আরিফুর রহমান দোলন: অসম্ভব কঠিন অনুশাসনে আমাকে ছোট থেকে বড় করে তুলেছেন আব্বা। বলতে গেলে এক্ষেত্রে আব্বার ‘জিরো টলারেন্স’ ছিল অন্য সবার কাছে চোখে পড়ার মতো। আদর, স্নেহের প্রকাশ যে কঠিন শাসনের মধ্যেই নিহিত- আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি এক্ষেত্রে আমার আব্বা ছিলেন সামনের কাতারের উদাহারণ। সম্ভবত, আব্বার শাসনের ভয়ে ছোটবেলা থেকে লেখাপড়ায় কম ফাঁকি দিয়েছি। আব্বার কঠোর অনুশাসনের প্রভাবেই আমি শতভাগ নন অ্যালকহলিক ও অধূমপায়ী। প্রাইমারী স্কুল থেকে এই অব্দি এই যে প্রত্যুষে ঘুম থেকে ওঠা অভ্যাস সেটাও আব্বার তৈরি করে দেওয়া। অসীম ভালোবাসা আর স্নেহের পরশ না বলা কথার মাধ্যমে আমার মশারি টাঙ্গিয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে ছোট ছোট কাজের মাধ্যমে এত সুচারুরূপে আব্বা করতেন যে মুখে আসলেই কিছু বলতে হতো না।
ছোটবেলায় মিষ্টান্ন ভীষণ পছন্দ ছিল আমার। ভীষণ মিষ্টি পাগল ছিলাম। আব্বা তখন রূপালী ব্যাংক আলফাডাঙ্গায়, পোস্টিং ওঁনার। খুব সম্ভবত আমি ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ি। আলফাডাঙ্গার অনিল কুন্ডুর মিষ্টি তখন রীতিমতো বিখ্যাত, জনপ্রিয়। দোকানে একদিন নিয়ে গেলেন আব্বা। দোকান মালিক, অনিল কাকাকে বললেন- এই যে আমার ছেলে। যতবার আসবে, যতদিন আসবে যা চাইবে দিয়ে দেবেন বিনা প্রশ্নে আর লিখে রাখবেন। মাস শেষে আমি সব শোধ করবো। সম্ভবত, অনিল কাকার বাকির খাতায় সেই ছোটবেলায় এভাবেই আব্বার পরিবর্তে আমার নামই উঠে গিয়েছিল। বেতনের প্রথম টাকাটাই শোধ হতো অনিল কাকার দোকানে।
এস.এস.সি পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হলাম ‘৯০ সালে। উত্তর ছাত্রাবাসের আবাসিক ছাত্র আমি। এখনকার মতো তখন ইন্টারনেট ব্যাংকিং বা দ্রুততম সময়ে টাকা পাঠানো যেতো না। ব্যবসায়ীরা টি.টি বা ডি.ডি’র মাধ্যমে ব্যবসায়িক লেনদেন করতেন। একমাত্র সন্তান যেন টাকার কষ্টে এক মুহুর্ত না থাকে তাই আমায় টাকা পাঠানোর ক্ষেত্রেও আব্বা টি.টি বা ডি.ডি ব্যবহার করতেন। যাতে দিনে দিনে টাকা পেয়ে যাই। মিষ্টান্ন পাগল ছেলের জন্য ঠিকই হিসেব করে প্রতি মাসে ৭/৮ শত টাকা বাড়তি পাঠাতেন যাতে অনিল কাকার দোকানের বিকল্প পেতে আমার বিন্দুমাত্র অসুবিধে না হয়। কলকাতা পড়াকালীন আমায় টাকা পাঠানোর একাধিক বিকল্প পথ খুঁজতে কত মানুষকেই না আব্বা সারা বছর সার্ভিস দিয়েছেন। আমার পছন্দ অপছন্দটাই তাঁর কাছে শেষ কথা ছিল- সব সময়।
চোখের বিরল রোগ গ্লুকোমায় আক্রান্ত হওয়ার পর ভিতরে ভিতরে বেশ ভেঙ্গে পড়েন আব্বা। ঢাকা ও কলকাতার চিকিৎসকেরা অভিন্ন মত দেন, ৯০ ভাগ দৃষ্টিশক্তি নেই। তবু নিয়ম করে আব্বা পত্রিকা পড়তেন। সাংবাদিক হিসেবে আমার যতটুকু নাম সেটাতো প্রথম আলো দিয়েই। তাই যেখানেই থাকবেন একবার প্রথম আলোতে চোখ বোলানো তাঁর নিত্যকার অভ্যেসে পরিণত হয়। এরপর বাংলাদেশ প্রতিদিনে যেহেতু উপসম্পাদক হিসেবে আমার হাড়ভাঙ্গা খাঁটুনি দেখেছেন তাই রোজ ওই পত্রিকাও আব্বার পড়া চাইই চাই। রূপালী ব্যাংক থেকে সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার হিসেবে অবসর নিয়ে সারাক্ষণ কাজ পাগল আমার শ্রদ্ধেয় পিতা কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেলেন। এক সময়ে রীতিমতো জিদই ধরলেন এর চেয়ে গ্রামে বসবাসই শ্রেয়। ঢাকায় থাকাকালীন প্রতিবছর মোটামুটি নিয়ম করেই আব্বা-আম্মার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতাম। কখনোই হৃদরোগের লক্ষণও বোঝা যায়নি, চিকিৎসকেরাও বলেননি এমন কিছু। কর্মজীবনে অনেক স্বজন, পরিচিত আর ঘনিষ্ঠজনের হৃদরোগসহ নানা রোগের চিকিৎসা নিজের কাঁধে টেনে নিয়েছি। আমার অগোচরে এ বিষয়ে নিজের উচ্ছ্বাস অন্যদের কাছে প্রকাশ করতেন। একমাত্র ছেলে সমাজের, দেশের ও দশের কিছু কাজে আসছে- এই আনন্দ বার্তা অন্যদের দিতেন। আমি ঠিকই আবার সেই খবর পেয়ে যেতাম। আরও উৎসাহিত হতাম। জীবদ্দশায় প্রায়শই একটি কথা আব্বা আমার আম্মাকে বলতেন, ‘তোমার ছেলে অতি মানবিক, অতিমাত্রায় আবেগী এবং মানুষ চেনেনা।’ আমি হেসে উড়িয়ে দিতাম। কখনো বা আব্বার পর্যবেক্ষণ সঠিক নয় ‘লোক চেনার ক্ষেত্রে’ তাও বলতাম।
কিন্তু আব্বাই আসলে সঠিক। শতভাগ সঠিক। বিভিন্নজন সম্পর্কে আব্বার যে পর্যবেক্ষণ তাঁর অবর্তমানে আজ অনেক বেশিই তা মিলে যায়। ২০১৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর ভোরে পরলোকে চলে গেছেন আমার আব্বা, এ.এফ.এম ওবায়দুর রহমান। একেবারেই আকস্মিক ছিল প্রয়াণ। গভীর রাতে বুকে ব্যথা আর ভোরেই প্রয়াণ। চিকিৎসা করানোর সুযোগটিও পাইনি। এই যন্ত্রণা হয়তো সারাজীবনই বয়ে বেড়াবে আমাকে। আব্বা প্রয়াত-এটাই হয়তো সত্য। কিন্তু তাঁর দেখানো ইতিবাচক পথ ধরেই চলবো। হ্যাঁ, আমি অনেক অনেক সরি আব্বা। জীবদ্দশায় সব বোঝা যায়না হয়তো। আপনি গত হওয়ার পর আপনার অভাবটা বড্ড বেশি বুঝতে পারি। আজ ৩০ ডিসেম্বার, ২০২০। আব্বার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী।
পরলোকে অনেক অনেক ভালো থাকবেন শ্রদ্ধেয় পিতা। সবাই আমার আব্বার মাগফেরাতের জন্য দোয়া করবেন।
লেখক: সম্পাদক ঢাকা টাইমস।