গোয়েন্দাদের হাতে অর্ধশত মডেল-নায়িকার তালিকা, ১২ নায়িকা নজরদারিতে
তৌহিদ আহমেদ রেজা,
গোয়েন্দাদের হাতে অর্ধশত মডেল-নায়িকার তালিকা, ১২ নায়িকা নজরদারিতে
রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশান, বনানী, বারিধারা, উত্তরাসহ বিভিন্ন এলাকায় ফ্ল্যাটে মাদকের আখড়া বসিয়ে বিনোদনজগতের কিছু নায়িকা-মডেলের মাধ্যমে ফাঁদে ফেলা হচ্ছে ধনাঢ্য পরিবারের যুবকদের। এসব আয়োজনকে বলা হয় ‘হাউস পার্টি’। আবার কখনো বলা হয় ‘ডিজে পার্টি’। সম্প্রতি নায়িকা পরীমনিসহ কয়েকজন গ্রেপ্তারের পর অন্তত ৪০টি ফ্ল্যাটের সন্ধান পেয়েছেন পুলিশ ও র্যাবের গোয়েন্দারা, যেসব ফ্ল্যাটে ‘হাউস পার্টি’র নামে মাদকের আখড়া বসানো হয়। এসব পার্টিতে আমন্ত্রণ করে ধনাঢ্য পরিবারের যুবকদের অসতর্ক মুহূর্তের ছবি বা ভিডিও ধারণ করে চলে ব্ল্যাকমেইলিং।
তদন্তকারী সূত্রগুলো জানায়, মাদকের আখড়া থেকেই ঘটছে প্রতারণার ঘটনা। সেখানে সিসা, মদ, ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্য সেবন চলে। ‘হাউস পার্টি’র নামে মাদক কারবার, অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত বিনোদনজগতের অর্ধশতাধিক মডেল-নায়িকার নাম পেয়েছেন গোয়েন্দারা। তাঁদের মধ্যে অন্তত ১২ জনকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে। যাচাই করা হচ্ছে ‘হাউস পার্টি’র আয়োজন করা ফ্ল্যাটগুলোর তথ্য। এসব চক্রের মাদক কারবারের নেটওয়ার্ক নিয়েও শুরু হয়েছে তদন্ত।
দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, মাদকের পার্টি ও প্রতারণার পেছনে যাঁরা আছেন তাঁরা প্রভাবশালী হলেও আইনের আওতায় আনা হবে।
চিত্রনায়িকা পরীমনি, চলচ্চিত্র প্রযোজক নজরুল ইসলাম রাজ, মডেল মৌ ও পিয়াসা, তাঁদের সহযোগী মিশু হাসান, জিসান ও জিমিকে মাদকদ্রব্যসহ গ্রেপ্তারের সাতটি মামলার তদন্তভার পেয়েছে অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এই ইউনিটের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক শেখ ওমর ফারুক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। আমরা চাই নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করে সত্য ঘটনা উদঘাটন করতে। তারা যত ক্ষমতাধরই হোক না কেন, আইনের আওতায় আসতে হবেই।’
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন সাংবাদিকদের বলেন, ‘গুলশান, বনানী, বারিধারার বেশ কিছু ফ্ল্যাটে হাউস পার্টির নামে মাদকের আখড়া বসছে বলে আমরা তথ্য পেয়েছি। রাজ, মিশু, পরীমনির মতো আরো কয়েকজন এই চক্রে জড়িত। সেখানে ব্ল্যাকমেইলিংও চলছে। এ ব্যাপারে নজরদারি করা হচ্ছে।’
সূত্র জানায়, ঢাকার অভিজাত এলাকার অন্তত ৪০টি ফ্ল্যাটের সন্ধান পেয়েছেন গোয়েন্দারা। এসব ফ্ল্যাটে পার্টির আয়োজন করে সেখানে ধনী পরিবারের সন্তানদের আমন্ত্রণ করে নিয়ে ক্ষতিকর মাদকে আসক্ত করা হয়। কিছু বিতর্কিত মডেল ও নায়িকাদের দিয়ে আয়োজন করা হলেও মাদক ও প্রতারক চক্র এর সঙ্গে যুক্ত। পার্টির নামে ধনাঢ্যদের সঙ্গে সম্পর্ক করে এবং প্রতারণার ফাঁদে ফেলে টাকা আদায়ের নেশায় কিছু মডেল ও নায়িকা এই চক্রে জড়িয়ে পড়েছেন। গুলশান ১ নম্বর এলাকায় অভিনেত্রী শিলা হাসানের একটি ফ্ল্যাট ‘পার্টি হাউস’ হিসেবে ব্যহৃত হচ্ছে। প্রায় সাড়ে চার হাজার বর্গফুটের এই ফ্ল্যাটে অনেক দিন ধরে রাতে পার্টির আয়োজন হয়। একেক রাতে আমন্ত্রিতরা ১০ হাজার থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত একেকজন খরচ করেন। ঘণ্টা হিসাবে ‘পার্টি হাউসে’ ছোট ছোট কক্ষও ভাড়া দেওয়া হয়। বিতর্কিত মডেল মরিয়ম আক্তার মৌয়ের গুলশানে দুটি আলাদা ‘পার্টি হাউস’ আছে। একটি ফ্যাশন হাউসের কর্ণধার গুলশানে একটি ‘পার্টি হাউস’ চালান বলে তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা। গ্রেপ্তারকৃত রাজ তাঁর কার্যালয় ও আলাদা ফ্ল্যাটে পার্টির নামে মাদকের আখড়া বসাতেন। মিশু হাসানেরও ছিল ‘পার্টি হাউস’। পরীমনির সঙ্গী তুহিন সিদ্দিকী অমি বনানী ও উত্তরায় ‘পার্টি হাউসের’ নিয়ন্ত্রক।
‘হাউস পার্টির’ আয়োজকরা বিদেশে ‘প্লেজার ট্রিপের’ নামে অনেক ব্যক্তির সঙ্গে চুক্তি করে টাকা আদায় করেন।
সূত্র জানায়, পরীমনি, পিয়াসা, মৌসহ কয়েকজন গ্রেপ্তারের সূত্রে যাঁদের নাম এসেছে তাঁদের মধ্যে অন্তত ১২ জনকে নজরদারি করা হচ্ছে। তাঁদের মধ্যে ‘র’ আদ্যক্ষরের একজন দুবাইয়ে অমির ফ্ল্যাটে থেকেছেন এবং অমিকে স্বামী বলেও পরিচয় দেন। ক্যাসিনোকাণ্ডে নাম আসা ‘শ’ আদ্যক্ষরের এক নায়িকাও আছেন এই তালিকায়। জনপ্রিয় বা ব্যস্ত নায়িকা না হয়ে তিনি কোটিপতি বনে গেছেন। ‘প’ আদ্যক্ষরের টিভি মিডিয়ার আরেক নায়িকা পার্টিতে নিয়মিত অংশ নেন। এ ছাড়া না, শু, মৌ, আ, মৃ আদ্যক্ষরের পাঁচ মডেল ও নায়িকা আছেন আলোচনায়। সোহেল শাহরিয়ার নামের রাজের এক সহযোগী তাঁর সঙ্গে অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত। বেসরকারি নর্থ সাউথ বিশ্বদ্যালয়ে পড়া এক ছেলে মডেলও মাদকের পার্টির অন্যতম আয়োজক। এ ছাড়া নাজিম সরদার, তুহিন কাজীসহ কয়েকজনের নাম পেয়েছেন গোয়েন্দারা।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) উপপরিচালক (ঢাকা উত্তর) রাশেদুজ্জামান বলেন, ‘বাসাবাড়িতে ফ্ল্যাট নিয়ে পার্টির নামে মাদকের আখড়া এবং সেখানে নানা অবৈধ কর্মকাণ্ডের তথ্য আমাদের কাছেও আছে। আমরাও নজরদারি বাড়িয়েছি। কিছু ফ্ল্যাটে এমন কর্মকাণ্ড চলছে বলে অভিযোগ আছে। তবে মাদকদ্রব্য হাতেনাতে না ধরতে পারলে মামলা করা যায় না।’