আমিনুল হক, নিজস্ব প্রতিবেদকঃ
কুমিল্লার ঘটনায় মূল সন্দেহভাজন শনাক্ত
দেশের বিভিন্ন এলাকায় পূজামণ্ডপ, মন্দির ও সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ওপর একের পর এক হামলার যেসব ঘটনা ঘটছে, তার সূত্রপাত কুমিল্লা থেকে। সেখানে কারা কীভাবে ভূমিকা রেখেছিল, তার আদ্যোপান্ত বের করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার বিশেষ টিম কুমিল্লায় রয়েছে। একটি দায়িত্বশীল সূত্র গতকাল সমকালকে জানায়, ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে যে ব্যক্তি মন্দিরে ঢুকেছিল, তার নাম-পরিচয় সম্পর্কে সুস্পষ্ট তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা। তার বাড়ি কুমিল্লায়। ঘটনার পর থেকে সে পলাতক।
এদিকে গাজীপুরের কাশিমপুরে বিভিন্ন মন্দিরে যারা হামলার নেপথ্যে ভূমিকা রেখেছিল, তাদের শনাক্ত করা গেছে বলে দাবি করেছে স্থানীয় প্রশাসন। তদন্ত-সংশ্নিষ্টরা বলছেন, কুমিল্লার ঘটনার জের ধরে পোশাক শ্রমিকদের কৌশলে রাস্তায় নামিয়ে মন্দির ভাঙচুর করতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে লুৎফর রহমান, সাইফুল ইসলাম ও রবিউল হাসান নামে তিন ব্যক্তি। তারা জামায়াত-শিবিরের নেতা।
কুমিল্লার ঘটনার বিষয়ে ওই সূত্র আরও জানায়, যেখান থেকে ধর্মীয় গ্রন্থ সংগ্রহ করে মন্দিরে নেওয়া হয়েছিল, সেই তথ্য গোয়েন্দাদের হাতে এসেছে। এখন ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ ওই ব্যক্তিকে খুঁজছে দেশের সব গোয়েন্দা সংস্থা। সংশ্নিষ্টরা বলছেন, ওই ব্যক্তিকে ধরা গেলে তাকে কারা ব্যবহার করছে, তাদের নাম-পরিচয়ও জানা যাবে।
গতকাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, কুমিল্লার ঘটনার ব্যাপারে খুব শিগগিরই জানা যাবে। আমরা খুব কাছাকাছি রয়েছি। কুমিল্লার ঘটনাটি উদ্দেশ্যমূলকভাবে সাজানো হয়েছে।
র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন্স) কর্নেল কে এম আজাদ সমকালকে বলেন, কুমিল্লা থেকে যেহেতু সহিংসতার সূত্রপাত, তাই সেখানে কারা কীভাবে এর সঙ্গে জড়িত তা বের করার বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এরই মধ্যে এমন দুই-একজনকে শনাক্ত করেছি, যাদের ধরতে পারলেই অনেক রহস্য উন্মোচিত হবে। আমরা সেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক আরও বলেন, পীরগঞ্জের ঘটনা নিয়েও আমরা কাজ করছি। যে যুবকের আইডি ব্যবহার করে ওই পোস্ট দেওয়া হয়, তাকে খোঁজা হচ্ছে। কেউ তার নাম-পরিচয় ব্যবহার করে আইডি খুলে এটা করেছে, নাকি সে নিজেই এর সঙ্গে সম্পৃক্ত- তাকে পাওয়া গেলে জানা যাবে।
গত দুই-তিন দিন সরকারের দায়িত্বশীল পর্যায় থেকে বলা হচ্ছে, কুমিল্লার ঘটনার মূল হোতারা অল্প সময়ের মধ্যে শনাক্ত হবে। তদন্তে কী ধরনের অগ্রগতি রয়েছে যে তারা এতটা আশাবাদী- এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তদন্তসংশ্নিষ্ট একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানান, কুমিল্লায় মাঠ পর্যায়ে যে ব্যক্তি অপ্রীতিকর ঘটনাটি ছড়িয়ে একটি সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়ানোর ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে, তার ব্যাপারে এক ধরনের তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে। এর সপক্ষে সিসিটিভির ফুটেজসহ আরও কিছু আলামত রয়েছে। তবে নেপথ্যে থেকে তাকে কারা ব্যবহার করেছে, তাদের শনাক্ত করার বিষয় এখন গুরুত্ব সহকারে নিয়েছেন গোয়েন্দারা।
এদিকে কাশিমপুরের ঘটনায় মুখ্য ভূমিকা পালনকারী লুৎফর রহমান, সাইফুল ইসলাম ও রবিউল হাসানের গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জ। লুৎফর ও সাইফুল গাজীপুরে একটি পোশাক কারখানার স্টোরকিপার। রবিউল একই কারখানার ডেসপাচ শাখায় কাজ করে। ১৩ অক্টোবর রাতে তারা তিনজন কারখানার চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ, অষ্টম ও দশম তলায় উপস্থিত হয়ে উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়ে শ্রমিকদের বিক্ষুব্ধ করে তোলে। ধর্মকে অবমাননার বিষয়ে উত্তেজিত বক্তব্য দিয়ে পরদিন সকালে শ্রমিকদের মিছিলে অংশ নেওয়ার কথা জানায়। পরদিন সকাল ৬টার দিকে শ্রমিকদের সংগঠিত করে মিছিল নিয়ে কাশিমপুর থানাধীন পূজামণ্ডপের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। মিছিলে অংশ নেওয়া কিছু লোক আশপাশের দোকান থেকে লাঠি ও বাঁশ সংগ্রহ করে। হামলা ও লুটপাট চলাকালেই পুলিশ স্থানীয় কিছু লোকের সহায়তায় মিছিলে অংশ নেওয়া ২০ জনকে হাতেনাতে গ্রেপ্তার করে। এর পর তাদের জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্য ও সিসিটিভির ফুটেজ দেখে লুৎফর, সাইফুল ও রবিউলের নাম পাওয়া যায়। এর পর গাজীপুর মহানগর পুলিশের একটি দল গতকাল সোমবার তাদের তিনজনকে গ্রেপ্তার করে।
পুলিশের দাবি, জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে লুৎফর নিজেকে জামায়াতের রোকন হিসেবে পরিচয় দেয়। এর পর গতকাল তার বাসায় অভিযান চালিয়ে জামায়াতে ইসলামী সম্পর্কিত বিভিন্ন নথি ও বই পেয়েছে পুলিশ। আর রবিউল পুলিশকে জানিয়েছে, সে কোনাবাড়ী জামায়াতে ইসলামীর হাবিব ইউনিটের সভাপতি। এর আগে সে গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জের কাজিপাড়া থানার মাইজবাড়ি ইউনিয়নের ছাত্রশিবিরের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে। এ ছাড়া সাইফুল জামায়াতের কোনাবাড়ী থানার নেতা হিসেবে পরিচয় দেয়।
এ ব্যাপারে গাজীপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার ডিআইজি খন্দকার লুৎফুল কবির সমকালকে বলেন, কাশিমপুরে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পরপরই আমরা প্রথমে মিছিলে যারা নেতৃত্ব দেয়; ফুটেজ দেখে তাদের পরিচয় বের করেছি। বিশ্নেষণে এও দেখা যায়, মিছিলে অংশ নেওয়া অধিকাংশ একটি পোশাক কারখানার শ্রমিক। এছাড়া হাতেনাতে যাদের ধরা হয়েছিল তাদের কাছে জানতে চেয়েছি- কাদের প্ররোচনায় তারা মিছিলে অংশ নিতে আসে। এর পরই জামায়াতের তিন নেতার নাম বেরিয়ে আসে। ঘটনার আগের দিন রাতে গার্মেন্টসের নাইট শিফট চলাকালে শ্রমিকদের ফ্লোরে ফ্লোরে হাজির হয়ে উত্তেজনামূলক বক্তব্য দিয়ে সংগঠিত করার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে তারা।
গাজীপুর মহানগর পুলিশের উত্তর বিভাগের ডিসি (অপরাধ) জাকির হাসান বলেন, গ্রেপ্তার তিন জামায়াত নেতার পেছনে কেউ থাকলে তাদেরও আমরা খুঁজে বের করব। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা স্বীকার করেছে- মন্দিরে হামলা করার ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে মিছিলের নাম করে তাদের জড়ো করা হয়।
পুলিশ সদর দপ্তর জানিয়েছে, সহিংস ঘটনাগুলোতে সোমবার রাত পর্যন্ত সারাদেশে বিভিন্ন থানায় ৭১টি মামলা হয়েছে। জড়িত সন্দেহে অন্তত ৪৫০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
প্রতিষ্ঠাতা : মেজর (অব) মোঃ মোদাচ্ছের হোসাইন, সম্পাদক মন্ডলির সভাপতি: বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুজ্জামান আহমেদ এমপি, ব্যবস্থাপনা সম্পাদক: তৌহিদ আহমেদে রেজা, বার্তা সম্পাদক: আসমা আহমেদ কর্তৃক ৫৪ কামাল আতাতুর্ক এভিনিউ সৈয়দ ভবন, ঢাকা-১২১৩ থেকে সম্পাদিত ও প্রকাশিত
© All rights reserved 2020 Daily Surjodoy