শেখ শাহাউর রহমান বেলাল
সাংবাদিকতার সংকট কি শহর কি মফস্বল! সাংবাদিকতা পেশাটিই নানা সংকটে-ঝুঁকিতে আবর্তিত বাংলাদেশ তো বটেই সারা বিশ্বেই। এ সংকট কখনো কম কখনো প্রকট হয়ে দেখা দেয়। মফস্বলও সে সংকটের বাইরে নয়। সাধারণত অনেকের কাছে রাজধানী ঢাকার বাইরে যেসব এলাকা রয়েছে তার সবই মফস্বল বা গেঁয়ো বা গ্রাম্য। সারা দেশের মফস্বলে কর্মরত সাংবাদিকদের জীবন কেমন কাটছে? তাদের সংসারে খাবার আছে কি না? এ খবর কি কেউ নিচ্ছে? মফস্বল সাংবাদিকদের জীবন আজ গভীর খাদের কিনারে এসে দাঁড়িয়েছে। তারা মান সম্মানের প্রশ্নে মুখ ফুটে কারও কাছে বলতেও পারছেন না আবার চলতেও পারছেন না। মফস্বল সাংবাদিকদের সংসার কিভাবে চলছে এ খবর কেউ নিচ্ছে কিনা ? এর উত্তরে কী বলবো? কে খবর নিবে? মিডিয়া মালিক না সরকার। প্রথমেই বলতে হয় যে প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সেই মিডিয়ার দায়িত্বই সবার চেয়ে বেশি। তারপরেও সরকারের ভুমিকাও কম নয়। মিডিয়া কর্তৃপক্ষ সম্পর্কে কি বলবো? মিডিয়া সম্রাটরাই ভালো বলতে পারেন তারা সে দাযিত্বটুকু নুন্যতম পালন করছেন কি না?
আমরা যারা মফস্বলে কাজ করি খবর নেয়ার নৈতিক সাহসটিও হারিয়েছেন অনেকে। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, দূর্যোগের মধ্যেও দায়িত্ব পালন করি। গভীর থেকে সত্য বের করে আনতে কখনো নিজের জীবন বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কাকে পিছনে ফেলে দায়িত্ব পালন করি। ভুলে যাই খাওয়া-দাওয়া। মানুষের কথা বলি, মানবতার কথা বলি। ক্ষুধার্ত নিপীড়িত, অন্যায়, অবিচার, অপরাধের কথা তুলে ধরি। আবার সরকারের উন্নয়নের কথাও তুলে ধরি। আমরা আসলে তেল মাখতে পারিনা বলে মূল্যায়নের কদর পাই না। পারিনা চাপাবাজী, ধান্ধাবাজী, চাঁদাবাজী। তারপরেও দুর্নাম শেষ হয়না, সাংবাদিকের জায়গায় শুনতে হয় সাংঘাতিক। কারো কাছে হতে হয় হলুদ সাংবাদিক। এভাবেই একের পর এক শত অপবাদ-লাঞ্চনা মাথায় নিয়ে দিনের পর দিন অসহায় মানুষের কথা কথাভেবে তাদের পাশে দাঁড়াই। নির্লজ্জের মতো মাঠে কাজ করি। তুলে ধরি দুর্ভোগের চিত্র। সঠিক তথ্য দেশের মানুষের কাছে তুলে ধরতে গিয়ে অনেক সময় নিজের পরিবারের কথাও ভাবা হয় না। নিজের আরাম আয়েশ এমনকি বিশ্রামও ঠিকভাবে করতে পারি ন। কারণ সাংবাদিকরা জাতির জাগ্রত বিবেক বলে কথা। তাই সব সময় জাগ্রত থাকতে হয়। আমি রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভের গণমাধ্যম। আমি অতি সামান্য হলেও একজন দায়িত্বশীল সচেতন নাগরিক। আমার উপর রাষ্ট্রের অনেক দায়িত্ব। শুধু কি আমার রাষ্ট্রের প্রতি আমারই দায়িত্ব? রাষ্ট্রের কি আমার প্রতি কোন দায়িত্ব নেই?
সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত থাকতে হয় সংবাদের খোঁজে। কখন বাড়ি ফিরবো তাও জানিনা। সারাদিন খবরের পিছনে পিছনে ছুটি। নানান উৎকুন্ঠায় থাকে আমার পরিবার। কী না কী হয়। কত উৎকুন্ঠা। সঙ্গ পায় না, একা একা খাওয়া খায়। অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকে, কখন বাড়িতে ফিরি। আমার তো নিরাপত্তা নেই। পরিবারের আপত্তি, কেন সাংবাদিকতা করি। মাঝে মাঝে জীবননাশের হুমকিও আসে। হামলাও হয়, মামলাও হয়। তবুও ভয় না করে কাজ করি। পদে পদে বিপদ তা জেনেও আমরা পিছপা হইনা। ঝুঁকি থাকা সত্বেও আমি নির্ভিক, আমি সৈনিক। সংবাদপত্র সমাজের দর্পন। সে দর্পন সবার মাঝে বিলিয়ে দিতেই রাষ্ট্রের কাজে নিবেদিত করেছি নিজেকে। নিজের জন্য নয় মানুষের জন্য কাজ করতে পারছি এটাই স্বার্থকতা। আমার একটি ছবি, আমার একটি লেখার দ্বরা হয়তো অনেকেরই ভাগ্যের দ্বার খোলে যায়। মানবতার অধিকার খুঁজে পায়। নির্যাতিত, নিপীড়িতরা বিচার পায়। এটাই আমরা সার্থকতা। এটা নিয়েই আমি মনের শান্তি খুঁজি।
মহামারি করোনাভাইরাসে আজ সবকিছু আজ স্থবির। দেশের সাধারণ মানুষদের জীবনযাপন যেন দুঃসহ হয়ে উঠছে। গরিব শ্রেণির মানুষ তাও সরকারি বেসরকারি সাহায্য চাইতে পারছে বা পাচ্ছে। কিন্তু নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির জীবন আজ সবচেয়ে বিপর্যস্ত। তারা সাহায্যের জন্য হাত পাততেও পারছেন না আবার সংসারও চালাতে পারছেন না। বেশিরভাগ মিডিয়া কর্তৃপক্ষ করোনার এ দুর্যোগে মফস্বল সাংবাদিকদের খবর নেয়ার নৈতিক সাহসটিও হারিয়েছেন। কোন মুখে তারা খোঁজ নেবেন? খোঁজ নিতে গেলেই তাদের বেতনের কথা আসে। আজ জানতে ইচ্ছা করে কয়জন মিডিয়া মালিক আছেন যারা মফস্বল সাংবাদিকদের বেতন দিচ্ছেন?
দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে এই মহামারি ভাইরাস। প্রতিদিন বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল। ভাইরাস সংক্রামক রুখতে চালানো হচ্ছে প্রচার-প্রচারণা। সচেতনতামূলক প্রচার মাইকিং। সংক্রামক রোগ হিসেবে গণজমায়েত বন্ধে দেশে করা হয়েছে লকডাউন। ভয়ে আতঙ্কে পুরো দেশ। তবুও এ ভয়ের মাঠকে শঙ্কামুক্ত করতে নির্ভীকভাবে কাজ করছে প্রশাসন, ডাক্তার-নার্স, পুলিশ, সশস্ত্রবাহিনী আর সাংবাদিক। এ যুদ্ধাদের মধ্যে আমিও মফস্বলের সাংবাদিক। সরকার সবাইকে বাড়িতে থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন। কেবল আমিই রয়েছি মাঠে। কি হবে আমার? না ভাবছি নিজে, না ভাবছে কেউ। আমার কি কোন পরিবার নেই? কি হবে আমার পরিবারের? মহামারি করোনায় বর্তমানে আমরা যারা মফস্বল সাংবাদিক তরা দুঃসহ অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন। তারা সম্মানের ভয়ে বলতেও পারছেন না চলতেও পারছেন না। তাদের বোবা কান্না কে দেখবে? কে শুনবে তাদের মনের যন্ত্রণা।
গত বছর করোনায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য নিয়েছেন ঘরে ফেরা কর্মসূচি। গৃহহীন ও ভূমিহীনদের জন্য খাদ্য এবং নগদ অর্থ প্রদান করেছেন। দিয়েছেন বিনামূল্যে ওষুধ ও চিকিৎসাসেবা। স্বাস্থ্যকর্মীদের ব্যক্তিগত সুরক্ষায় দিবেন পর্যাপ্ত সামগ্রী। পরিশেষে সাংবাদিকদেরও দিয়েছেন ১০ হাজার করে প্রণোদনা। তবে সবাইকে নয় হাতে গোনা কয়েকজনকে। প্রশ্ন হচ্ছে কারা পয়েছে এ প্রণোদনা? যারা স্বচ্ছল তারাই পেয়েছিলো এ সুবিধা। এবারও করোনায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ১০ কোটি টাকা সাংবাদিকদের জন্য প্রণোদনা দিয়েছেন। আমাদের ভাগ্যে কি জুটবে এসব প্রণোদনা। নাকি গত বছরের মত এবারও ওদের ভাগ্যেই যাবে এসব টাকা? রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে পালন করলেও আমাদের জন্য ভাবা হয়না। ভাবা হয় না আমাদের পরিবারের কথা। আমাদের অনেকেই অতি কষ্টে সংসার চালান। ক্ষুধার অনলে পুড়লেও পাথর চাপা দিয়ে সয়ে হাসিমুখে কাজ করে যান । কষ্ট যতোই হোক না কেন, প্রকাশ করি না লজ্জার খাতিরেই। কাকে বলবেন? বলার তো জায়গা নেই। নিজের কষ্টকে চেপে রেখে মানুষের কষ্ট তুলে ধরাই যেন আমাদের ধর্ম। কারণ আমরা জাতির বিবেক। আমরা যে অবস্থানেই থাকি না কেন যদি ন্যায় নীতিকে প্রধান্য দিয়ে ন্যায্যতার চর্চা করি তাহলে আমাদের সমাজ হবে মানবিক সমাজ। আর যতদিন এ মানবিক সমাজ গড়ে না উঠবে ততো দিন সর্বস্তরে শোষণ নিপিড়ীণ চলতেই থাকবে। তাই বিবেককে জাগ্রত করুন এভাবে আর কতকাল চলবে।
পরিশ্রম আর বিনা বেতনে কি সুন্দর আমাদের জীবন। দিনশেষে হাসিমুখে মেনে নিতে হয় সব কিছু। এভাবেই যাচ্ছে আমাদের দিনকাল। তবুও বলবো ভালো থাকুক সবাই। ভালো থাকুক আমার স্বাধীন বাংলাদেশ।
পরিশেষে আমি এই স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৭৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণের কয়েটি লাইন তুলে ধরতে চাই। তিনি বলেছিলেন…একটি কথা ভুলে গেলে চলবে না ‘চরিত্রের পরিবর্তন না হলে এই অভাগা দেশের ভাগ্য ফেরানো যাবে না। স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি ও আত্মপ্রবঞ্চনার ঊর্ধ্বে উঠে আমাদের সকলকে আত্মসমালোচনা, আত্মসংযম ও আত্মশুদ্ধি হতে হবে’। অনেকেই বলে থাকেন সাংবাদিকের কোনো বন্ধু নেই। আমি এর প্রত্যুত্তরে বলি পেশাটি কুসুমাস্তীর্ণ নয়। ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ উত্তাল সাগর পারি দিতে গেলে অনেক কঠিন সংগ্রামের প্রয়োজন। তাই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে চাই-‘সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম সে কখনো বঞ্চনা’। সেই সত্যের সন্ধানই হোক আজ ও আগামীর অঙ্গীকার। মানবতার জয় হোক।