নিজস্ব প্রতিবেদক : করোনা ভাইরাস মহামারীর কারণে দেশব্যাপী দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল গণপরিবহন। পরে পরিস্থিতি বিবেচনায় ৫০ শতাংশ যাত্রী গণপরিবহন চালানোর অনুমতি দেয় সরকার। তবে শর্ত দেওয়া হয় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার। এর মধ্যে অন্যতম শর্ত ছিল হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহারের মাধ্যমে যাত্রীদের হাত জীবাণুমুক্ত করার।
কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, গণপরিবহনে যাত্রীদের জন্য যে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করা হচ্ছে দিন দিন তা মানহীন হয়ে পড়ছে। তারা বলেন, এখন যে জীবাণুনাশক হাতে স্প্রে করা হয়, তা রঙিন পানি ছাড়া আর কিছু নয়। কারণ সেগুলোর কোনও ঘ্রাণ নেই।
কেউ কেউ বলছেন, নাম মাত্র ডেটল, স্যাভলন কিংবা গুঁড়া সাবান মিশিয়ে ওইসব জীবাণুনাশক তৈরি করা হচ্ছে। সঙ্গে দেওয়া হচ্ছে রং।
অনেক বাসের হেলপারই বলতে পারেননি ওইসব জীবাণুনাশক কী দিয়ে তৈরি করা হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নকল সুরক্ষা পণ্যে বাজার সয়লাব হয়ে গেছে। এর মধ্যে পরিবহন সেক্টরের লোকজন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবে কিংবা আসল জিনিস কিনে যাত্রীসেবা দেবে সেটা ভাবাও খুব কঠিন। কারণ এ সেক্টরের লোকজনের নামে এমনিতেই অনেক বদনাম আছে।
রাজধানীর সচেতন নাগরিকরা গণমাধ্যমকে বলেন, গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি না মানার প্রবণতা বাড়তে বাড়তে এখন প্রায় মানাই হচ্ছে না। সে বিষয়ে কেউ কোনও ব্যবস্থাও নিচ্ছে না। বাসে যাতায়াত করা অনেক যাত্রীও স্বাস্থ্যবিধির ব্যাপারে খুবই উদাসীন। এ কারণে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ আরও অনেক বেড়ে যেতে পারে।
রাজধানীর বিভিন্ন রুটের বাসযাত্রীদের অভিযোগ, জীবাণুনাশকের নামে গণপরিবহনগুলোতে যাত্রীদের হাতে যা দেওয়া হচ্ছে তা নিছক রঙিন পানি ছাড়া অন্য কিছু নয়। এতে কোনও ঘ্রাণ নেই। কার্যকারিতাও নেই। এগুলো ব্যবহারে মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে কি না তাও দেখার কেউ নেই।
শুক্রবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত রাজধানীর বনানী, ফার্মগেট, বিশ্বরোড মোড়, ইসিবি চত্বর, কালশী মোড়, মিরপুর ১২, ১১, ১০, ৭, ৬, ২ ও ১ নম্বর এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বিভিন্ন রঙের পানির বোতল হাতে গণপরিবহনগুলোর গেটে দাঁড়িয়ে আছেন কন্ডাক্টররা। যাত্রীরা বাসে ওঠার সময় সেই রঙিন পানি তাদের হাত স্প্রে করা হচ্ছে। আর বলা হচ্ছে এটাই নাকি জীবাণুনাশক। পাশাপাশি মাস্ক ছাড়াই গণপরিবহনে যাত্রীদের চলাফেরা করতে দেখা যায়।
এ বিষয়ে পরিস্থান পরিবহন লিমিটেডের বাস চালক মো. সোহাগ বলেন, সড়কে বাস নিয়ে নামার আগে প্রতিটি সিটে আমরা জীবাণুনাশক স্প্রে করি। রাস্তায় যখন আমাদের ট্রিপ চলতে থাকে বাসের কন্ডাক্টর যাত্রীদের স্প্রে করে বাসে তোলেন। মালিক আমাদের স্প্রে দেন। কি দিয়ে বানিয়ে দেন বলতে পারি না। অন্য বাসে যাত্রীদের স্প্রে দেওয়া হয় কি না বলতে পারি না। কিন্তু আমার বাসে নিয়মিত যাত্রীদের জীবাণুনাশক দিয়ে স্প্রে করা হয়।
প্রজাপতি পরিবহন লিমিটেডের বাস কন্ডাক্টর মো. তানজিল হোসেন বলেন, আমাদের বাসে ওঠার সময় যাত্রীদের স্প্রে করা হয়। স্যাভলন ও হেক্সিসল দিয়ে বানানো হয়েছে এ স্প্রে। এটা দিয়ে হাত পরিষ্কার করলে দ্রুত জীবাণুমুক্ত হয়। টাকায় তো অনেক ধরনের জীবাণু থাকে। আমিও যেমন টাকা ধরছি, যাত্রীরাও ধরছেন। আমার মনে হয়, এ যে স্প্রে দিয়ে হাত পরিষ্কার করা হচ্ছে এটাতে জীবাণুমুক্ত হয়।
ফার্মগেটের উদ্দেশে বিকল্প পরিবহনে ওঠা মো. হোসেন বলেন, সাধারণ ছুটির পরে যখন সীমিত আকারে গণপরিবহন রাস্তায় নামানো হল তখন যেসব জীবাণুনাশক ছিটানো হচ্ছিল সেগুলো ভালো মানের ছিল। কিন্তু এখন কন্ডাক্টরের হাতে যা দেখি, তা বিভিন্ন রঙের পানি ছাড়া কিছু নয়। এতে কোনও ঘ্রাণ নেই। যতই দিন যাচ্ছে গণপরিবহনের জীবাণুনাশক স্প্রে’র মান ততই খারাপ হচ্ছে।
বনানী থেকে আল-মক্কা পরিবহনের একটি বাসে করে পল্টন যাচ্ছেন বেসরকারি কর্মকর্তা মো. ইরফান। তিনি বলেন, গণপরিবহনে উঠার সময় যেসব জীবানুনাশক ছিটানো হচ্ছে এগুলোর কোনও মানই নেই। এর আগে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নকল হ্যান্ড স্যানিটাইজার, মাস্কের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে দেখেছি। তবে গণপরিবহনের স্বাস্থ্যবিধির বিষয়ে এখন পর্যন্ত প্রশাসনের কাউকে দেখলাম না কোনও অভিযান চালাতে। যাত্রীদের কি দিয়ে স্প্রে করা হচ্ছে তা যাচাই-বাছাই করতে। আমার মনে হয়, বাসগুলোতে কী ধরনের সুরক্ষা নেওয়া হয় তা দেখতে অভিযান চালানো উচিত। তাহলে সব ঠিক হয়ে যাবে। পরিবহন মালিক ও সংশ্লিষ্টরা সবাই সচেতন হবে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. এস এম আব্দুর রহমান বলেন, শুধু গণপরিবহন নয়, জীবাণুনাশক যেসব চ্যানেল বা টানেল তৈরি করা হয়েছে এসবে ব্লিচিং পাউডার দিয়ে স্প্রে করা হয়। এর মধ্য দিয়ে মানুষ প্রবেশ করছে। যাতায়াতের সময় যদি কারও চোখে ব্লিচিং পাউডারের পানি প্রবেশ করে তাহলে ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা আছে। আমার ধারণা, ব্লিচিং পাউডার বা সাবানের গুড়া দিয়ে জীবাণুনাশক তৈরি করে তা গণপরিবহন যাত্রীদের হাতে স্প্রে করা হচ্ছে। এগুলো অস্বাস্থ্যকর ও ক্ষতিকারক।
স্যাভলন বা হেক্সিসল একসঙ্গে মিলিয়ে স্প্রে করা যাবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, দু’টি উপাদানের মিশ্রণ আলাদাভাবে ৫ লিটারকে ২৫ লিটার করা যাবে এতে কোনও সমস্যা হবে না। কিন্তু দু’টি পদার্থ একসঙ্গে ব্যবহার করার কোনও বৈজ্ঞানিক নিয়ম নেই। আলাদাভাবে ব্যবহার করা যাবে। দু’টি উপাদান একসঙ্গে ব্যবহার করলে জীবাণুনাশকের কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও স্প্রেতে যে রং ব্যবহার করা হচ্ছে এ সম্পর্কে তিনি বলেন, রং ব্যবহার সম্পূর্ণটাই প্রতারণা বলা যায়। এতে রঙের ব্যবহার বাধ্যতামূলক নয়। রঙের কোনও কাজ নেই। রং কোনও জীবাণুনাশক নয়। হ্যান্ড স্যানিটাইজারে রং ব্যবহার করা উচিত নয়। রংয়ের অন্তরালের সঠিক পরিমাণে জীবাণুনাশক দেওয়া হচ্ছে না। আমার মতে রঙের অন্তরালে প্রতারণা চলছে। গণপরিবহনে যেসব স্প্রে করা হচ্ছে, এসব স্প্রে শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের ভাটিক্যাল শরীরে প্রবেশ করছে। এটাও শরীরের যেকোনও ধরনের ক্ষতির কারণ হতে পারে। জীবাণুনাশক স্প্রে’র নামে যাত্রীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে। বাজারে যেসব নকল জীবাণুনাশক ছড়িয়ে পড়েছে তা খুব দ্রুত মনিটর করা দরকার। সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের ব্যবস্থা নেওয়া খুবই প্রয়োজন।