দেশের অন্যতম বৃহত্তম শিল্পপ্রতিষ্ঠান প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ, স্কয়ার ডেনিমস লিমিটেড, স্কয়ার টেক্সটাইল, তাফরিদ কটন মিলস, সিপি বাংলাদেশ লিমিটেডের মতো বড় বড় প্রতিষ্ঠানের কারখানা বা উৎপাদনকেন্দ্র গড়ে উঠেছে শায়েস্তাগঞ্জের অলিপুরে। এখানে জমি কিনেছে রূপায়ন গ্রুপ, বাদশা গ্রুপসহ অনেক শিল্পগোষ্ঠী।
ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশেই শিল্প-কারখানাগুলো স্থাপন করায় সারাদেশের সঙ্গে সহজেই যোগাযোগ করতে পারছে প্রতিষ্ঠানগুলো। বিভিন্ন শিল্প-কারখানা গড়ে ওঠায় সুফল পাচ্ছেন হবিগঞ্জ জেলার মানুষ। পুরো উপজেলায় কমেছে বেকারত্ব সমস্যা,স্বাবলম্বী হয়েছেন হাজারো মানুষ।
শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ ২০১১ সালে শায়েস্তাগঞ্জের অলিপুরে ৭৫০ বিঘা জমির ওপর গড়ে তোলে হবিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক। উৎপাদনে যায় ২০১৩ সালে। ২০১৪ সালে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত এ শিল্প-কারখানার উদ্বোধন করেন।
কারখানায় বর্তমানে ফ্রুট ড্রিংকস,বেভারেজ,ক্যান্ডি, লিকুইড গ্লুকোজ,বিস্কুট,কনফেকশনারি, ক্যাবলস, ফ্যান, মেলামাইন,বাইসাইকেল,এমএস ও জিআই পাইপ, টয়লেট্রিজসহ ৪৪টি উৎপাদন লাইনে বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী উৎপাদন করা হচ্ছে।
অলিপুরে গড়ে ওঠা প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের হবিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক প্রায় ২২ হাজার নারী-পুরুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিয়েছে। এখানকার উৎপাদিত পণ্য বর্তমানে বিশ্বের ১৪২টি দেশে রফতানি হচ্ছে।
হবিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) হাসান মো.মঞ্জুুরুল হক বলেন,অলিপুরে গড়ে ওঠা প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের হবিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক প্রায় ২২ হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে। এখানে কর্মরত লোকবলের ৮০ শতাংশই স্থানীয়। কর্মসংস্থানের পাশাপাশি শায়েস্তাগঞ্জ এলাকায় উন্নত শিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারণেও কাজ করছে গ্রুপটি। আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসহ কারখানার পাশেই প্রাণ-আরএফএল পাবলিক স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।’
তিনি বলেন,পরিবেশ দূষণরোধে আমাদের চারটি ইটিপি (বর্জ্য শোধনাগার) রয়েছে। ইটিপির মাধ্যমে পানি শোধন হয়ে নদীতে যাচ্ছে। আমরা বাংলাদেশে প্রথম একটা উদ্যোগ নিচ্ছি ইটিপির পানি শোধন করে নিজেরাই ব্যবহার করব।
অন্যদিকে অলিপুরেই ২০১৩ সালে স্কয়ার গ্রুপ ডেনিম কাপড় উৎপাদনের জন্য কারখানা নির্মাণকাজ শুরু করে। ২৯৪ বিঘা জমির ওপর নির্মিত স্কয়ার ডেনিম কারখানা ও স্কয়ার টেক্সটাইল। এখন পর্যন্ত কারখানাটিতে স্কয়ার গ্রুপ বিনিয়োগ করেছে প্রায় চারশ কোটি টাকা।
কারখানাটিতে বর্তমানে এইচঅ্যান্ডএম,নেক্সট,সিঅ্যান্ডএ, স্পিরিটসহ বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ড ও খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের জন্য ডেনিম কাপড় প্রস্তুত করছে স্কয়ার ডেনিম।
এ ব্যাপারে স্কয়ার ডেনিমস লিমিটেডের এজিএম (প্রশাসন) মাহমুদ হোসেন বলেন,মূলত বিদেশি ক্রেতারা প্রথমে ডেনিম কাপড় পছন্দ করে। পরে সেই কাপড়ে বাংলাদেশি কারখানায় জিন্স প্যান্ট,জ্যাকেট তৈরি হয়। এগুলো রফতানি হয় বিভিন্ন দেশে।
এসব শিল্পকারখানায় কর্মসংস্থানের সুযোগ থাকায় অশিক্ষিত নারী-পুরুষরাও এখন চাকরি করে জীবনযাপন করছেন। একসময়ের প্রত্যন্ত অঞ্চল এখন ধীরে ধীরে হয়ে উঠছে শিল্পনগরী। শিল্পায়নের সুবাদে এ এলাকার মানুষ চাকরি ছাড়াও নানারকম ব্যবসা-বাণিজ্য করে স্বাবলম্বী হয়ে উঠছেন। মালামাল সরবরাহের ঠিকাদারি, ওয়েস্টেজ, কাঁচামাল, ট্রান্সপোর্ট এজেন্সিসহ হরেক রকমের ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন স্থানীয় লোকজন।
শায়েস্তাগঞ্জের বাইরে থেকে যারা এসে এখানকার বিভিন্ন অঞ্চলে চাকরি করছেন,তারা সপরিবারে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকেন আশপাশে। এ সুবাদে গ্রামাঞ্চলের মানুষও বাড়ি ভাড়া দিয়ে আয়ের সুযোগ পাচ্ছেন।
কর্মসংস্থানের সুযোগ থাকায় এলাকার তরুণদেরও বেকারত্ব ঘুচছে। ফলে তাদের বিপথগামী হওয়ার শঙ্কায় ভুগতে হচ্ছে না অভিভাবকদের। সেজন্যই এ এলাকায় চুরি, ছিনতাই, মাদক গ্রহণ অনেকটা নেই বললেই চলে।
অন্যদিকে এলাকায় শিল্পকারখানা গড়ে ওঠায় কমেছে কৃষির উৎপাদন। কৃষিকাজে অনীহা দেখা দিচ্ছে সাধারণ মানুষের। কৃষিকাজে বিনিয়োগ না করে এলাকাবাসী বিনিয়োগ করছেন অন্যখাতে। জায়গা-জমি বিক্রি করে বাসিন্দারা ব্যাংকে নির্দিষ্ট মেয়াদে টাকা রেখে এর লভ্যাংশ নিচ্ছেন।
এদিকে শিল্পায়নের ফলে এলাকার জমির দাম বেড়েছে শতকপ্রতি পাঁচ থেকে সাতগুণ। যারা জমি কিনে বিনিয়োগ করেছেন তারা অনেক লাভবান হয়েছেন। শিল্পায়নের ছোঁয়ায় এলাকায় বেড়েছে কোটিপতিরও সংখ্যা।
কেউ জমি বিক্রি করে, কেউ জমি কেনাবেচায় মধ্যস্থতা করে, আবার কেউ কেউ ব্যবসা-বাণিজ্য করে লাখপতি থেকে হয়ে গেছেন কোটিপতি। এসব শিল্পকারখানা দেশের অর্থনীতিতে রাখছে বড় ভূমিকা।
এ বিষয়ে হবিগঞ্জ-লাখাই-শায়েস্তাগঞ্জ (হবিগঞ্জ-৩) আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আলহাজ অ্যাডভোকেট মো. আবু জাহির বলেন,আমি জাতীয় সংসদে অসংখ্যবার প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর হবিগঞ্জে বিনিয়োগ করার জন্য আহ্বান জানিয়েছি। হবিগঞ্জে প্রচুর পরিমাণে গ্যাস ও বিদুৎ মজুত রয়েছে, যা শিল্পকারখানা করার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
তিনি আরও বলেন,হবিগঞ্জে কৃষিজমির দাম কম। এসব বিষয় আমি সংসদে তুলে ধরার ফলে দেশের বড় বড় শিল্পপতিরা শায়েস্তাগঞ্জসহ হবিগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলায় তাদের প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। এতে শিল্পায়নের সুফল পাচ্ছে হবিগঞ্জের মানুষ। স্থানীয়রা যেমন চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য করে স্বাবলম্বী হয়েছেন,তেমনি অন্য জেলার মানুষও এর সুফল পাচ্ছেন