সোমেন সরকার
কাস্টমস কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ও প্রশাসনকে ম্যানেজ করে মাটি চাপা দেয়া খাবার অযোগ্য, পচা, মেয়াদোত্তীর্ণ ৩০০ কোটি টাকার খাদ্যপণ্য পাচার করে বাজারজাত করছে একটি সিন্ডিকেট।
অথচ এক মাসে আগে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউস কর্তৃপক্ষ লোক দেখানো সম্পূর্ণ প্যাকেজিং অবস্থায় এসব পণ্য মাটি চাপা দেয়। খাদ্যপণ্য পাচার কাজে কাস্টমস’র নিরাপত্তা কর্মীরা পাহারায় থাকলেও বিষয়টি তাদের অজানা। তবে তদন্ত টিম গঠন না করে এ ব্যাপারে কথা বলতে নারাজ কাস্টমস কমিশনার এম ফখরুল আলম।
সরেজমিনে উত্তর হালিশহর চৌধুরীপাড়া বে-টার্মিনাল সংলগ্ন আউটার রিং রোডের পূর্বপাশে মান্নানের গ্যারেজ এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, বস্তায় বস্তায় মাটি চাপা দেয়া পচা পণ্যের কোন অস্তিত্বই নেই। কাস্টমস নিরাপত্তা কর্মীদের উপস্থিতিতে স্কেভেটরের সাহায্যে ধ্বংসযোগ্য খাদ্যপণ্যগুলো রাতের আঁধারে বিক্রির উদ্দেশ্যে নিয়ে যায় সিন্ডিকেটটি ।
পাচার হওয়া এসব পণ্যের মধ্যে ছিল -মাছ, হাঁস-মুরগী ও গবাদিপশুর খাদ্য, ছোলা, ডাল, মটর, পিয়াঁজ ও মসলাসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য। পহেলা রমজান গভীর রাতে শ্রমিক দিয়ে এসব খাদ্যপণ্য লোড-আনলোডের ভিডিওসহ একজন সিন্ডিকেট সদস্যের সরল স্বীকারোক্তির অডিও ভিডিও রয়েছে প্রতিবেদকের হাতে।অভিযোগ রয়েছে, নগরীর বন্দর থানার পুরাতন পোর্ট মার্কেটের বিকাশ ব্যবসায়ী কালাম, স্ক্র্যাপ ব্যবসায়ী ফারুক
, নিমতলার আমান মাঝি ও আরিফসহ ৪১জনের একটি সিন্ডিকেট কাস্টমস হাউসের অসাধু কয়েকজন কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজনকে ‘ম্যানেজ’ করে গভীর রাতে কাভার্ডভ্যানে করে নিয়ে যায় সরকারি নিলামের ধ্বংসযোগ্য এসব পণ্য।
এদের বিরুদ্ধে ইতোপূর্বেও পণ্য চুরির একাধিক মামলা রয়েছে। পহেলা রমজান থেকে শুরু করে ১৫ই রমজান পর্যন্ত প্রায় রাতেই ১২টার পর থেকে ভোর পর্যন্ত চলে পণ্য লুট।এদিকে পণ্য ধ্বংসকারী কাস্টমসের ভাড়া জায়গার আশপাশের বসবাসরত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন এলাকাবাসী জানান, দিনের বেলায় লোক দেখানো কিছু পণ্য ট্রাকে করে ইর্য়াডে এনে ধ্বংসের নামে মাটি চাপা দিলেও তা আবার রাতের বেলায় মাটি সরিয়ে নিয়ে যায়।
এলাকার আরেক বাসিন্দা নাম গোপন রাখা শর্তে বলেন, এখানে অনেক রাঘব বোয়াল জড়িত। বেশি কথা বলা যাবে না। এখানে হরিলুট চলছে।সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, দীর্ঘদিন চট্টগ্রাম বন্দরের ইয়ার্ডে এবং অফডকে পড়ে থাকা ব্যবহার অযোগ্য মেয়াদোত্তীর্ণ ৩৫টি কনটেইনারের পণ্য ৩১ মার্চ মাটি চাপা দিয়ে ধ্বংস করে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস। এর আগে গত ২৯ মার্চ বিভিন্ন ডিপো থেকে তালিকাভুক্ত ২৭টি কনটেইনারের পণ্য ধ্বংস করা হয়। এর অংশ হিসেবে এ পর্যন্ত ১৩৬টি কনটেইনার খালি করা হয়েছে।
তবে ইয়ার্ডের মালিক মন্নান মিস্ত্রির তথ্যমতে এই পর্যন্ত ১২৬ কনটেইনার পণ্য খালি করা হয়েছে। লকডাউনের কারণে ধ্বংস কার্যক্রম আপাতত বন্ধ থাকলেও ওখানে পর্যায়ক্রমে কাস্টমস কতৃর্পক্ষের মোট ২৯৮টি কনটেইনার পণ্য ধ্বংস করার কথা রয়েছে। চট্টগ্রাম নগরীর উত্তর হালিশহরের বে-টার্মিনাল সংলগ্ন বেড়িবাঁধের পূর্বপাশে মান্নানের ইয়ার্ডে (গ্যারেজ) ভাড়া জায়গায় এসব পণ্য মাটি চাপা দেওয়া হচ্ছে।
অভিযোগ উঠেছে- প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও পণ্য পাচার চক্রের সিন্ডিকেটের সদস্যদের যোগসাজশে ঠিকাদারী পায় কে এম কর্পোরেশন।
সূত্রে জানা যায়, ২৯৮ কন্টেইনার প্রায় ৩০০ কোটি টাকার বিভিন্ন ধরনের নষ্টপণ্য ধ্বংস করতে উদ্যোগ নেয় কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। গত ২১ মার্চ এসব নষ্ট পণ্য ধ্বংস করতে মিটিং করে কাস্টমস।
এতে সিন্ডিকেটের সদস্যসহ উপস্থিতি ছিলেন ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের মালিক ও তার লোকজন। গত ২৯ মার্চ চট্টগ্রাম কাস্টমস কর্তৃপক্ষ ৬০০০ টন নষ্ট পণ্য গোপনে ধ্বংস করার কথা ছিল। ধ্বংস করার স্থান নির্ধারিত করা হয় হালিশহর চৌচালা চৌধুরী পাড়া ও বেড়িবাঁধ বে-টার্মিনালের মধ্যবর্তী স্থানের ভাড়া জায়গায়।
গত ২৫ মার্চ পণ্য ধ্বংস প্রক্রিয়াকারী কার্যকরী কমিটি থেকে বন্দর কর্তৃপক্ষ, জেলা প্রশাসক, পরিবেশ অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন, ফায়ার সার্ভিসসহ পুলিশ কমিশনারকে চিঠি দেয়া হয়েছিল। পরিবেশ অধিদপ্তরের আপত্তি থাকা সত্ত্বেও তিন’শ কোটি টাকার নষ্ট পণ্য ধ্বংসের কাজ পায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কে এম কর্পোরেশন এর ম্যানেজার মোঃ মোরশেদ।
যে মোরশেদের বিরুদ্ধে নষ্ট পণ্য ও মালামাল নিয়ে আসার আড়ালে কন্টেইনার মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের পণ্য পাচার করার অভিযোগ রয়েছে সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে।এ বিষয়ে সচেতন নাগরিক কমিটির সদস্য নিউটন দাশ দুর্নীতি দমন কমিশন, পরিবেশ অধিদপ্তর, মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ দিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির টিকাদারের বিরুদ্ধে।
এদিকে ঘটনাস্থলে থাকা কাস্টমসের নিরাপত্তায় দায়িত্বরত আনসার কমান্ডার শহিদের কাছে মাল লুটের ব্যাপারে জানতে চাইলে অস্বীকার করেন। তিনি জানান, বস্তাভর্তি পণ্যগুলো অক্ষত অবস্থায় মাটি চাপা দিয়ে ধ্বংস করেছে কর্তৃপক্ষ।কাস্টমসকে জায়গা ভাড়া দাতা মান্নান প্রকাশ মিস্ত্রি মান্নানের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, জমির মূল মালিক আবদুল রহিম ও মো ঈসা থেকে ১০ বছর চুক্তিতে ৫ কানি জমি মাসিক ৫ লক্ষ টাকার ভাড়া নিয়ে আমি মোর্শেদকে পণ্য ধ্বংস করতে নিজেই ভাড়া দিই।
পণ্য পাচার বা লুট সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আজকে দুপরেও কাস্টমসে বৈঠক হয়েছে। কোন মাল লুট হয়নি। ভিডিও চিত্রসহ প্রমাণ আছে দাবি করলে তিনি প্রতিবেদককে দেখা করতে বলেন।বিষয়টি জানতে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের উপ—কমিশনার (ডিসি নিলাম) ফয়সাল বিন রহমানের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি কল রিসিভ করেননি।কাস্টমস কমিশনারের পরামর্শে একাধিকবার এডিসি আবু নুর রাশেদ আহমেদের মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্ট করা হলে তিনিও কল রিসিভ করেননি। পরে এ বিষয়ে মোবাইলে একটি এসএমএস পাঠানো হলে তিনি কল রিসিভ করে ডিসি এ কে এম সুলতান মাহমুদের সাথে কথা বলতে বলেন।এদিকে কাস্টম কমিশনার বলেন, আপনার কাছে প্রমাণ থাকলে দিন।
প্রতিবেদক হোয়াটসঅ্যাপে ভিডিও প্রমাণ পঠালে তিনি বলেন, আগে তদন্ত টিম গঠন করতে হবে, তারপর বক্তব্য দেবো।
Like this:
Like Loading...
Related
এ জাতীয় আরো খবর..