দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম ভাসমান বাজারে এসব দৃশ্য খুবই সাধারণ ঘটনা। বরিশাল শহর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে এই বাজারের অবস্থান। সন্ধ্যা নদীকে পেছনে ফেলে ভীমরুলির দিকে এগিয়ে গেলেই পৌঁছে যাবেন এই বাজারে। পেয়ারা বোঝাই সারি সারি নৌকা দেখেই বুঝবেন, আপনি ভাসমান বাজারের ঠিক পথেই আছেন!
আষাঢ়, শ্রাবণ ও ভাদ্র মাসে জমে উঠে ভীমরুলি খালে ভাসমান পেয়ারার হাট। এসময় পাকা পেয়ারার মৌ-মৌ গন্ধ নিতে এবং সবুজের সমারোহ দেখতে আসে দেশ ও বিদেশের বহু মানুষ। প্রথমবারের মতো কেউ ঘুরতে গেলে মনে করতে পারেন, এটা স্থানীয় আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার অংশগ্রহণে কোনো নৌকা বাইচ। কিন্তু কিছু সময়ের মধ্যেই বোঝা যাবে যে না এটি কোনো প্রতিযোগিতা নয়। এখানে ঢেউয়ের তালে চলে বেচাকেনা। শুধু বাণিজ্যই হয় না, এটি এখন জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্রও বটে।
বৃহত্তম পেয়ারা বাগান
প্রায় শত বছর ধরে বাণিজ্যিকভাবে পেয়ারা চাষ হয়ে আসছে ঝালকাঠি ও পিরোজপুরে। ঝালকাঠির কৃত্তিপাশা, ভীমরুলি, শতদাসকাঠি, খাজুরা, মিরাকাঠি, ডুমুরিয়া, জগদীশপুর, খোদ্রপাড়া, পোষণ্ডা, হিমানন্দকাঠি, বেতরা ও কাপড়কাঠিতে সবচেয়ে বেশি পেয়ারা চাষ হয়। বাংলার আপেলের চাহিদা পূরণ করে পিরোজপুরের স্বরূপকাঠির আটঘর কুড়িয়ানার চাষিরাও।
জানা গেছে, ঝালকাঠির ৬৫০ হেক্টর বিস্তৃত এসব বাগানে প্রতিবছরই কোটি কোটি টাকার পেয়ারা উৎপাদিত হয়। বরিশাল, পিরোজপুর ও ঝালকাঠি জেলার ৩০ টি গ্রামের ২০ হাজার পরিবার পেয়ারা চাষের কাজে নিয়োজিত। ৩১ হাজার একর জমির উপর প্রায় ৭ হাজার পেয়ারা ও আমড়া বাগান রয়েছে বলে জানান স্থানীয়রা।
মূল বাজার আটঘর কুড়িয়ানায়
ভীমরুলি, আটঘর ও কুড়িয়ানা—তিনটি জায়গায় বসে ভাসমান পেয়ারার বাজার। তবে পেয়ারার আসল কেনাবেচা হয় আটঘর কুড়িয়ানায়। পাইকারি ব্যবসায়ীরা বড় বড় ইঞ্জিন বোট নিয়ে সেখানে হাজির হয়ে পেয়ারা কিনেন। পেয়ারা কেনা হয় নৌকা হিসেবে কিংবা মন হিসেবে। মজার বিষয়, এখানে আসা সব নৌকার আকার আর ডিজাইন প্রায় একইরকম। মনে হয় যেন একই কারিগরের তৈরি সব নৌকা।
বর্ষা মৌসুমে এলাকার নৌকার কারিগরেরা কিছুটা বাড়তি উপার্জন করে থাকেন। প্রায় ২ কিলোমিটার দীর্ঘ এই ভাসমান বাজারে বিভিন্ন ধরনের নৌকা কেনাবেচাও হয়। পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠি উপজেলার কুড়িয়ানা গ্রামে সাপ্তাহিক নৌকার হাটে এই কেনাবেচা হয়ে থাকে।
বরিশালের আমড়ার খ্যাতি শোনেনি, এমন খুব কম মানুষ আছে। পেয়ারা আর ইক্ষুর মৌসুম শেষ হলে বাজারে আসে আমগা। এ অঞ্চলে আমড়ার ফলনও সর্বত্র। আমড়ার মৌসুমেও বেশ জমজমাট থাকে এই বাজার। আর সবশেষে আসে সুপারি। সবজি তো আছেই। মোট কথা, সারাবছরই বেচাকেনা চলে এই বাজারে।
পর্যটনকেন্দ্র হিসেবেও অনন্য
এই ভাসমান হাট পুরো বাংলাদেশেই অনন্য। দক্ষিণাঞ্চলের পেয়ারা বাগান ও ভাসমান পেয়ারাহাট হিসেবে ভীমরুলি বিখ্যাত। খালের দু’পাশে ব্যবসায়ীদের আড়ৎ। অন্যদিকে এর সঙ্গে মৌসুমের অপূর্ব এই প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসেন ভ্রমণ পিপাসুরা। শুধু দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকেই নয়, প্রবাসী ও বিদেশি অতিথিরাও আসেন উপভোগ করতে।
ভীমরুলীতে ভাসমান এ পেয়ারা হাট পরিদর্শন করেন ২০১৮ সালে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত হর্ষবর্ধন শ্রীংলা। গত ১১ জুলাই পরিদর্শন করেন বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল রবার্ট মিলার। পরিদর্শনকালে তিনি বলেন, থাইল্যান্ড-ভিয়েতনামের বিভিন্ন বড় বড় শহরে এমন জলে-ভাসা বাজারের দেখা মেলে। কিন্তু বাংলাদেশের একটি প্রত্যন্ত গ্রামে জলেভাসা বাজার-হাট গড়ে ওঠা সত্যিই অবাক করার মতো। তাও আবার জমজমাট হাট।
আর্ল রবার্ট মিলার বলেন, এটি দেখতে সত্যিই চমৎকার! অদ্ভুত সুন্দর এই ভাসমান হাটটি। তার আশপাশের প্রকৃতি ও পরিবেশ যে কতটা নজরকাড়া হতে পারে, এটি এখানে না এলে বোঝার উপায় নেই।
প্রতিষ্ঠাতা : মেজর (অব) মোঃ মোদাচ্ছের হোসাইন, সম্পাদক মন্ডলির সভাপতি: বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুজ্জামান আহমেদ এমপি, ব্যবস্থাপনা সম্পাদক: তৌহিদ আহমেদে রেজা, বার্তা সম্পাদক: আসমা আহমেদ কর্তৃক ৫৪ কামাল আতাতুর্ক এভিনিউ সৈয়দ ভবন, ঢাকা-১২১৩ থেকে সম্পাদিত ও প্রকাশিত
© All rights reserved 2020 Daily Surjodoy