নিজস্ব প্রতিবেদক:
করোনাভাইরাস সংক্রমণের পাঁচ মাস পরও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশিদের মৃত্যু হচ্ছে। যদিও জুন ও জুলাই মাসের তুলনায় তা কমেছে। গতকাল শনিবার পর্যন্ত সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্য সহযোগিতা সংস্থার (জিসিসি) ছয় দেশে করোনাভাইরাসে মারা গেছেন এক হাজার ১৭০ জন বাংলাদেশি। এর মধ্যে শুধু সৌদি আরবেই মারা গেছেন ৭৮৮ জন বাংলাদেশ। অন্যদিকে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের অন্য ১৪ দেশে ৬৫৯ জন বাংলাদেশি মারা গেছেন। অর্থাৎ এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসের সংক্রমণে ২০ টি দেশে মারা গেছেন এক হাজার ৮২৯ জন।
জিসিসির ছয় সদস্য দেশ সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, কাতার, ওমান ও বাহরাইন চিরাচরিতভাবে বাংলাদেশের অভিবাসীদের প্রধান গন্তব্য। মধ্যপ্রাচ্যের ছয় দেশে প্রবাসী কর্মী, প্রবাসী বাংলাদেশিদের সংগঠন ও বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, শনিবার পর্যন্ত সৌদি আরবে ৭৮৮ জন, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ১৭৫ জন, কুয়েতে ১০০ জন, ওমানে ৫৫ জন, কাতারে ৩২ জন ও বাহরাইনে ২০ জন বাংলাদেশি করোনাভাইরাসের সংক্রমণে মারা গেছেন।
প্রবাসী বাংলাদেশি, অভিবাসী ও কূটনীতিকেরা জানিয়েছেন, গাদাগাদি করে ডরমিটরিতে কর্মীরা থাকতে বাধ্য হন। আবার যে সব জায়গায় কর্মীরা কাজ করেন সেখানে লোক সমাগম বেশি। এর পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধি অগ্রাহ্য করা মৃত্যুর কারণ। তা ছাড়া করোনাভাইরাসে মারা যাওয়া লোকজনের একটি বড় অংশের নানা ধরনের শারীরিক সমস্যা ছিল।
সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কুয়েত এই তিন দেশের দূতাবাসের কর্মকর্তারা এই প্রতিবেদককে জানান, করোনাভাইরাসে মারা যাওয়া লোকজনের অধিকাংশই ভর্তি হয়েছিলেন হৃদ্রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিক, কিডনি রোগসহ নানান শারীরিক জটিলতায়। ভর্তির পরে অনেকের করোনা শনাক্ত হয়। আবার কারও কারও শনাক্ত হয় আগেই।
যুক্তরাজ্যে ৩২৫ জন, যুক্তরাষ্ট্রে ২৮২ জন, ইতালিতে ১৪ জন, কানাডায় ৯ জন, সুইডেনে ৮ জন, ফ্রান্সে ৭ জন, স্পেনে ৫ জন, পর্তুগাল ২, দক্ষিণ আফ্রিকা ২ এবং ভারত, মালদ্বীপ, কেনিয়া, লিবিয়া, ও গাম্বিয়ায় ১ জন করে বাংলাদেশি মারা গেছেন। অর্থাৎ ওই ১৪ দেশে ৬৫৯ জন বাংলাদেশি করোনাভাইরাসের সংক্রমণে মারা গেছেন।
তবে করোনাভাইরাসের সংক্রমণে মৃত্যুর সংখ্যা কিছুটা কমলেও বাংলাদেশে জনশক্তির মূল বাজার সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে জীবিকার বিষয়টি মূল সংকট হয়ে দেখা দিয়েছে।
জেদ্দায় বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল ফয়সাল আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, জুন বা জুলাইয়ের সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে সৌদি আরবে করোনাসংক্রমণের পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। যদিও সারা দেশে এখনো লকডাউন চলছে। তবে বাংলাদেশের নাগরিক বিশেষ করে অভিবাসীদের জন্য জীবিকার এক ধরনের অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। তেলের দরপতনের ফলে এখানকার অর্থনীতিতে ধাক্কা লেগেছে। ফলে জীবন নির্বাহের খরচ বেড়ে গেছে। করোনাসংক্রমণের পর অর্থনীতিতে নতুন করে ধাক্কা লেগেছে। ফলে লোকজনের কাজে সুযোগ সীমিত হচ্ছে। উড়োজাহাজ চলাচল বন্ধ থাকলেও এরই মধ্যে বিশেষ ব্যবস্থা আকাশপথে চলাচল হচ্ছে। এরই মধ্যে অন্তত ৩০ হাজার বাংলাদেশি দেশে ফিরে গেছেন। আরও অনেকেই ফিরে যেতে চাচ্ছেন। আকাশপথে পুরোদমে চলাচল শুরু হলে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশি দেশে ফিরে যেতে পারেন।
সৌদি আরব থেকে কত বাংলাদেশি ফিরতে পারেন জানতে চাইলে তিনি জানান, রিয়াদে সাবেক রাষ্ট্রদূত গোলাম মসিহ সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে প্রায় দুই থেকে তিন লাখ লোক দেশে ফিরতে পারেন বলে পূর্বাভাষ দিয়েছিলেন।
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন সংযুক্ত আরব আমিরাতের একটি নির্মাণ প্রতিষ্ঠানে কর্মরত মোস্তফা আলী। সুস্থ হওয়ার পর তাঁর সব দুশ্চিন্তা চাকরি থাকা না থাকা নিয়ে। তিনি গত শুক্রবার গণমাধ্যমকে বলেন, কয়েক লাখ টাকা খরচ করে এসেছি। করোনার ছোবল থেকে মুক্ত হয়ে যখন শুনি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে অনেকের চাকরি থাকবে না, তখন তো চোখের সামনে রাজ্যের অন্ধকার নেমে আসে।
বাহরাইনের পরিস্থিতিটা সৌদি আরব আর সংযুক্ত আরব আমিরাতের ঠিক উল্টো। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সিঙ্গাপুরসহ যে কয়টি দেশ সাফল্য দেখিয়েছে বাহরাইন তার অন্যতম। এখন পর্যন্ত ১৭ লাখ জনসংখ্যার দেশটিতে ১১ লাখ মানুষের করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। আর সুস্থতার হার ৯৩ শতাংশ।
বাহরাইনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মো. নজরুল ইসলাম গতকাল বলেন, সেপ্টেম্বর থেকে এখানে সবকিছু পুরোদমে চালু হবে। যদিও এখন পর্যন্ত মসজিদ, পার্ক, রেস্তোরাঁ সবই বন্ধ। অবশ্য দেশটিতে শুরু থেকে এখন পর্যন্ত কখনোই লকডাউন ছিল না। শুধু যে সমস্ত জায়গায় নানা ধরনের অবকাঠামো তৈরির কাজ চলছিল তা পুরোপুরি বন্ধ ছিল। এখন তা খুলে দেওয়া হচ্ছে। তা ছাড়া বাহরাইনের রাজা সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা অন্যান্য দেশের অভিবাসী কর্মীর মতো বাংলাদেশের অনিয়মিত কর্মীরাও নিয়মিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশটিতে এখন প্রায় দুই লাখ বাংলাদেশি অভিবাসী রয়েছেন। যাদের মধ্যে অন্তত ৪৫ হাজার অনিয়মিত হয়ে আছেন নানা কারণে। সাধারণ ক্ষমার সুযোগ নিয়ে এদের বড় অংশ আবার দেশটিতে অন্তত এক বছরের জন্য থাকার সুযোগ পেতে যাচ্ছেন।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর তুলনায় সিঙ্গাপুরের পরিস্থিতি একেবারেই আলাদা। দেশটিতে বিপুল সংখ্যায় বাংলাদেশি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলেও একজনও মারা যাননি। ব্যাপক হারে ডরমিটরিতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঘটেছিল। তা ছাড়া জীবিকা নিয়ে তেমন শঙ্কা না থাকলে হঠাৎ করে নানা কারণে দেশে ফেরা নিয়ে এক ধরনের মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন সেখানকার বাংলাদেশের কর্মীরা।
গত ১০ বছর ধরে সেখানকার শিপইয়ার্ডে কর্মরত এক ব্যক্তি বলেন, আমি যথারীতি আগের নিয়মেই বেতন-ভাতা সবকিছু পাচ্ছি। এটা ঠিক যে আগের গতিতে কাজ শুরু না হওয়ায় ওভারটাইম কমে গেছে। তবে পরিস্থিতি এমন নয় যে, আমার বেতন কমে গেছে। তবে কোথাও কোথাও কেউ নিজেদের বেতন কমার কথা বলছেন। তবে যে প্রতিষ্ঠানগুলো দেউলিয়া হয়ে পড়েছে সিঙ্গাপুর সরকার তাদের কর্মীদের অন্য প্রতিষ্ঠানে বদলি করার নির্দেশ দিয়েছে। এটি বাংলাদেশের কর্মীদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি করেছে। তা ছাড়া করোনার কারণে অনেক দিন আটকে থাকা এসব মিলিয়ে অনেকেই দেশে ফিরতে চাচ্ছেন। তবে সিঙ্গাপুরের পরিস্থিতি এমন খারাপ হয়নি যে দেশে ফিরতে হবে।
প্রতিষ্ঠাতা : মেজর (অব) মোঃ মোদাচ্ছের হোসাইন, সম্পাদক মন্ডলির সভাপতি: বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুজ্জামান আহমেদ এমপি, ব্যবস্থাপনা সম্পাদক: তৌহিদ আহমেদে রেজা, বার্তা সম্পাদক: আসমা আহমেদ কর্তৃক ৫৪ কামাল আতাতুর্ক এভিনিউ সৈয়দ ভবন, ঢাকা-১২১৩ থেকে সম্পাদিত ও প্রকাশিত
© All rights reserved 2020 Daily Surjodoy