তফিকুল ইসলাম,কালাই,উপজেলা প্রতিনিধিঃ-
দুই পায়ে পরানো হয়েছে লোহার চাকতি লাগানো শিকল ও বাই-সাইকেলের চেইন। আর সেই শিকলে ও চেইনে লাগলো হয়েছে বড় তালা। দিনে বাড়ির উঠানের কাঁঠাল গাছের সাথে আর রাতে ঘরে চৌকির সঙ্গে বেঁধে রাখা হয় তাদেকে। আর এভাবেই অর্থাভাবে চিকিৎসা করাতে না পেরে প্রিয় দুই সন্তানকে প্রায় এক যুগ ধরে পায়ে লোহার শিকল ও চেইন লাগিয়ে বেঁধে রাখেন হতদরিদ্র মা রওশন আরা।
দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত এই পরিবারটি তিনবেলা যেখানে আহারই জোটাতে অক্ষম, সেখানে সন্তানদের চিকিৎসা করাবেন কিভাবে। অর্থের অভাবে তাদের চিকিৎসা কারানো মম্ভব হচ্ছেনা। তাদের নাম মেয়ে আম্বিয়া বেগম (২৬) ও ছেলে রোস্তম আলী (২৪)। প্রায় এক যুগ ধরে তারা দুজনেই মানসিক ভারসাম্যহীন। তবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক মনে করেন-উন্নত পরিবেশে দীর্ঘ মেয়াদী চিকিৎসাসেবা দেওয়া হলে আবারো স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সম্ভাবনা রয়েছে তাদের।
জানা গেছে,-জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার মাত্রাই ইউনিয়নের বিয়ালা গ্রামের আতার পাড়া সরকারী আশ্রয়ন প্রকল্পের বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম ও রওশন আরা দম্পত্তির মানসিক ভারসাম্যহীন বড় মেয়ে মোছা.আম্বিয়া বেগম ও মেঝ ছেলে মো. রোস্তম আলী। উপজেলা সদর থেকে আকা-বাকা রাস্তা দিয়ে বাইকে চরে বা কখনো পায়ে হেটে প্রায় ২২ কিলোমিটার দূরে সম্প্রতি কালে সরকারী আশ্রয়ন প্রকল্পের ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ভাঙ্গা টিনের বেড়া এবং টিনের ছাউনি দেওয়া ঘরে শিকলবন্দী অবস্থায় দু-ধারে বসে আছেন আম্বিয়া বেগম ও রোস্তম আলী। সেই ঘরে আছে একটি চৌকি,একটি চেয়ার ও একটি টেবিল। চৌকির ওপর ছেঁড়া ও আধা ভেজা কাঁথায় দু-ধারে জড়সড় হয়ে বসে ছিলেন তারা। আম্বিয়া বেগমের পরনে ছিল ছেঁড়া ময়লা ফ্রক,পায়জামা সেই সঙ্গে কোনমতে মাথার উপরে একটুকর ওড়না আর রোস্তম আলী পরনে ছিল ছেঁড়া ময়লা শার্ট ও লুঙ্গি। ঘরে কেউ ঢুকলেই তাঁর নাকে লাগবে দুর্গন্ধ। তাদের প্রসাব-পায়খানা সারতে হয় ঘরের পাশেই। চেয়ারে রাখা ছেঁড়া ও ময়লা কাঁথা দুর্গন্ধে ভরা।
তাদের পায়ে লাগানো লোহার শিকল ও বাই-সাইকেলের চেইন। দিনের বেলা কাঁঠাল গাছের সঙ্গে বাঁধা সেই শিকল ও চেইন। আর রাতে বেলা ঘরে চৌকির সঙ্গে দু-ধারে বেঁধে রাখা হয় তাদেরকে। প্রায় ১০ ফুটের শিকলে এক যুগ ধরে এভাবেই বাঁধা মানসিক ভারসাম্যহীন আম্বিয়া বেগম (২৬) এবং রোস্তম আলীর (২৪) জীবন। সেখানে তাদেরকে কেউ খাবার খাইয়ে দিলে তাদের ক্ষুধা মেটে, নতুবা থাকতে হয় উপোস।
সেখানে কথা হলো আম্বিয়া ও রোস্তমের মা রওশন আরা সঙ্গে। তিনি অশ্রুসিক্ত নয়নে বলেন, আমার স্বামী রফিকুল ইসলাম একজন দিন মজুরের কাজ করে। আর আমি গৃহিনী। তবে সংসারের অর্থ স্বচ্ছতার জন্য অন্যের বাড়িতে মাঝে মধ্যে ঝিঁ-এর কাজ করি। প্রায় ২৮ বছর পূর্বে আমাদের বিবাহ হয়। এরই মধ্যে আমাদের সংসারে ছেলে-মেয়ে জন্ম হয়।
আমার বড় মেয়ে মোছা.আম্বিয়া বেগম যখন বারো বছরের কিশোরী, ঠিক তখনই দেখা দেয় তার আচরণে অস্বাভাবিকতা। সে সময় স্থানীয় কবিরাজের পরামর্শে কিশোরী আম্বিয়াকে পার্শ্ববর্তী গ্রামের দিনমজুর মনোয়ারের সাথে বিয়ে দেই। কিন্তু বিধি বাম, মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে তার আচরণগত সমস্যা আরো বেশী খারাপ হতে থাকে। এ অবস্থায় তাকে বগুড়া, পাবনা ও রংপুরে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করানো হয়। কিন্তু তার দীর্ঘ মেয়াদী চিকিৎসা করা সম্ভব হয়নি। এর মধ্যে আমাদের সংসারের একমাত্র ছেলে রোস্তমও ১২ বৎসর বয়সে আর দশজন ছেলের তুলনায় ভিন্ন রকম আচরণ শুরু করে। এই দেখে তাকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া হলেও টাকা-পয়সার অভাবে তারও চিকিৎসা বন্ধ করতে হয়েছে।
পরে সে স্থানীয় বাসিন্দাসহ বিভিন্ন প্রাণীকে মারধর করতে শুরু করে। আমার ঘরের জিনিসপত্র ভাঙ্গচুর করাসহ পরিবারের সদস্য ও স্বজনদের কাছে পেলেই তাঁদের মারধর শুরু করে। অনেক সময় বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলে তারা আর সময় মত বাড়িতে ফিরে আসেনা। আমার দুই সন্তান যেন আমাদেরকে ছেড়ে দূরে কোথাও না যায়, সেই আতঙ্কেই প্রায় ১২ বছর ধরে ঘরের মধ্যে কখনো বাড়ির উঠানে কাঠাল গাছের সাথে পায়ে শিকল লাগিয়ে তাদেরকে বেঁধে রাখতে বাঁধ্য হয়েছি। এসব দুশ্চিন্তার কারনে বর্তমান তাদের বাবা রফিকুল ইসলামও প্রায় পাগল। আমার সংসারে এতো অশান্তি থাকায় আমি কি করব তা আমার মাথায় কোন কাজ করছেনা। এই বলে তিনি হাও..মাও করে কেঁদে উঠলেন।
প্রতিবেশী ইয়াকুব আলি বলেন, মানসিক ভারসাম্যহীন আম্বিয়া বেগম ও রোস্তম আলীসহ মা-বাবা একসঙ্গে থাকেন। তারা খুব অসহায়। অর্থের অভাবে তার চিকিৎসা করতে পারছেন না। তবে সু-চিকিৎসা করাতে পারলে তারা খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবে।
আরেক প্রতিবেশী কুলসুম বেগম (৪৫) বলেন, তাদের পরিবারের প্রায় সবাই এখন পাগল। শুধু তাদের মা তাদেরকে দেখভাল করে। অভাবের কারণে তারা ঠিকমতো খেতেও পারেন না। অনেক সময় তাদেরকে ছেড়ে দিলে কোথাও গেলে আর বাড়ি ফিরে আসতে চায়না। তাই তাদের পায়ে শিকল দিয়ে গাছে বেঁধে রাখতে হয়।
উপজেলার মাত্রাই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আ.ন.ম.শওকত হাবিব তালুকদার লজিক বলেন, তাদেরকে প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ড করে দেওয়া হয়েছে। এর পাশাপাশি ওই দুই ছেলে-মেয়েকে সু-চিকিৎসার জন্য সহায়তা পাওয়ার ব্যাপারে সার্বিক চেষ্টা করা হচ্ছে।
কালাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার ডা. শাহিন রেজা বলেন, আমার জানা মতে আম্বিয়া বেগম ও রোস্তম আলীকে উন্নত পরিবেশে রেখে দীর্ঘ মেয়াদী চিকিৎসাসেবা দেওয়া হলে আবারো তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সম্ভাবনা রয়েছে।
কালাই উপজেলা নির্বাহী অফিসার টুকটুক তালুকদার বলেন, খবর পেয়ে আমি নিজেই ওই দুই ভাই-বোনের বাসায় গিয়ে খোঁজ খবর নিয়েছি এবং তাদের পরিবারের হাতে কিছু নগদ অর্থও দেওয়া হয়েছে। তাদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তির বিষয়ে তাদের কিছু কাগজপত্র প্রয়োজন আছে। তার পরিবারকে খুব দ্রæত সেই কাগজ-পত্র জমা দিতে বলা হয়েছে। জমা দিলেই প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের চিকিৎসার জন্য পাবনা মানসিক হাসপাতালে পাঠানো হবে।
Like this:
Like Loading...
Related
এ জাতীয় আরো খবর..