শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের টিউশন ফি নিয়ে দ্বন্দ্ব-ফ্যাসাদে জড়িয়ে পড়ছে অভিভাবক ও প্রতিষ্ঠানগুলো। করোনা ভাইরাসের কারণে সারাদেশে বন্ধ থাকা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো টিউশন ফি আদায়ে অভিভাবকদের ওপর অব্যাহতভাবে চাপ প্রয়োগ করে চলেছে। মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে এ বছর বার্ষিক পরীক্ষা না হওয়ার কারণে এখন শিক্ষার্থীরা অ্যাসাইনমেন্ট তৈরি করছে। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে- বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই অ্যাসাইনমেন্টকে ইস্যু করে শিক্ষার্থীদের জিম্মি করতে চাইছে। তাছাড়া করোনা মহামারির মধ্যেও অনেক প্রতিষ্ঠান ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত আগাম টিউশন ফি আদায় করছে। মাউশি, অভিভাবক এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টদের সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, করোনা মহামারিকালে সারাদেশের নিম্ন আয়ের অসংখ্য মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। মধ্যবিত্তের অনেকে চাকরি হারিয়েছে। বিগত ১৮ মার্চ থেকে সারাদেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। এ সংকটকালে বেতন-ফি আদায়ে চাপ প্রয়িাগ না করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা থাকলেও অনেক প্রতিষ্ঠানই তা মানছে না। বরং টিউশন ফিসহ অন্যান্য ফি জমা দিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে প্রতিনিয়তই অভিভাবকদের মোবাইলে এসএমএস পাঠানো হচ্ছে। এমনকি কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান ফোন করে তা পরিশোধের জন্য অভিভাবকদের চাপ দিচ্ছে এবং বকেয়া রাখলে পরবর্তী সময়ে জরিমানাও গুনতে হবে বলে সতর্ক করা হচ্ছে। রাজধানীর প্রায় সব বেসরকারি বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যম স্কুল নিয়েই অভিভাবকদের এমন অভিযোগ। এমনকি কখনো কখনো হুমকিও দেওয়া হচ্ছে বলেও অভিভাবকরা জানান। রাজধানীর অন্যতম নামিদামি প্রতিষ্ঠানের একটি মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ বেতন রকেট, নেক্সাস পেসহ ইত্যাদি মাধ্যমে আদায় করছে। এমন পরিস্থিতিতে কোনো কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা বকেয়া বেতন মওকুফের দাবিতে আন্দোলনে নামতেও বাধ্য হয়। অভিভাবকদের দাবি- করোনার কারণে অনেক অভিভাবক আর্থিক সংকটে রয়েছে। অনেকেই সন্তানের টিউশন-পরীক্ষার ফি পরিশোধ করতে পারছে না। অথচ স্কুল কর্তৃপক্ষ নানা অজুহাতে বকেয়া পরিশোধের জন্য প্রতিনিয়ত চাপ সৃষ্টি করে যাচ্ছে। বকেয়া পরিশোধ করতে না পারলে শিক্ষার্থীদের পরবর্তী ক্লাসে তোলা হবে না বলেও হুমকি দেয়া হচ্ছে।
সূত্র জানায়, সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশনা দিয়েছে- ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের শিখনফল মূল্যায়নে অ্যাসাইনমেন্ট গ্রহণের জন্য কোনো ফি আদায় করা যাবে না। করোনা ভাইরাস মহামারির মধ্যে এবার বার্ষিক পরীক্ষা না নিয়েই মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের ওপরের শ্রেণিতে তোলা হবে। তাছাড়া ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ঘাটতি পূরণের জন্য ৩০ কর্মদিবসে শেষ করা যায় এনসিটিবি এমন একটি সিলেবাস প্রণয়ন করেছে। ওই সিলেবাসের আলোকে শিক্ষার্থীদের প্রতি সপ্তাহে ৩টি করে অ্যাসাইনমেন্ট দেয়া হচ্ছে। যার উত্তর শিক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তক অনুসরণ করে লিখতে বলা হয়েছে। আর ওই অ্যাসাইনমেন্ট মূল্যায়ন করেই শিক্ষার্থীদের ঘাটতিগুলো চিহ্নিত করে পরবর্তী ক্লাসে তা পূরণের চেষ্টা করা হবে বলে শিক্ষামন্ত্রী আগেই জানিয়েছেন।
সূত্র আরো জানায়, শিক্ষার্থীদের মাসিক টিউশন ফি নিয়ে অভিভাবকদের সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দ্বন্দ্ব ও দূরত্ব ঘোচাতে খুবই শিগগির সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা জারি করতে যাচ্ছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। তাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি সুস্পষ্টভাবে দুটি নির্দেশনা থাকবে বলে জানা যায়। তার মধ্যে প্রথমত কোনো অতিরিক্ত ফি আদায় করা যাবে না এবং দ্বিতীয়ত অসচ্ছল, দরিদ্র ও করোনার কারণে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত এমন অভিভাবকদের ফি মওকুফ অথবা আংশিকভাবে ছাড় দিতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে টিউশন ফি’র বিষয়ে শিগগির এ নির্দেশনা জারি হতে যাচ্ছে। পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলে টিউশন ফি আদায়ের একটি গাইডলাইনও তৈরি করা হচ্ছে। তাতে শিক্ষার্থীদের মাসিক বেতনের সঙ্গে বার্ষিক মিলাদ মাহফিল ফি, বিদ্যুৎ, পানির বিল, ল্যাব ফি, খেলাধুলা ফি, বার্ষিক ক্রীড়া, বার্ষিক শিক্ষা সফরসহ বিভিন্ন ধরনের ফি বাতিল করা হবে। করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওসব টাকা আদায়ের কোনো প্রয়োজন নেই। তবে মাউশির নির্দেশনায় শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতনের স্বার্থে শুধুমাত্র টিউশন ফি আদায় করতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে বলা হবে। সেজন্য ঢাকাসহ দেশের জেলা শহরগুলোর শীর্ষপর্যায়ের স্কুল-কলেজ থেকে ইতিমধ্যে তথ্যও সংগ্রহ করা হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভেদে নানা ধরনের অতিরিক্ত ফি চিহ্নিত করে তা বাতিলের জন্যও এ নির্দেশনা জারি করা হবে।
এদিকে এ প্রসঙ্গে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান মু. জিয়াউল হক জানান, বার বার বলা হয়েছে টিউশন ফি আদায়ে কোনো প্রকারের জোরজবরদস্তি করা যাবে না। চাপ প্রয়োগ করা যাবে না। কারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কোনো ব্যবসার জায়গা নয়, আর তা মাথায় রেখে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে হবে।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ গোলাম ফারুক জানান, খুব শিগগিরই টিউশন ফি-সংক্রান্ত নির্দেশনা জারি করা হবে। তার ভিত্তিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তৃপক্ষ বেতন-ভাতা আদায় করবে। মাউশির পক্ষ থেকে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। কোন প্রতিষ্ঠানে কত টাকা আদায় করা হয় তা চিহ্নিত করা হয়েছে। তার আলোকে প্রতিষ্ঠানভিত্তিক টিউশন ফির সঙ্গে অতিরিক্ত ফি সব বাদ দিয়ে আদায় করতে বলা হবে। আর নির্দেশনা জারির আগে যেসব প্রতিষ্ঠান অর্থ আদায় করবে, তাদের পরবর্তী মাসের টিউশন ফির সঙ্গে অর্থ সমন্বয় করতে বলা হবে। শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতনভাতা ও প্রতিষ্ঠান চালাতে অর্থের প্রয়োজন রয়েছে। তবে অভিভাবকদের যারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হননি, তারা সম্পূর্ণ টিউশন ফি পরিশোধ করবেন বলে মহাপরিচালক আশা প্রকাশ করেন।
এ প্রসঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন জানান, টিউশন ফি নিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অভিভাবক উভয় পক্ষকেই সহনশীল হতে হবে। অভিভাবকরা ফি না দিলে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা কীভাবে হবে। তবে একথাও সত্য যে করোনার কারণে বহু অভিভাবকের আয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের ক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেও মানবিক হতে হবে। এ বিষয়ে শিগগিরই একটি নির্দেশনা দেয়া হবে।
প্রতিষ্ঠাতা : মেজর (অব) মোঃ মোদাচ্ছের হোসাইন, সম্পাদক মন্ডলির সভাপতি: বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুজ্জামান আহমেদ এমপি, ব্যবস্থাপনা সম্পাদক: তৌহিদ আহমেদে রেজা, বার্তা সম্পাদক: আসমা আহমেদ কর্তৃক ৫৪ কামাল আতাতুর্ক এভিনিউ সৈয়দ ভবন, ঢাকা-১২১৩ থেকে সম্পাদিত ও প্রকাশিত
© All rights reserved 2020 Daily Surjodoy