরে আমাদের গরুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৪টি। এরমধ্যে ৫টি বিক্রি করে দিয়েছি। ব্যাংকের লোন পরিশোধ করে আবারও লোন নিয়েছি।
The Daily surjodoy
ব্যাংকের লোকজন প্রথমে লোন দিতে না চাইলেও এখন তারা নিজেরাই আরও বেশি টাকা লোন দিতে চাচ্ছে। এখন আমরা সুখে আছি। গরু রাখার ঘর করেছি। প্রতিদিন দুধ বিক্রি করে সব খরচ বাদ দিয়ে হাজার থেকে ১২শ টাকা রোজগার হচ্ছে।
এমন অবস্থা শুধু আমিনা বেগম ও ফিরোজা বেগমের নয়। একই অবস্থা এখন রৌমারী উপজেলার দাঁতভাঙ্গা ইউনিয়নের সালেহা বেগম, বন্দবের ইউনিয়নের আকেজন বেগমসহ শৌলমারী, রৌমারী, চর শৌলমারী ও যাদুর চর এবং রাজিবপুর উপজেলার চর রাজিবপুর, কোদালকাটি ও মোহনগঞ্জ ইউনিয়নের ৩০টি গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই। তাদের বাড়িতে ছোট-বড় মিলে উন্নত জাতের গরুর সংখ্যা ৫ থেকে ১০টি পর্যন্ত। তারা এখন অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল হয়ে উঠছেন।
The Daily surjodoy
চরাঞ্চলের এসব পরিবারের ভাগ্য বদল হতে দেখে উন্নত জাতের গরু পালনে আগ্রহী হয়ে উঠছেন পার্শ্ববর্তী চরের মানুষ। কিন্তু বেশি দাম দিয়ে গরু কেনার সামর্থ নেই অনেকের।
এ অবস্থায় জেলার সাড়ে ৪ শতাধিক চরাঞ্চলের দরিদ্র পরিবারকে সহজ শর্তে লোন দিয়ে উন্নত জাতের গাভী পালনে সহায়তা করা গেলে একদিকে যেমন থাকবে না দারিদ্রতা, অন্যদিকে দেশে দুধ ও মাংসের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
The Daily surjodoy
তবে এসব এলাকায় কোনো চিলিং সেন্টার না থাকায় দুধ বিক্রিতে তাদের কিছুটা বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। আর দুধ বিক্রির এ সমস্যা সমাধান করতে প্রতি গ্রামেই তারা নিজেরাই মিল্ক কালেকশন সেন্টার তৈরি করেছেন। সেখানে গ্রামের পুরো দুধ জমা হলে পরে সেই দুধ বাজারে বিক্রি করে গরুর মালিকদের টাকা পরিশোধ করা হয়। এতে প্রতিলিটার দুধে ৫ টাকা করে কমিশন দিতে হয় দুধ কালেকশন সেন্টারকে।
চরের বাসিন্দা গোলজার হোসেন ও সালমা বেগম দাবি করেন, রৌমারীতে একটি চিলিং সেন্টার হলে তারা দুধ বিক্রি করে আরও লাভবান হতে পারবেন। চিলিং সেন্টার না থাকায় এখন শুধু হোটেলসহ কিছু দুধ ক্রেতার কাছে কম দামে দুধ বিক্রি করতে হচ্ছে তাদের।
The Daily surjodoy
গণউন্নয়ন কেন্দ্রের রিকল প্রকল্পের প্রকল্প সমন্বয়কারী মো. মুনির হোসেন বলেন, এখানকার চরাঞ্চলের মানুষ জন্মগতভাবেই কঠোর পরিশ্রমী। রৌমারী ও রাজিবপুর উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের মানুষকে উন্নত জাতের গাভী পালনে উদ্বুদ্ধ করতে কাজ শুরু করি। এজন্য তাদের সমস্যাগুলো নির্ণয় করে দেশি গরুর পরিবর্তে উন্নত জাতের গাভী পালনে উদ্বুদ্ধ করে তুলতে এবং স্বাবলম্বী হওয়ার ব্যাপারে ট্রেনিংসহ নানাভাবে উৎসাহিত করে তোলা হয়েছে।
The Daily surjodoy
গণউন্নয়ন কেন্দ্র তাদের গ্রান্টার হয়ে ব্যাংক লোনের ব্যবস্থাও করে দিয়েছে। এভাবেই রৌমারী ও রাজিবপুর উপজেলার ৯ ইউনিয়নের ৩০টি গ্রামের ৬ শতাধিক পরিবার উন্নত জাতের গাভী পালন করছে। তারা কেনা ফিডের পাশাপাশি চরের ঘাস খাওয়াচ্ছে। নিজেরাই গাভীর দুধ দোয়াচ্ছে। মিল্ক কালেকশন সেন্টারে দিয়ে আসছে। এতে করে প্রতিদিনই তারা দুধ বিক্রি করে আয় করতে পারছে। তারা অনেকটাই স্বাবলম্বী হয়ে উঠছে।
The Daily surjodoy
রৌমারী উপজেলা চেয়ারম্যান শেখ আব্দুল্লাহ্ বলেন, যুগের পর যুগ ধরে অবহেলিত চরাঞ্চলের মানুষ এখন উন্নত জাতের গাভী পালন করে স্বস্তি ফিরে পেয়েছে। তাদের প্রতিদিনের আয়ের উৎস তৈরি হয়েছে। আমি নিজেও চরাঞ্চলগুলো ঘুরে দেখেছি। আমার ভালো লেগেছে। সঠিক মূল্যে তাদের দুধ বিক্রির জন্য চিলিং সেন্টার স্থাপন করা জরুরি। আমি এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বিভাগের সাথে যোগাযোগ করবো।
The Daily surjodoy
এ ব্যাপারে জেলা প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তা মো. আব্দুল হাই সরকারের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার পাশাপাশি জেলার চরাঞ্চলগুলোতে উন্নত জাতের গবাদি পশু পালন বৃদ্ধির এবং তাদের উৎপাদিত পণ্যের নিশ্চিত বিপণনে কাজ করছে প্রাণি সম্পদ বিভাগ। বিশেষ করে রৌমারী ও রাজিবপুরের চরাঞ্চলে উৎপাদিত দুধ কেনার জন্য একটি চিলিং সেন্টার স্থাপনের জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে।
Leave a Reply