নগরীতে একসময় ছিল দিগন্ত বিস্তৃত বিশাল মাঠ ছিল সবুজের সমারোহ। সবুজের বুক ছিড়ে ক্রমাগত বাড়ছে অবুঝের দল।
ফলে সবুজ এখন অনেকটাই শ্রীহীন। সাথে খেলার মাঠও নেই যান্ত্রিক নগরীতে। আগের মতো খেলার মাঠ না থাকায় খেলা বিমুখ হচ্ছে নতুন প্রজন্ম। অবকাশ সময়ে আসক্তি বাড়ছে মোবাইল ফোনে। অবশ্য এর বিপরীত চিত্রও অনেকটা আশঙ্কার এবং আতঙ্কের।
নতুন প্রজন্মের একটি অংশ খেলাধুলার সময়ে পাড়া-মহল্লায় দল বেঁধে জমাচ্ছে আড্ডা। এই আড্ডা থেকে ছিনতাই,ইভটিজিং,গুম, খুনসহ ঘটছে ভয়াবহ নৃশংস ঘটনাও।
জানাগেছে, অব্যবস্থাপনা, দখল, বেদখল, নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে বহুতল ভবন নির্মাণের কারণে নগরী থেকে হারিয়ে গেছে খেলার মাঠ। কিছু মাঠ এখনো অবশিষ্ট থাকলেও সেখানে নেই খেলাধূলার পরিবেশ।
এর সুবাদে নগরীতে বাণিজ্যিকভাবে গড়ে উঠছে খেলার মাঠ। পরিচালিত হচ্ছে ভাড়ায়। বাধ্য হয়ে এসব ইনডোর মাঠ ভাড়া নিয়ে ক্রীড়া কর্মকাণ্ড চালাচ্ছেন ক্রীড়ামোদী যুবকরা।
এ বিষয়ে সিলেটের একটি অনুষ্ঠানে আক্ষেপ করেছেন খোদ পররাষ্ট্রমন্ত্রীও। সিলেট নগরে খেলার মাঠ না থাকায় তিনি নিজের দুঃখ লাগে বলে জানিয়েছেন ওই সভায়।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, সিলেট নগরে খেলার জন্য মাঠ নেই। এজন্য আমার দুঃখ হয়। কারণ বিশ্বের বিভিন্ন শহরে যদি আমরা যদি দেখি তাহলে দেখব কয়েকটা মাঠ থাকে। যেগুলোতে ছেলে-মেয়েরা খেলাধুলা করছে।
তবে আশার খবর হলো, জেলা প্রশাসন নগরীর কালোপাথরের মাঠটিকে নির্বাচন করেছেন। এজন্য জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়াও চলছে। তবে আমি বলেছি আরও দুই-তিনটি মাঠের জায়গা খুঁজে বের করার জন্য। মন্ত্রীর এমন বক্তব্যে আশা খুঁজে পাচ্ছেন ক্রীড়ামোদী তরুণ প্রজন্ম।
অনুসন্ধানে জানা যায়, নগরীর শিবগঞ্জ সোনারপাড়ায় ক্রসবার, শিবগঞ্জে সকার, কুমারপাড়ায় গোল ও বরইকান্দিতে স্পোর্টস হেভেন নামে বাণিজ্যিকভাবে গড়ে উঠেছে ইনডোর খেলার মাঠ। এসব মাঠ ভাড়া নিতে প্রতিঘন্টায় গুনতে হয় দিনে ৭শ টাকা এবং রাতে ৮শ টাকা করে।
রাতে মাঠ ভাড়া নিলে দিতে হয় বিদ্যুৎ বিলের টাকাও। একসময় নির্দিষ্ট মাঠ ছাড়াও নগরীর বিভিন্ন বাসার বাউন্ডারীতে খেলাধূলা করতো ছেলেমেয়েরা। ক্রমশই সেসব বাউন্ডারীতে এখন বিলাসবহুল বাসা বাড়ী শোভা পাচ্ছে।
অথচ প্রতিটি মহল্লায় ছোট-বড় খেলার মাঠ ছিল। সিলেট জেলা স্টেডিয়াম ছাড়াও ফুটবল, হকি, ক্রিকেট খেলার জন্য বড় পরিসরে খেলার মাঠের তালিকায় ছিল সিলেট রেজিস্টারি মাঠ, সিলেট পুলিশ লাইন মাঠ, আলীয়া মাদরাসা মাঠ, সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ মাঠ, কালাপাথর মাঠ, এমসি কলেজ মাঠ, শাহী ঈদগাহ মাঠ, কয়েদীর মাঠ অন্যতম।
এছাড়াও পাড়া-মহল্লার মাঠগুলোর মধ্যে লালদিঘীরপার গাছতলা মাঠ, বর্ণমালা স্কুল মাঠ, লালমাটিয়া মাঠ, মজুমদার বাড়ির মাঠ, বাগবাড়ী এতিম স্কুল মাঠ, পীরমহল্লার সৈয়দ জিলকদর আলীর মাঠ, বাদাম বাগিচা মাঠ, প্রাইমারি টিচার ট্রেনিং ইন্সটিটিউট মাঠ, রাজবাড়ি খেলার মাঠ, ছড়ারপার খেলার মাঠ,
গলফ ক্লাবের মাঠ, আম্বরখানা সরকারি কালোনীর মাঠ অন্যতম। এর মাঝে আলিয়া মাদরাসা মাঠ ও এমসি কলেজ মাঠে খেলাধূলা হলেও অন্যান্য মাঠে খেলাধূলা একেবারে হয়না বললেই চলে। আর শাহী ঈদগাহ খেলার মাঠে বছর জুড়েই থাকে বাণিজ্য মেলার আয়োজন।
নগরী কিংবা শুধু পাড়ার মাঠ নয়, এখন স্কুলগুলোতেও নেই খেলার মাঠ। স্কুল প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিধি অনুযায়ী, নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বেলায় নগর এলাকায় দশমিক ২৫ একর, পৌর ও শিল্প এলাকায় দশমিক ৩০ একর, মফস্বল এলাকায় দশমিক ৭৫ একর জমি থাকা আবশ্যক।
কিন্তু এ নিয়মের তোয়াক্কা না করেই সিলেটের বেশিরভাগ স্কুল গড়ে উঠেছে। বিশেষ করে শিক্ষা বাণিজ্যের চিন্তা থেকে বাসা-বাড়িতে গড়ে উঠা স্কুল কলেজে খেলার মাঠের কথা অচিন্তনীয়।
যায়, জায়গা না থাকায় শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছে মুক্ত আকাশ এবং সবুজ খেলার মাঠ থেকে। অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিশেষ করে গত দুই দশকে সিলেট নগরীতে গজিয়ে উঠা ইংরেজি ও বাংলা মাধ্যমের বেসরকারি স্কুলগুলোতে খেলার মাঠ তো দূরের কথা শিক্ষার্থীদের শারীরিক কসরতের জন্য নেই ছোট্ট আঙ্গিনাটুকুও।
বরং বিভিন্ন বাণিজ্যিক ভবনের একটি বা দুইটি ফ্লোর নিয়ে আটোসাটো গাদাগাদি করা কয়েকটি কক্ষ নিয়ে চলছে স্কুলগুলোর কার্যক্রম। অথচ স্কুল প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মাঠ থাকার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিছুদিন আগে হকারমুক্ত হলেও সিলেট রেজিষ্ঠারী মাঠে দীর্ঘদিন থেকে নেই খেলাধূলার পরিবেশ। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশের পাশাপাশি রেজিষ্ঠারী মাঠে আয়োজন চলে ওয়াজ মাহফিল ও রাজনৈতিক কর্মসুচীর।
ফলে মাঠে খেলাধুলা নিয়ে চিন্তার ফুসরত নেই। ওসমানী মেডিক্যাল খেলার মাঠে গড়ে তোলা হয়েছে নার্সিং হোম ও ইন্টার্ণ আবাসিক ভবন, পুলিশ লাইন মাঠে প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত থাকায় পুলিশ ছাড়া কেউ সেটা ব্যবহারের সুযোগ পায়না।
আলীয়া মাদরাসা মাঠে বছরজুড়ে ওয়াজ মাহফিল, বৃক্ষমেলা, সভা-সমাবেশসহ নানা কাজে পরিচালিত হওয়ায় এখানে খেলার সুযোগ পাওয়া যায় খুব কম। যদিও এখন পর্যন্ত আলিয়া মাদরাসা মাঠ ও এমসি কলেজ মাঠ ই খেলাধূলার একমাত্র অবলম্বন। ইলেকট্রিক সাপ্লাই এলাকার কালাপাথর নামে একটা বিশাল মাঠ ছিল। পাশাপাশি দুটি মাঠ নিয়ে ছিল এর অবস্থান।
এখানে বিভিন্ন ক্লাব অনুশীলন ছাড়াও পাড়া-মহল্লার দলগুলোর অংশগ্রহণে বিভিন্ন ধরণের ফুটবল টুর্নামেন্ট হতো বছরজুড়ে। কিন্তু বিস্তৃত এই মাঠে অনেক আগে থেকেই চোখ পড়েছে ভূমিখেকোদের। নানাভাবে দখলে নেওয়ার চেষ্টাও হয়েছে বারবার। তবে এলাকাবাসী ও সচেতন মহলের আন্দোলনের মুখে এখনও টিকে আছে মাঠটি।
যদিও আগ্রাসনে ছোট হয়ে এসেছে মাঠের আকৃতি। নগরের মাছিমপুরস্থ কয়েদীর হাওর মাঠ লিজ নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে বহুতল ভবনসহ নানা স্থাপনা। যদিও এখানে গড়ে উঠা আবুল মাল আবদুল মুহিত ক্রীড়া কমপ্লেক্স খেলাধুলার একটি স্থায়ী স্থাপনা হিসেবে ক্রীড়ামোদীদের আকৃষ্ট করে আসছে।
শাহী ইদগাহ খেলার মাঠকে মিনি স্টেডিয়ামে রুপান্তরের ঘোষণা দেয়া হলেও তা ঘোষণা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে। এছাড়া প্রতিবছর কোরবাণী ঈদের আগে এখানে বসানো হয় পশুর হাট। প্রতিবছর আয়োজন করা হয় আন্তর্জাতিক বানিজ্য মেলার। এসব কারণে মাঠটি ব্যবহার করা সম্ভব হয় না খেলাধুলার প্রয়োজনে।
এছাড়া পাড়া মহল্লার মাঠগুলোও প্রায় বিলীন হয়ে গেছে।
জানা যায়, নগরীর মজুমদারীর মজুমদার বাড়ির মাঠ দখল হয়ে গেছে এক যুগের বেশি সময় আগে। সেখানে প্রথমে সালুটিকর বাসস্ট্যান্ড পরে দালান তোলায় এই মাঠের অস্তিত্ব এখন বিলীন।
পীরমহল্লার সৈয়দ জিলকদর আলীর মাঠে দালান তুলে এখন ইংরেজি মাধ্যমে স্কুল প্রতিষ্ঠা হয়েছে। পিটিআই এর মাঠ দেয়াল তুলে প্রবেশাধিকার সংরক্ষণ করে ফেলায় এখানে আর খেলাধুলার সুযোগ থাকেনি সাধারণদের। লাক্কাতুরা চা বাগানের অভ্যন্তরে থাকা গলফ ক্লাবের মাঠেও প্রাচীর তুলে দেওয়া হয়েছে। আম্বরখানা কলোনীর বিশাল মাঠ টিলা কাটা আর দখলে ক্রমেই সংকুচিত হয়ে এসেছে। একইভাবে বাদাম বাগিচার মাঠ, ছড়ারপার খেলার মাঠ, রাজবাড়ি খেলার মাঠ, লালদিঘীরপার গাছতলা মাঠসহ বেশিরভাগ মাঠে দালানসহ নানা স্থাপনা তুলে ফেলায় এগুলো এখন কেবলই স্মৃতি।
সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন সিলেটের আহ্বায়ক ও সিলেট চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক পরিচালক মুকির হোসেন চৌধুরী বলেন, খেলার মাঠ না থাকা আগামী প্রজন্মের জন্য হুমকীস্বরূপ।
একের পর এক মাঠ দখল হয়ে যাওয়ার খেলাধুলার পরিবেশ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে আমাদের প্রজন্ম। সরকারি ব্যবস্থাপনায় দু’একটি মাঠ থাকলেও সেখানে যখন তখন খেলাধূলা করতে পারছেনা ক্রীমামোদিরা। এই বিষয়টি বিবেচনা করে অবিলম্বে জেলা প্রশাসককে উদ্যোগ গ্রহণ করার আহবান জানান তিনি।