হুমায়ুন কবির: করোনা থেকে বাঁচতে মানুষকে বেশিরভাগ সময় থাকতে হচ্ছে গৃহবন্দি। গৃহবন্দি অবস্থায় গৃহবিবাদও বাড়ছে সমানতালে। ফলে ঘটছে বিয়েবিচ্ছেদের ঘটনা। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত জুলাই মাসে ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটিতে গড়ে ৫১টি বিয়েবিচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে। কোভিড-১৯ সংকটের মধ্যে বিয়েবিচ্ছেদ বৃদ্ধির অর মধ্যেন্যতম কারণ হিসেবে বাধ্যতামূলক নৈকট্যকেই দায়ী করা হচ্ছে।
বিষয়টি ‘উদ্বেগের’ উল্লেখ করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাধ্যতামূলক ঘরবন্দি জীবন মানুষের মধ্যে মানসিক চাপ ও উত্তেজনা ছড়াচ্ছে। এ অবস্থায় বিবাদে জড়িয়ে পড়ছে। ফলে বাড়ছে বিচ্ছেদ। আপসে অনীহা, সমাধান খুঁজে বের করার অনিচ্ছা, এমনকি ধৈর্যধারণের ক্ষমতা কমে যাওয়ায় বাড়ছে ডিভোর্স। বিয়েবিচ্ছেদ সমর্থনযোগ্য না হলেও বাধ্য হয়ে তা করেছেন একটি বেসরকারি কোম্পানিতে কর্মরত রেফাত (ছদ্মনাম)। বাবা-মায়ের পছন্দে দেড় বছর আগে বিয়ে করেন সদ্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা সুমিকে (ছদ্মনাম)। বিয়ের পর মাসখানেক ভালো সময় কাটালেও এরপর একটু একটু করে শুরু হয় ঝামেলা। পরস্পরের মতের অমিল চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে লকডাউনে সারাদিন একসঙ্গে থাকতে গিয়ে। একপর্যায়ে দুজনেই অতিষ্ঠ হয়ে সিদ্ধান্ত নেন ডিভোর্সের। পরিবারের সমর্থনেই সুমি ডিভোর্স দেন রেফাতকে।
দীর্ঘ প্রেমের পরিণতি বিয়েও ভেঙে গেছে এ লকডাউনের মধ্যে। এমনই এক দম্পতি ছিলেন ফারজানা (ছদ্মনাম) ও ফয়সাল (ছদ্মনাম)। ৮ বছর প্রেমের সম্পর্কের পর বছর দু-এক আগে তারা বিয়ের পিঁড়িতে বসেন। দুজনই চাকরিজীবী। শুরুর এক বছর কাটে স্বপ্নের মতো। কিন্তু দ্বিতীয় বছর থেকেই বাধে বিপত্তি। লকডাউনের গত ৪ মাস একসঙ্গে থাকতে গিয়ে বুঝতে পারেন তারা আসলে ভিন্ন মেরুর। ছোট ছোট অমিল এই সময়ে রূপ নেয় বড় আকারে। এরপর জুলাই মাসে উভয়েই সিদ্ধান্ত নেন ডিভোর্সের।
শুধু রেফাত বা ফারজানা নয়, এমন বিচ্ছেদের ঘটনা এখন অনেক ঘটেছে। এর কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, হঠাৎ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মানুষের জীবনাচরণেই পরিবর্তন এসেছে। দেখা দিচ্ছে অস্থিরতা, অসিষ্ণুতা। কবে এ থেকে মুক্তি মিলবে, তাও জানা নেই কারও। ফলে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ ভাবনা মানুষের মেজাজকে করে তুলছে খিটখিটে। এর প্রভাব পড়ছে পরিবারের সদস্যদের ওপরে।
২০১৯ সালের জুলাই মাসে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় ডিভোর্সের ঘটনা ঘটেছে ৫৬৩টি। আগস্টে ৫৪৫টি। সেপ্টেম্বরে ৫৪১টি। অক্টোবরে ৮২০টি। নভেম্বরে ৪৫৩টি। ডিসেম্বরে ৪৯৮টি। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে বিচ্ছেদ হয় ৫২৮টি, ফেব্রুয়ারিতে ৪৫২টি, মার্চে ৪৯২টি। এপ্রিলে অফিস-আদালত বন্ধ থাকায় এ মাসে তালাকের সংখ্যা শূন্য। মে মাসে ১১৩টি, জুনে ৪৪১টি এবং জুলাইয়ে সর্বোচ্চ ৮৭৮টি বিয়েবিচ্ছেদের ঘটনা ঘটে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ১ হাজার ৫১৪টি তালাকের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ৬১৮টি, ফেব্রুয়ারিতে ৪৪১ ও মার্চে ৪৫৫টি। এপ্রিলে কোনো তালাক কার্যকর হয়নি। মে-তে ৫৪টি, জুনে ৬৩২টি ও জুলাইয়ে ৬৫৪টি তালাকের ঘটনা ঘটেছে।
দিন দিন বিচ্ছেদের এই মাত্রা বৃদ্ধির কারণ হিসেবে লিঙ্গবৈষম্যকে দায়ী করেছেন ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট মো. মাহবুবুর রহমান। তার মতে, স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে অনেক সময় পার করলে তিক্ততা নয়, বরং ভালোবাসা বাড়ার কথা। কিন্তু এমন কিছু বিষয় রয়েছে যেটা ভালোবাসা না বাড়িয়ে বরং তিক্ততা বাড়াচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো লিঙ্গবৈষম্য।
মাহবুবুর রহমানের ভাষায়- আমরা যতই শিক্ষিত হই না কেন, লিঙ্গ সমতা সম্পর্কে আমাদের পর্যাপ্ত এবং স্বচ্ছ ধারণা নেই। লকডাউনের সময় নারীর কাজের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে করোনাকালীন অন্য মানসিক চাপ নারী-পুরুষ উভয়ের সমানভাবে আছে। তাই খিটখিটে মেজাজ তৈরি হচ্ছে, সহমর্মিতা বোধ হারাচ্ছে, পারস্পরিক বোঝাপড়ার জায়গায় ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। আমাদের ইগোর জায়গায় কেউ কাউকে ছাড় দিচ্ছি না। আমরা খুব দ্রুত ঝামেলা থেকে মুক্তির জন্য আলাদা হয়ে যাচ্ছি।
লকডাউনের কারণে কর্মজীবী স্বামী-স্ত্রী দীর্ঘদিন একই সঙ্গে থাকছে। এ সময় নানা কারণে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মতের অমিল দেখা দিচ্ছে; একে-অন্যের দোষ-ত্রুটিগুলো প্রকট হয়ে ধরা পড়ছে। অনেকে নিজেদের সময় দেওয়ার চেয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশি সময় দিচ্ছে। এতে করে উভয়পক্ষই কোনো না কোনোভাবে নিজেদের ভালোবাসার অনুভূতির জায়গাগুলো হারিয়ে ফেলছে। শ্রদ্ধাবোধ কমে যাচ্ছে। পরনারী বা পরপুরুষে আকৃষ্ট হচ্ছে। সেখান থেকেও বাড়ছে ডিভোর্স।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শাহ এহসান হাবীব বলেন, কেভিড-১৯ এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করেছে যেখানে স্বামী-স্ত্রী গৃহবন্দিত্ব নিতে বাধ্য হচ্ছে। একে অপরকে প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় সব রকমের সময়ই দিচ্ছে। সম্পর্কের অনেক ডাইমেনশন থাকে উল্লেখ করে এ সমাজবিজ্ঞানী বলেন, একে অপরের কাছে সঙ্গীরা যখন অনেক বেশি এভেইলঅ্যাবেল হয়ে যায় তখন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয় নিয়েও বিতর্কের সৃষ্টি হয়।
কোভিডের মধ্যে মানুষের অর্থনৈতিক চাপটাও বিচ্ছেদের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করেন শাহ এহসান হাবীব। তার মতে, এখন মানুষের আয় নেই। মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত যারা রয়েছে তারা এতদিন একভাবে চলে এলেও হুট করে এ পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারছে না। সে ক্ষেত্রে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মাঝে দেখা দিচ্ছে একটি বড় ব্যবধান। এই ব্যবধানটা মেনে নিতে না পারায় বাড়ছে বিচ্ছেদ।
আবার করোনার কারণে অন্য দেশের মানুষ প্রশান্তির জন্য পরিবারের সদস্যদের নিয়ে নিজস্ব যানবাহনে করে একটু বাইরে থেকে বেরিয়ে আসতে পারলেও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সেটা সম্ভব নয়। এ থেকেও ঘরবন্দি একঘেয়ে জীবনে সৃষ্টি হচ্ছে মানসিক চাপ, বাড়ছে কলহ।
শহুরে মানুষের আলাদা একটা জগৎ থাকে উল্লেখ করে তিনি বলেন, গ্রামের মানুষের পারিবারিক বন্ধনটা অনেক বেশি দৃঢ় হলেও শহুরে পরিবারগুলোয় তা না। গ্রামে সম্পর্কগুলোর ক্ষেত্রে মানুষ অনেক বেশি দায়বদ্ধ। সেখানে সবসময় আত্মীয়স্বজন যাওয়া-আসার মধ্যে থাকে। ফলে পারিবারিক কলহের সুযোগটাও কম। যা শহুরে জীবনে দেখা যায় না। শহুরে মানুষের আলাদা একটা জগৎ থাকে। সেখানে সবাই নিজের মতো করে থাকতে পছন্দ করে। সেখান থেকেও বাড়ছে বিচ্ছেদের ঘটনা।
সর্বোপরি মানুষের মাঝে অসহিষ্ণুতা ও কাউকে ছাড় না দেওয়ার প্রবণতাই বিয়েবিচ্ছেদের কারণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
প্রতিষ্ঠাতা : মেজর (অব) মোঃ মোদাচ্ছের হোসাইন, সম্পাদক মন্ডলির সভাপতি: বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুজ্জামান আহমেদ এমপি, ব্যবস্থাপনা সম্পাদক: তৌহিদ আহমেদে রেজা, বার্তা সম্পাদক: আসমা আহমেদ কর্তৃক ৫৪ কামাল আতাতুর্ক এভিনিউ সৈয়দ ভবন, ঢাকা-১২১৩ থেকে সম্পাদিত ও প্রকাশিত
© All rights reserved 2020 Daily Surjodoy