সিলেটের বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নির্যাতনে মারা যাওয়া রায়হান আহমদের স্ত্রীকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন পুলিশের বহিষ্কৃত উপ-পরিদর্শক (এসআই) আকবর হোসেন ভূইয়া। একইসঙ্গে রায়হানের মা ও সন্তানের ভরণপোষণের দায়িত্ব নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি। রায়হানকে হত্যার অভিযোগে করা মামলার প্রধান আসামি আকবর হোসেন।
পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) দেওয়া অভিযোগপত্রেও আকবরকে আসামি করা হয়েছে। আর সিলেট মহানগর পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে রায়হানকে নির্যাতনের সত্যতা মেলায় বহিষ্কার করা হয় আকবরকে। এই মামলায় কারাগারে আছেন আকবর। জেল থেকেই তিনি এমন প্রস্তাব দেন।
রায়হানের মা সালমা বেগম সোমবার (৪ অক্টোবর) বলেন, ‘কিছুদিন আগে পুলিশের এক সদস্য আমাদের বাসায় আসেন। তিনি আরেকটি মামলায় কারাগারে ছিলেন। সেখানে আকবরের সঙ্গে তার দেখা হয় জানিয়ে ওই পুলিশ সদস্য বলেন, আকবর রায়হানের স্ত্রীকে বিয়ে করতে চান এবং আমার ও আমার নাতনির ভরণপোষণের দায়িত্ব নিতে চান।
এ ব্যাপারে আমাদের সম্মতি জানতে চান ওই পুলিশ সদস্য। তবে, আমরা আমাদের আপত্তির কথা তাকে জানিয়ে দিয়েছি। ছেলের খুনিকে আমার বউমা বিয়ে করবে কী করে। এই প্রস্তাব পাঠানোর কিছুদিন পর আকবরের সঙ্গে কারাফটকে তাদের দেখা হয় জানিয়ে সালমা বেগম বলেন, ‘সেদিন তিনি আমাদের পা ধরে ক্ষমা চান।
হত্যার ঘটনায় পুলিশের বিভাগীয় মামলায় সাক্ষ্য দিতে গত মাসে রায়হানের মা সালমা বেগম, স্ত্রী তাহমিনা আক্তার তান্নী ও সৎবাবা হাবিবুল্লাহকে পুলিশ সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগার ফটকে নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় আকবরসহ অন্য আসামিদেরও তাদের সামনে হাজির করা হয়।
সালমা বেগম বলেন, ‘ওইদিন আকবর আমার ও রায়হানের চাচার (সৎবাবা) পা ধরে অনেকক্ষণ কান্নাকাটি করেন। তিনি ক্ষমা চেয়ে আমাদেরকে তার প্রাণভিক্ষা দেওয়ার জন্য বলেন। আমাদের সব ধরনের দায়িত্ব তিনি নেবেন বলেও জানান। ’
রায়হানের মা বলেন, সেদিন আকবর আমাকে বলেছিল- ‘আমরা ভুল তথ্য পেয়ে রায়হানের মতো ভালো একটি ছেলেকে নির্যাতন করেছি। আমাদের ভুল হয়েছে। আমরা বুঝতে পারিনি। আমাদের ক্ষমা করে দিন। আকবরকে কখনও ক্ষমা করব না জানিয়ে সালমা বেগম বলেন, ‘তিনি আমার নিরপরাধ ছেলেকে খুন করেছেন। তাকে আমি কখনোই ক্ষমা করব না। আমাদের ভরণপোষণের চিন্তা করতে হবে না। পারলে তিনি আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দিক। ’
রায়হান যখন মারা যান তখন তার মেয়ে আলফার বয়স ছিল দুই মাস। সেই মেয়ে এখন বড় হয়ে উঠছে। হাঁটা শিখছে। ধীরে ধীরে কথাও ফুটছে তার মুখে। সালমা বেগম বলেন, গত ৩০ সেপ্টেম্বর মামলার কাজে আদালতে গিয়েছিলাম। এসে দেখি নাতনিটা কেবল বাবা বাবা করছে। সব সময়ই সে বাবাকে খোঁজে। কিন্তু পায় না। তার জন্য বুক ফেটে যায়। এই শিশুকে যে এতিম করেছে তাকে কী করে ক্ষমা করব?
আকবরসহ অন্যরা অপরাধ না করে থাকলে কেন ক্ষমা চাইবে এমন প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, ‘তাদের এই ক্ষমা প্রার্থনা আর বিভিন্ন ধরনের প্রস্তাবই প্রমাণ করে তারা আমার ছেলেকে হত্যা করেছে। ২০২০ সালের ১১ অক্টোবর রাতে সিলেট নগরের আখালিয়া এলাকার যুবক রায়হান আহমদকে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। ভোরে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় তাকে নেওয়া হয় সিলেট এমএজি ওসমানী হাসপাতালে। সেখানে সকালে তিনি মারা যান।
রায়হানকে পুলিশ ফাঁড়িতে নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যার অভিযোগ তোলে তার পরিবার। এ ঘটনায় তার স্ত্রী তাহমিনা আক্তার তান্নি হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে মামলা করেন।
গত ৫ মে এই মামলায় ৫ পুলিশ সদস্যসহ ৬ জনকে অভিযুক্ত করে অভিযোগপত্র দেয় পিবিআই। ৩০ সেপ্টেম্বর অভিযোগপত্র গ্রহণ করে আদালত। অভিযুক্তরা হলেন- বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির তৎকালীন এসআই আকবর হোসেন ভুঁইয়া, এসআই হাসান উদ্দিন, এএসআই আশেক এলাহী, কনস্টেবল টিটুচন্দ্র দাস, হারুনুর রশিদ ও কথিত সাংবাদিক আব্দুল্লাহ আল নোমান।
রায়হানের মৃত্যুর পরই পালিয়ে যান এসআই আকবর। গেল বছরের ৯ নভেম্বর দুপুরে সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার লক্ষ্মীপ্রসাদ ইউনিয়নের ডোনা সীমান্ত এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এখন অভিযুক্ত পাঁচ পুলিশ সদস্য কারাগারে থাকলেও নোমান পলাতক।