প্রকৃতি সেজেছে তার আপন মহিমায়। আষাঢ়ের বৃষ্টিতে ভিজে এ সময়ের পাহাড় কন্যা প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি খাগড়াছড়ি যেন পর্যটকদের ডাকছে। প্রকৃতির যেন তার সব সৌন্দর্য দিয়ে সাজিয়েছেন খাগড়াছড়িকে। বৃষ্টির পরে সবুজ পাহাড়ের উপর থেকে মেঘরাশি উড়ে যায় যেন বিশ্রাম শেষে। আবার ঘুরে ঘুরে সেই মেঘরাশিই বৃষ্টি হয়ে পাহাড়কে ভিজিয়ে দেয়।
মেঘ, পাহাড় ও প্রকৃতির চরম বন্ধুত্বপূর্ণ সর্ম্পক যেন খাগড়াছড়ির সবখানেই। সুউচ্চ আলুটিলা পাহাড়, পাহাড়ের বুক চিরে নেমে আসা পাহাড়ি ঝর্ণা, আলুটিলার রহস্যময় সুড়ঙ্গ, সীমান্তবর্তী রামগড় চা বাগান, ব্রিটিশ আমলে নির্মিত মারমা রাজার বাসভবন, এশিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম বৌদ্ধমূর্তি, নিউজিল্যান্ড বিল সবই যেন হাতছানি দিয়ে সৌন্দর্য পিপাসুদের ডাকে। আর বছর দুয়েক আগে থেকে এর সাথে যোগ হয়েছে বাংলার দার্জিলিং নামে পরিচিত রাঙামাটির সাজেক ভ্যালি।
অন্য দুই পার্বত্য জেলা থেকে খাগড়াছড়ির সড়ক যোগাযোগ ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভালো হওয়ায় এখানের প্রতি পর্যটকদের আগ্রহ একটু বেশি। ঈদের দীর্ঘ ছুটিতে প্রতিবছরের মতো এ বছরও খাগড়াছড়ি জেলার সব হোটেল-মোটেল অগ্রিম বুকিং হয়ে আছে। পর্যটকদের বাড়তি চাপে হিমশিম খেতে হয় জেলায় বসবাসরত অন্যান্য অদিবাসীদের। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও সু-পরিকল্পনার অভাবে পর্যটন নগরীর আবাসন গড়ে উঠছে। এতে করে অনেক সময় পর্যটকরা কোনো হোটেল-মোটেলে থাকার জায়গা পায় না।
ছোটবড় দশ ঝর্ণা :
রিছাং, তৈদুছড়া, হাজাছড়া, খবংপড়িয়া ঝর্ণাসহ খাগড়াছড়িতে ছোট বড় মিলে দশটিও বেশি ঝর্ণা রয়েছে। পাহাড়ের অঝর-ধারা দিনরাত যেন এসব ঝর্ণার বুক চিরে নেমে আসে। এগুলোর মধ্যে সবগুলোতে যাতায়াত সহজ নয়। রিছাং ও হাজাছড়া ঝর্ণা ছাড়া অন্যান্য ঝর্ণাগুলো দেখতে যাওয়ার ক্ষেত্রে পর্যটকদের স্থানীয় গাইডের সহায়তা নিতে হয়। তা শুধু পথ চেনার জন্য।
আলুটিলা সুড়ঙ্গ
স্থানীয়দের মতে শত শত বছর আগে আবিষ্কৃত হয়েছে আলুটিলার সুড়ঙ্গ পথটি। সুড়ঙ্গ পথের আবিষ্কার কিংবা সময় সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য নেই কারো কাছে। তাই এ সুড়ঙ্গের নাম রাখা হয়েছে রহস্যময় সুড়ঙ্গ। আনুমানিক দেড়শত ফুট উচ্চতার পাহাড়ের নিচ দিয়ে সুড়ঙ্গ পথটি। নিচে পাথরের স্তরবিশিষ্ট শীতল পথ।
অন্ধকার এ সুড়ঙ্গ পথে ঢুকতে সাথে রাখতে হয় বাঁশ দিয়ে তৈরি এক প্রকার মশাল। যেটির মধ্যে জ্বালানি হিসেবে দেয়া হয় কেরোসিন। এর মাথায় কিছু রশি কিংবা কাপড় লাগিয়ে দিয়ে বিশেষ এ মশালটি তৈরি করা হয়। এছাড়াও সর্তকতার জন্য সার্চ লাইট কিংবা অন্য কোনো আলো সঙ্গে রাখা ভালো। সুড়ঙ্গ পথ পাড়ি দিয়ে মশালটি যত্রতত্র না ফেলে নির্দিষ্ট স্থানে ফেলুন।
তেরাং হেলিপ্যাড :
আলুটিলা পর্যটন কেন্দ্রের একটু সামনেই তেরাং হেলিপ্যাড। দশ কিলোমিটার দূরত্বের খাগড়াছড়ি শহরকে তেরাং থেকে দেখতে মনে হবে যেন সবুজের বুকে এক টুকরো দ্বীপ। খাগড়াছড়ি শহর চেঙ্গী নদীর তীরে অবস্থিত। তেরাং থেকে চেঙ্গী নদী বহমান চলে যাওয়া দেখা সত্যই রোমাঞ্চকর। বৃষ্টির দিনে তেরাং-এ মেঘ ও পাহাড়ের মিলন মেলা চলে।
মারমা রাজ বাড়ি :
মানিকছড়ি উপজেলার রাজ বাজার নামক স্থানে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ব্রিটিশ শাসনামলের মারমা রাজার রাজ বাড়ি। বিশাল জায়গা জুড়ে রাজ বাড়িটি নির্মিত হলেও কালের বিবর্তনে সংস্কার ও সংরক্ষণের অভাবে অনেক নিদর্শন হারিয়ে যাচ্ছে। রাজ বাড়ির প্রাঙ্গণে রয়েছে রাজঘাটবিশিষ্ট পুকুর, বৌদ্ধ বিহার ও মং রাজার সভাকক্ষ।
এশিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম বৌদ্ধমূর্তি :
জেলার পানছড়ি উপজেলার অরণ্য কুঠির নামক বৌদ্ধ ভাবনা কেন্দ্রে রয়েছে এশিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম বৌদ্ধমূর্তি। পানছড়ি সদর থেকে অরণ্য কুঠির বৌদ্ধ ভাবনা কেন্দ্রের দিকে যতই যাবেন ততই প্রকৃতি আপনাকে মুগ্ধ করবে। শান্তিপুর অরণ্য কুঠির এলাকা ঘুরাঘুরির আগে ধর্মীয় গুরুর (ভান্তে) কাছ থেকে অনুমতি নেয়া ভালো। কারণ ভাবনা কেন্দ্রের অনেক স্থানে পর্যটকদের যাওয়ার ক্ষেত্রে বাধা-নিষেধ রয়েছে। এছাড়াও খাগড়াছড়িতে বেশকিছু আকর্ষণীয় বৌদ্ধ বিহার আছে যেগুলো দৃষ্টি ভরিয়ে দেবে পর্যটকদের।
হর্টিকালচার পার্ক :
জেলা শহরের জিরোমাইল এলাকায় ২২ একর পাহাড় জুড়ে নির্মাণ করা হয়েছে হর্টিকালচার পার্ক। হর্টিকালচার পার্ক বা ২২ একর নামক স্থানটিতে রয়েছে কৃত্রিম লেক, ঝুলন্ত ব্রিজ, দেশীয় ফলের বাগান, কিডস জোন ও ওয়াচ টাওয়ার। এবছর নতুন করে সংযোজন করা হয়েছে টয় রেল।
নিউজিল্যান্ড বিল :
জেলা শহরের পানখাইয়া পাড়া এলাকায় নিউজিল্যান্ড বিল অবস্থিত। বিস্তীর্ণ ধান খেতের মাঝখানে আকাবাকা পথ বয়ে গেছে। নিউজিল্যান্ড বিল থেকে অদূরের আলুটিলা পাহাড় দেখা যায়। পড়ন্ত বিকেলে নিউজিল্যান্ড বিল থেকে আলুটিলার বুকে সূর্যাস্ত দেখা যায়।
কৃষি গবেষণা কেন্দ্র :
জেলা শহর থেকে অদূরে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কেন্দ্র (বারি) অবস্থিত। প্রকৃতি ও বৃক্ষপ্রেমী যে কেউ কৃষি গবেষণা কেন্দ্রে গিয়ে মুগ্ধ হয়ে যাবেন। কৃষিজ পণ্য গবেষণার পাশাপাশি ওই কেন্দ্রে রয়েছে বেশ কিছু পর্যটন স্থাপনা। এর মধ্যে শতবর্ষী বটগাছ, লেকের উপর বিশ্রামাগার, স্লুইচগেট ইত্যাদি বেশ উল্লেখযোগ্য।
খাগড়াছড়ি জেলার পর্যটন কেন্দ্রগুলোর আরো বেশি প্রসার ও সমৃদ্ধির জন্য সরকারকে উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানিয়ে সংশ্লিষ্ট খাতের অনেকে জানান, খাগড়াছড়িতে পর্যটন খাতে ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। প্রাকৃতিক সম্পদগুলোর সঠিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিছু নীতিমালা করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে সবার আগে প্রয়োজন পাহাড়ের সবুজকে রক্ষা করা। পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রতিটি উন্নয়ন কাজে পর্যটন ও প্রাকৃতিক বিষয়টি মাথায় রেখে পরিকল্পনা গ্রহণের পরামর্শ দেন তারা।
খাগড়াছড়ি জেলার হোটেল ব্যবসায়ী স্বপন দেবনাথ জানান, প্রতিবছরের মতো এবছরও প্রচুর পর্যটকের উপস্থিতি থাকবে খাগড়াছড়িতে। দশদিন আগে থেকে হোটেলের সব কক্ষ বুকিং হয়ে আছে।
হোটেল-মোটেল ব্যবসায়ীদের সীমাবদ্ধতার কথা স্বীকার করে তিনি জানান, পর্যটন ব্যবসায়ের জন্য খাগড়াছড়ি একটি সম্ভাবনাময় জেলা। এক্ষেত্রে সরকার যদি সহজ শর্তে ব্যবসায়ীদের ঋণ ও বিনিয়োগ করে তাহলে এখাতের ব্যাপক প্রসার ঘটবে।
খাগড়াছড়ি পৌরসভার মেয়র মো. রফিকুল আলম জানান, খাগড়াছড়ি পৌর শহরকে পর্যটকবান্ধব শহর হিসেবে গড়ে তুলতে বর্তমান পৌর কর্তৃপক্ষ অঙ্গীকারবদ্ধ। খাগড়াছড়ি শহরের সবকটি এলাকায় ঝুড়ি করে ডেস্টবিন, মোড়ে মোড়ে ডেস্টবিন করে দেয়া হয়েছে। কারণ, পরিস্কার পরিচ্ছন্ন শহরের প্রতি পর্যটকদের আকর্ষণ একটু বেশি।
খাগড়াছড়ির পুলিশ সুপার মো. মজিদ আলী, বিপিএম (সেবা) জানান, খাগড়াছড়ি জেলায় নিয়মিত টহলের পাশাপাশি পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে পুলিশের বিশেষ টহল রয়েছে।
কীভাবে আসবেন :
ঢাকা থেকে খাগড়াছড়িতে দিবা ও নৈশকোচ চলাচল করে। ঢাকার গাবতলী, কলাবাগান, কমলাপুর কাউন্টার থেকে শান্তি পরিবহন, এস আলম, সৌদিয়া, শ্যামলী ও সেন্টমার্টিন বাসে করে খাগড়াছড়ি আসতে পারেন। এসি বাসের ভাড়া ৯০০ টাকা এবং নন-এসি বাসের ভাড়া ৫২০ টাকা করে।
খাগড়াছড়িতে থাকা-খাওয়া :
খাগড়াছড়িতে থাকার বেশ কিছু হোটেল-মোটেল রয়েছে। পর্যটকপূর্ণ সময়ে আবাসিক হোটেলগুলোতে রুম পাওয়া বেশ কষ্টসাধ্য। তাই অনলাইন ঘেটে কিংবা পরিচিত জনদের দিয়ে আগেভাগে থাকার ব্যবস্থা করে নিতে পারেন।
খাগড়াছড়িতে আদিবাসি-বাঙালি দুই রকমের খাবারের ব্যবস্থা রয়েছে। শহরের খাবারের দোকানগুলোতে স্বাভাবিক ফুড মেন্যু অনুসারে বাঙালি খাবার খেতে পারেন। আর আদিবাসিদের খাবার খেতে হলে আপনাকে যেতে হবে শহরের অদূরে। যেমন, মহাজনপাড়া, নারায়ণখাইয়া, পানখাইয়া পাড়া নামক আদিবাসি পাড়াগুলোতে ভিন্ন ফুড মেন্যুর খাবার উপভোগ করতে পারেন।
প্রতিষ্ঠাতা : মেজর (অব) মোঃ মোদাচ্ছের হোসাইন, সম্পাদক মন্ডলির সভাপতি: বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুজ্জামান আহমেদ এমপি, ব্যবস্থাপনা সম্পাদক: তৌহিদ আহমেদে রেজা, বার্তা সম্পাদক: আসমা আহমেদ কর্তৃক ৫৪ কামাল আতাতুর্ক এভিনিউ সৈয়দ ভবন, ঢাকা-১২১৩ থেকে সম্পাদিত ও প্রকাশিত
© All rights reserved 2020 Daily Surjodoy