1. admin@surjodoy.com : Main : Admin Main
  2. dainiksurjodoy24@gmail.com : admin2020 : TOWHID AHAMMED REZA
  3. editor@surjodoy.com : Daily Surjodoy : Daily Surjodoy
ঢাকা মেল ট্রেন ১৯৫০
মঙ্গলবার, ২২ এপ্রিল ২০২৫, ০৫:৫৪ পূর্বাহ্ন

ঢাকা মেল ট্রেন ১৯৫০

  • আপডেট টাইম : শনিবার, ১৮ জুলাই, ২০২০, ৬.৫০ পিএম
  • ২৫৮ বার পঠিত
নিজস্ব প্রতিবেদকঃ
ঢাকা মেল ট্রেন,১৯৫০ ২৬ শে ফেব্রুয়ারি, ১৪ ফাল্গুন, রবিবার। কলিকাতা শহরময় উত্তেজনা ও আশংকা। শিয়ালদহ স্টেশনে দিনরাত ভীড়; অপেক্ষমান পূর্ব বাংলার হাজার হাজার লােক স্টেশনে হত্যা দিয়া পড়িয়া আছেন কখন কোন ট্রেন আসে তাহার জন্য। ট্রেনে হয়ত বা আত্মীয়-স্বজন প্রাণে বাঁচিয়া কোনমতে কলিকাতা আসিয়া পৌছিতেও পারেন, কিংবা অন্তত প্রতিবেশীর কাছে খবরটুকুও পাওয়া যাইবে। কিন্তু ট্রেন আর আসে না। ঢাকা মেলে পূর্ববাংলার বহু জেলার লােক আসিয়া থাকে। মেল ট্রেন প্রাতে ৭টায় শিয়ালদহ পৌছে। কিন্তু সেদিন ট্রেন আসিল না। ট্রেনের চিহ্নও নাই। সারাদিন গেল। লােকজন নিরাশ হইয়া কিছু কিছু ফিরিয়া গেল। সন্ধ্যায় সন্ধ্যায় একখানা ট্রেন শিয়ালদহ স্টেশনে ধীরে ধীরে প্রবেশ করিল। জনতার ভীড় আগাইয়া গেল। প্ল্যাটফর্মে দৌড়াদৌড়ি, ঠেলাঠেলি, ডাকাডাকি, কোলাহল। কিন্তু কই?
যাত্রী অতি নামমাত্র সংখ্যায় নামিল। তাদের মুখে ভয়, উদ্বেগ ও অসহায়তার ছাপ, চোখে বিহুল দৃষ্টি। অস্ফুট কণ্ঠে বলে, ট্রেন আক্রান্ত হইয়াছিল। কোথায় কে গেল জানিনা। রাত্রির অন্ধকারে ভীষণ কাণ্ড হইয়াছে। সঙ্গে সঙ্গে দেখা গেল, ট্রেন প্রায় শূন্য আসিয়াছে, বহু কামরা ভাঙ্গা, বাথরুম দরজা জানালা চূর্ণবিচূর্ণ, বহু স্থানে রক্তের দাগ, শূন্য কামরায় কামরায় লােক নেই, কিন্তু বিছানা পাতা, জুতা স্লিপার স্যান্ডেলের স্তূপ, শাঁখা ভাঙ্গা ছড়ানাে, ট্র্যাংক ও অন্যান্য মালপত্র। যাত্রী নাই, কিন্তু মালিকহীন এইসব মালপত্র একটা ভয়ংকর হত্যাকাণ্ডের নীরবসাক্ষ্য হইয়া পড়িয়া রহিয়াছে। এ কী কাণ্ড! স্টেশনের ভীড় চঞ্চল হইয়া উঠিল। কামরায় কামরার যাইয়া এই দৃশ্য দেখিয়া সকলে হাহাকার করিয়া উঠিল। রেল-পুলিশ মালিকহীন মালপত্র স্টেশনের পুলিশ-অফিসে নামাইয়া রাখিল। বড় কর্তারা আসে কিন্তু যাহা হইবার হইয়া গিয়াছে, তখন প্রতিকার কোথায় ? উত্তেজিত জনতা দাবি করে, এই ট্রেন লইয়া দর্শনা স্টেশনে, (প্রথম পাকিস্তানের ঘাঁটি) যাইব, সেখানে হিন্দু যাত্রী নামাইয়া রাখিয়াছে, নিহতদের শবদেহ নামাইয়া রাখিয়াছে, উদ্ধার করিতে হইবে। কিন্তু কে শােনে এ দাবি? এই ট্রেনখানিই রাত দশটায় সেদিনই ঢাকা (আপ) মেল হইয়া গােয়ালন্দে ফিরিয়া যাইবার কথা। কর্তৃপক্ষ ট্রেন বন্ধ করিলেন, কারণ ভাঙ্গাচোরা গাড়ী দেখাইয়া উল্টা পাকিস্তানী সরকারই মিথ্যা কথা বলিয়া বসিবে, দেখ, দেখ, হিন্দুরা আক্রমণ করিয়া ট্রেনের মুসLমান হত্যা করিয়াছে। কলকাতায় সে রাত্রে উত্তেজনা ও আতংক। ঘটনাটা এইরূপ ঘটিয়াছিল। ২৫ শে ফেব্রুয়ারি রাতারাতি যে সব হিন্দু-যাত্রী ষ্টীমারে গােয়ালন্দ পৌছিল তাহারা হস্তদন্ত হইয়া ট্রেনে উঠিতে গেল। আনসার কুলীদের অত্যাচার, প্রতি মালপিছু অসম্ভব হারে টাকা ঘুষ দেওয়া, অপমান, সব পার হইয়া যারা ট্রেনে উঠিয়াছে, তাহার নিশ্চিন্ত হইল, বিপদ পার হইয়াছে। সকলেই গাদাগাদি হইয়া ট্রেন ছাড়িবার প্রতীক্ষা করিতে লাগিল। যত শীঘ্র ছাড়ে ততই মঙ্গল। যাত্রীদের মধ্যে নারীর সংখ্যাই বেশি। ১০-১৫ মিঃ এর সময়ে ট্রেন ছাড়িবার সময়, ছাড়িল রাত ১২টায়। রাত প্রায় ১টায় রাজবাড়ী পৌছিল। রাজবাড়ী হইতে গাড়ি ছাড়িয়া ২০ মিঃ পরেই হঠাৎ গাড়ি এক বিস্তীর্ণ মাঠে জঙ্গলের ধারে থামিয়া গেল। মিনিট কয়েক সব চুপচাপ। যাত্রীদের ভয়ে শ্বাস রুদ্ধ হইয়া আসিল, কী সর্বনাশ! মাঠের মধ্যে গাড়ি থামিল কেন? কিন্তু হঠাৎ নিঃশব্দতা ভেদ করিয়া একটা কোলাহল আকাশ ছাইয়া ফেলিল। সাথে সাথেই যাত্রীদের কান্নাকাটি ফাটিয়া পড়িল। গােলমাল ক্রমেই কাছে আসিতে লাগিল। কামরায় কামরায় দরজা-জানালা বন্ধ করিয়া ট্রাংক বিছানাপত্র প্রভৃতি দিয়া চাপা দেওয়া হইল। দুর্বৃত্তদের একদল গােয়ালন্দ হইতে পিছু লইয়া ট্রেনে আসিতেছিল। নির্দিষ্ট স্থান সূর্যনগরের কাছে আসামাত্র শিকল টানিয়া গাড়ি থামাইয়াছে। সঙ্গে সঙ্গে পাশের জঙ্গলে অপর দল যাহারা অপেক্ষা করিয়া ছিল, তাহার দৌড়াইয়া আসিয়া ট্রেন আক্রমণ করিল। মেয়ে-গাড়ী এবং যে সব কামরায় স্ত্রীলােক বেশী ছিল, সেই সব কামরারই আক্রমণ বেশী হইল। অস্ত্র শস্ত্র তরবারি দিয়া কাচ, দরজা ভাঙ্গিয়া ফেলিতে লাগিল, পাথর বর্ষণ করিতে লাগিল। কোন কামরায় হিন্দুরা ভিতর হইতে সকাতরে বলিতে লাগিল, এ কামরায় সব মুসLমান। এখানে আসিও না। হাতে-পায়ে ধরিয়া হিন্দুরা মুসLমানদের ভিতর থেকে কোরআন পাঠ করিতে মিনতি করিল, যাহাতে বাহিরের দুবৃত্তরা মুসLমান মনে করিয়া ফিরিয়া যায়। কোরাণ পাঠ হইল, হিন্দুরাও মুখে মুখে বলিতে লাগিল। হিন্দু নারীরা ভয়ে শাখা ভাঙ্গিয়া সিন্দুরও মুছিয়া ফেলিল, পুরুষরা লুঙ্গি পাজামা পরিল। কিন্তু হায় সবই বৃথা হইল। অষ্টমী রাতের আবছা চাঁদের আলােতে তখন দলে দলে দুর্বৃত্তেরা বলপূর্বক গাড়ী হইতে যাত্রিদের নামাইতেছে, দূরে কোন নির্দিষ্ট স্থানে হাঁটাইয়া নিয়া যাইতেছে। অনেককে আঘাত করিয়া খুন করিয়া ফেলিতেছে। সঙ্গে সঙ্গে গাড়ীর মালপত্র গহনা টাকাকড়ি লুঠ করিতেছে। কেহ কেহ প্রাণভয়ে জানলা দিয়া লাফাইয়া পড়িয়া অদূরে জঙ্গলে পলাইয়া প্রাণ বাঁচাইতে পারিল। কত পরিবারের পুরুষ, স্ত্রীলােক, বালক শিশু পরস্পর হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া গেল। মুসলমান দুর্বৃত্তেরা লুঠতরাজ হত্যার সঙ্গে সঙ্গে বলাবলি করিতেছে, হিন্দুস্তান আমাদের সব মুস্লিম ভাইদের মারিয়া ফেলিল, আমরা একটা হিন্দুকে যাইতে দিব না, সব মারিয়া ফেল, ইত্যাদি। আধ ঘণ্টা ধরিয়া এই নৃশংস কাণ্ড চলে। তারপরে সব শাস্ত হয়। মৃতদেহ নিশ্বাস বায়ু এবং আহতদের কাতরােক্তি শূন্যে মিলাইয়া যায়। লুষ্ঠিত মাল ও অপহৃত নারীদের লইয়া দুর্বত্তেরা পলাইয়া যায়। গাড়ি ছাড়ে। কিন্তু দুই মিনিট পর আবার গাড়ি থামিয়া গেল। আবার চলে সেইরূপ অত্যাচার। পাঁচ মিনিট পরে আবার গাড়ী ছাড়িল। পরবর্তি স্টেশন কালুখালিতে আসিয়া পৌঁছিল। এত বড় কাণ্ড দীর্ঘকাল ধরিয়া চলিল; কিন্তু কর্তৃপক্ষ প্রতিবাদ করিল না, রেল বা পুলিশ কর্মচারীরা নীরব। গাড়ীর সঙ্গে পূর্ববঙ্গ সরকার জাঁক করিয়া গার্ড দিয়াছেন, হিন্দুদের রক্ষার্থে। এই গাড়িতে গার্ডের কামরায় তিনটি বাঙালী মুস্লিম পুলিশ ছিল। আক্রমণ শেষ হইয়া দুর্বতেরা নিরাপদে চলিয়া যাওয়ার পরে এই পুলিশ পুঙ্গবত্রয় মাত্র দুবার ফাকা আওয়াজ করিয়া পূর্ববঙ্গ সরকারের মুখরক্ষা করিল। তিনজন বন্দুকধারী যদি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হইয়া দুর্বৃত্তদের বাধা দিয়া গুলি ছুড়িত, তবে লাঠি-তরবারধারী দুর্বৃত্তেরা ব্যর্থমনােরথ হইত, হিন্দুরাও রক্ষা পাইত। কিন্তু তাহা হইবার নয়। পুলিশ, আনসার, রেল কর্মচারি এই যড়যন্ত্রে অংশী ছিল বলিয়াই এইরূপ কাণ্ড সম্ভব হইয়াছিল। পরে পুলিশ-ত্রয় এই হাস্যকর জবাবদিহি করিয়াছিল যে গাড়ী হইতে যাত্রীরা নামিয়া ভীড় হওয়ায় দুর্বৃত্তদের চিনিতে পারে নাই। রাত্রি ২ টা হইতে পরদিন রবিবার প্রাতঃকালে ৬ টা পর্যন্ত আক্রান্ত মেল ট্রেনখানিকে কালুখালিতে থামাইয়া রাখা হয়। ট্রেন ছাড়িবার আগে ভােরবেলা দেখা গেল কয়েকজন হিন্দু যাত্রী ভীতত্রস্ত হইয়া ট্রেনের দিকে দৌড়াইয়া আসিতেছে। তাহারা রাত্রিতে জঙ্গলে লুকাইয়া প্রাণ বাঁচাইয়া এক্ষণে আবার ট্রেনে উঠিল। এদিকে কালুখালির স্থানীয় মুসLমানরা, চেকার, গার্ড, পুলিশ সকলে আসিয়া হিন্দু-যাত্রিদের বুঝাইতে চেষ্টা করে, মাত্র ৪৫ জন ডাকাত ডাকাতি করিয়াছে, কোন লােক হত্যা, অপহরণ করে নাই, লুষ্ঠন করিয়া গিয়াছে, আর মুসLমানের মালও লইয়া গিয়াছে ইত্যাদি। ইহারা এই মর্মে অর্থাৎ সাধারণ ডাকাতি হইয়াছে বলিয়া—হিন্দুদের বিবৃতি লিখিয়া দিতে পীড়াপীড়ি করিতে লাগিল। ভয়ে কেহ বিবৃতি দিয়াছে কিনা, জানা যায়নি। বেলা ১২টায় দর্শনায় গাড়ি পৌছিল। এখানে পাক কর্মচারীরা মালপত্র তল্লাসী করিল। মালিকহীন মালপত্র শুল্ক কর্মচারিরা অনেক নামাইয়া রাখিল। কিছু মাল গােলমালের সুযােগে আবার চুরি ও লুঠ হইয়া যায়। গাড়ির গার্ড বলেন, গাড়ী ভারতে যাইবে না, সুতরাং সকলের গােয়ালন্দে ফিরিয়া যাওয়া উচিত। শােনা গেল, কলিকাতা হইতে আসাম মেল নিরাপদে না আসিয়া পৌছিলে, এই ঢাকা মেলকে কলিকাতা যাইতে দেওয়া হইবে না। ইহার পর আসাম মেল (কলিকাতা হইতে) বেলা ৩টায় পাস করিয়া গেল। ঢাকা মেলকেও ছাড়িয়া দেওয়া হইল। বেলা ৩ টায় ছাড়িয়া গাড়িখানি বেলা ৫টা ৫০ মিনিটে শিয়ালদহ পৌছিল। ঐদিনের ঢাকা মিক্সট ট্রেন দুর্বৃত্তদের হাত হইতে রেহাই পায় নাই। প্রায় রাত্রি ১টায় (২৫ ফেব্রুয়ারি) গােয়ালন্দ হইতে ছাড়িয়া মিস্ ট্রেনখানি রাত্রি ৩টায় কালুখালি আসিয়া পৌছে। তখন লুষ্ঠিত পূর্বোক্ত ঢাকা মেল কালুখালিতেই দাঁড়াইয়া ছিল, মিকস্ট-যাত্রীরা দেখিতে পাইল। কিছুক্ষণ আগেই সূর্যনগরে মেল ট্রেন আক্রান্ত হইয়া আসিয়াছে। মিকস্ট যাত্রীরা রাত্রি ২টায় সূর্যনগর (ঘটনাস্থলে) ছাড়াইয়া যাইবার কালে তাহাদের ট্রেনের সব বাতি হঠাৎ নিভাইয়া দেওয়া হয়। পরে বেলগাছি স্টেশনে ট্রেন থামিলে পাঁচজন মহিলা ও দুজন পুরুষ জঙ্গল হইতে বাহির হইয়া দৌড়াইয়া আসিয়া মিকস্ট ট্রেনে ওঠে। ইহারা কিছু আগে ঢাকা মেল হইতে পলাইয়া জঙ্গলে প্রাণ বাঁচায়, পরে কালুখালিতে এই গাড়িতে ব্যাক করিয়া ভাটিয়াপাড়া লাইনে সকাল ৭টা পর্যন্ত (অর্থাৎ ঢাকা মেলখানি ছাড়িবার পর পর্যন্ত) আটকাইয়া রাখা হয়। প্রাতে ৮টায় কুষ্টিয়া পৌছিয়া ইহারা দেখিল, ঢাকা মেল তখনাে দাঁড়িয়ে আছে, কাম বায় রক্ত বস্ত্রে ব্যান্ডেজবাধা বহু যাত্রী বসিয়া আছে। মুসLমানরা চেঁচাইয়া বলিতেছে, প্রাণের ভয় থাকিলে মুসLমানরা যেন কলিকাতা না যায়। মুসLমান নেমে পড়। অনেক মুসলমান যাত্রী ট্রেন হইতে নামিয়া পড়িল। দর্শনায় গাড়ি আসিলে দেখা যায় দুজন কর্মচারি জিজ্ঞাসা করিতেছেন, যজ্ঞেশ্বর রায় ও দুজন মেয়ে নিখোঁজ, তাহারা মিকস্ট-ট্রেনে আছে কি? দর্শনায় আসিয়া আরাে দেখা গেল, মিকস্ট গাড়ির একখানা কামরা রাত্রিতে আক্রান্ত হইয়াছিল এবং কামরায় যাত্রীরা নিখোঁজ ও কামরায় স্তুপীকৃত পড়িয়া রহিয়াছে ট্রাংক, বিছানা, মেয়েদের স্লিপার, বাসনপত্র প্রভৃতি মালিকহীন অবস্থায় পড়িয়া। পরে এসব মালিকহীন মালপত্র পুলিশ নামাইয়া রাখে। সন্ধ্যা ৭টায় মিকস্ট গাড়ি শিয়ালদহ পৌছে। শূন্য কামরায় যাত্রিরা কোথায়, নারীদের কি হইল, কেহ জানেনা। পুলিশ জিজ্ঞাসা করিল, কিন্তু কে বলিবে? সেদিন মেল ট্রেনের (এবং মিকস্ট ট্রেনের) ঘটনার পূর্ণ ও সঠিক বিবরণ কে বলিতে পারিবে? প্রাণ বাঁচাইয়া যাহারা আসিয়াছে, তাহারা কেহ জানে না, কত লােককে ও কাহাদের কোন কামরা হইতে নামাইয়া হত্যা করিয়াছে, কে কাহাকে চিনে? এক কামরার খবর অন্য কামরার যাত্রী বলিতে পারে না। অন্ধকারে নির্জন মাঠে ও জঙ্গলের মধ্যে কে কোথায় ঠিকরাইয়া পড়িয়াছে কেউ জানেনা। কান্না হাহাকার ও হট্টগোলের মধ্যে সেদিনকার সব কথাই চিরদিনের জন্য অন্ধকারে চাপা পড়িয়া থাকিল। সামান্য দু-একটি খবর কেবল বহির্জগতে আসিয়া পৌছিতে পারিয়াছে।
জয়ন্ত দাশগুপ্তের রচনায় ‘জয়শ্রী’ পত্রিকার পাতা থেকে সংগৃহীত। পশ্চিমবঙ্গে কি প্রতিক্রিয়া হয়েছিলো?? সরােজ চক্রবর্তী লিখছেন,একদিন সন্ধ্যাবেলা রাইটার্স থেকে ফিরে ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় জানতে পারলেন যে, বনগা সীমান্ত থেকে শিয়ালদহ স্টেশনে যে গাড়ি এসেছে, তার কয়েকটি কামরায় যাত্রী ছিল না; ছিল মেয়েদের হাতের বালা ও শাখার ভাঙা টুকরাে, ছেঁড়া শাড়ি ও রক্তাক্ত মানুষের মৃতদেহ। ডাঃ রায় তৎক্ষণাৎ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ফোনে কথা বললেন। আমরা যারা একতলায় ছিলাম, তারাও ফোনে ডঃ রায়ের উত্তপ্ত কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। তিনি প্রধানমন্ত্রীকে বলছিলেন যে তাঁর পক্ষে আর এদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে রক্ষা করা সম্ভব হবে না। যুদ্ধ ছাড়া এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে না। তার ধৈর্যের সীমা ছাড়িয়েছে। কলকাতা অগ্নিগর্ভ, হাওড়ার অবস্থা ভয়াবহ, সেনা নামাতে হচ্ছে।
স্বভাবই, হিন্দুর বধ্যভুমিতে পরিণত হওয়া পূর্ববঙ্গের ঘটনাবলী কলকাতা ও তদসংলগ্ন অঞ্চলের মানুষজনের মধ্যে নিদারুণ ক্ষোভের সৃষ্টি করে৷আরব সাম্রাজ্যবাদী ভুমি দস্যুদের ‘দুগুণা দত্তার,চৌগুণা জুজার’ দেওয়ার দৃঢ়সংকল্পে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ রাস্তায় নামেন৷কিন্তু,ঢাল হয়ে দাঁড়ালেন পন্ডিতজি’৷১৯৫০ এ নেহরু-লিয়াকত চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর নিরাপত্তার আশ্বাস পেয়ে কাতারে কাতারে মুসLমান পশ্চিমবঙ্গে ফেরত আসে৷ তাদের বিষয় সম্পত্তি ফিরে পাওয়ানোর ব্যাবস্থা করেছিলেন নেহেরু স্বয়ং৷হিন্দুরা পূর্ববঙ্গে ফিরে যেতে পারেন নি৷নেহেরুর মুসLমানের প্রতি দায়বদ্ধতা থাকতে পারে, লিয়াকতের হিন্দুদের প্রতি কি দায়বদ্ধতা আছে?! আমরা যারা ‘All is well’ ভেবে  নিজেরাই নিজেদের সাথে প্রতারনা করছি,অতীতের ছায়া অবধি দেখতে অস্বীকার করছি,ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে তো?
তথ্যসুত্র:১.১৯৫০ রক্তরঞ্জিত ঢাকা বরিশাল এবং,দীনেশচন্দ্র সিংহ ২.প্রান্তিক মানব,প্রফুল্ল কুমার চক্রবর্তী আমগো একখান দ্যাশ আসিল থেকে সংগৃহীত ব্যাক্তি নয়।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

© All rights reserved  2020 Daily Surjodoy
Theme Customized BY CreativeNews