বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক মাদক পাচারকারী চক্র ট্রানজিট রুট হিসাবে ব্যবহার করছে। তারা এদেশ দিয়ে বিভিন্ন দেশে কোটি কোটি টাকার কোকেন, এমফিটামিনক, ইয়াবা, হেরোইন, ফেনইথাইলামিনসহ মূল্যবান ও প্রাণঘাতী মাদক পাচারে লিপ্ত। অথচ ওসব মাদক বাংলাদেশে উৎপন্ন হয় না। এদেশ দিয়ে কোটি কোটি টাকা মূল্যের । অথচ এই ধরনের মূল্যবান ও প্রাণঘাতী মাদক বাংলাদেশে উৎপন্ন হয় না। কিন্তু বাংলাদেশে আটক হচ্ছে ওসব মাদকের চালান। আটক মাদকের চালানগুলো মিয়ানমার, ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে এসেছে এবং গন্তব্য ছিল মধ্যপ্রাচ্য, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশ। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে একাধিক মূল্যবান মাদকের চালান ধরা পড়লেও ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে এর সঙ্গে জড়িত গডফাদাররা। ধরা পড়ছে কেবল বাহকরা। আর আইনের ফাঁকফোকর গলে ধরা পড়া বাহকরা সহজেই জামিনে বের হয়ে আসছে। জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের (আইএনসিবি) বার্ষিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে প্রবিশেী দেশগুলোর মাদক পাচারের ট্রানজিট দেশ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ও পুলিশ সদর দফতর সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, আন্তর্জাতিক মাদক পাচারকারী চক্র ভারত ও মিয়ানমারের রুট ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় বাংলাদেশকে রুট হিসেবে বেছে নিয়েছে। মাদক উৎপাদনকারী দেশগুলোর মাদক ব্যবসায়ীরা প্রতিবেশী দেশগুলো ইউরোপের বিভিন্ন দেশে হেরোইন পাচারের জন্য বাংলাদেশকে গুরুত্ব¡পূর্ণ ট্রানজিট রুট হিসাবে ব্যবহার করে। অথচ বাংলাদেশ মাদক উৎপাদনকারী দেশ নয়। মূলত ইরান, পাকিস্তান ও ভারতের মতো দেশ আন্তর্জাতিকভাবে আফিমের একটি বড় বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। আর দক্ষিণ-পূর্ব ও পূর্ব এশিয়ায় যতো আফিম আসে তার প্রধান সরবরাহকারী মিয়ানমার। তাছাড়া আফগানিস্তান বর্তমান বিশ্বের ৯০ শতাংশ আফিম উৎপাদন করে এবং ৮৫ শতাংশ হেরোইন ও মরফিন তৈরি করে। পাকিস্তান থেকে কুরিয়ারে, ভারত থেকে বাণিজ্যিক মোটরযান ও ট্রেনে এবং মিয়ানমার থেকে বঙ্গোপসাগর দিয়ে অথবা ট্রাক ও পাবলিক পরিবহনে করে বাংলাদেশে হেরোইন আনা হয়। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়েই বাংলাদেশ থেকে অধিকাংশ হেরোইন অন্যান্য দেশের উদ্দেশে পাচার হয়।
সূত্র জানায়, অতিসম্প্রতি ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সৌদিগামী রেডিমেট গার্মেন্টসের রফতানি পণ্য চালানের ৩টি কার্টন থেকে ৩৮ হাজার ৯শ’ পিস ইয়াবা জব্দ করা হয়েছে। যার বাজারমূল্য প্রায় এক কোটি ১৬ লাখ টাকা। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ঢাকা কাস্টম হাউসের প্রিভেন্টিভ দল ও সিভিল এভিয়েশন যৌথ অভিযানে ইয়াবার ওই চালান জব্দ করে। সৌদি আরবে আটককৃত ইয়াবা পাচার করা হচ্ছিল। এখন আন্তর্জাতিক মাদক পাচারকারীর সঙ্গে কারা কিভাবে জড়িত সে বিষয়ে তদন্ত চলছে। তার আগে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ১২ কেজি ৩২০ গ্রাম নতুন মাদক এ্যামফিটামিন উদ্ধার করা হয়েছিল। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর কর্তৃপক্ষ এ্যামফিটামিনক উদ্ধারের ঘটনায় মোট ৭ জনকে গ্রেফতার করেছে। গেস্খফতারকৃতরা জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, তারা দীর্ঘদিন ধরে ভারতীয় চক্রের সঙ্গে যোগসাজশে ১২ কেজি ৩২০ গ্রাম এ্যামফিটামিন পাউডার পাচারের জন্য সীমান্ত এলাকা বেনাপোল দিয়ে বাংলাদেশে আমদানি করেছিল। বাংলাদেশকে রুট হিসেবে ব্যবহার করে পাচারকারীরা ভারত থেকে এ্যামফিটামিন সংগ্রহ করে তৈরি পোশাকের কার্টনের মধ্যে বিশেষ প্রক্রিয়ায় কার্বনের লেয়ার দিয়ে ক্যাভিটি তৈরি করে মাদকদ্রব্য মালয়েশিয়া হয়ে অস্ট্রেলিয়া পাচারের চেষ্টা করছিল। ওই মাদক চালানের সঙ্গে যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে ইতিমধ্যে তারা জামিনে বের হয়ে গেছে বলে জানা যায়।
সূত্র আরো জানায়, বিগত ৫ বছরে এদেশে অন্তত ৭টি কোকেনের চালান আটক করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক মাদক পাচারকারী চক্র চট্টগ্রাম থেকে ওসব কোকেন পাচারের জন্য এনেছিল। কিন্তু মাদকের চালান ধরা পড়লেও গডফাদাররা ধরা পড়েনি। ধরা পড়েছে শুধুমাত্র বাহকরা। ফলে বাহককে আসামি করে মামলাগুলোর অভিযোগপত্র দেয়া হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরেই কোকেনসহ মাদক পাচারের ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে চট্টগ্রাম। কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রাম হয়ে সারাদেশে ইয়াবা পাচার হয়। এ কারণে চট্টগ্রামে প্রতিদিনই ইয়াবা ধরা পড়ছে। এমনকি দামী মাদক কোকেনও ধরা পড়ছে। তাছাড়া গত ১২ আগস্ট চট্টগ্রামে প্রথমবারের মতো ধরা পড়েছে ফেনইথাইলামিন নামের এক বিশেষ ধরনের মাদক, যা দেখতে কোকেনের মতো। তবে এটি কোকেনের চেয়ে দামী। ২০১৮ সালের অক্টোবরে ফেনইথাইলামিন মাদকদ্রব্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আর উদ্ধার হওয়া মাদকের মূল্য প্রায় ১২ কোটি টাকা। তাছাড়া চট্টগ্রাম বন্দরে কোকেনের সবচেয়ে বড় চালান ধরা পড়ে। ঘটনাটি ঘটে ২০১৫ সালের ৬ জুন মাসে। সূর্যমুখী তেলের চালান জব্দ করে ১০৭টি ড্রামের মধ্যে একটি ড্রামের নমুনায় কোকেন শনাক্ত হয়। জব্দ করা ৩৭০ লিটার কোকেনের মূল্য ছিল ৯ হাজার কোটি টাকা। তরল কোকেনকে গুঁড়া বা পাউডার কোকেনে রূপান্তর করার মতো প্রযুক্তি বা যন্ত্রপাতি বাংলাদেশে নেই। ওই চালানটি উরুগুয়ের মন্টিভিডিও থেকে জাহাজীকরণ করা হয়। পরে তা সিঙ্গাপুর হয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে আসে।
এদিকে এদেশ দিয়ে মাদক পাচার প্রসঙ্গে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রন অধিদফতরের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশে ইয়াবা বা হেরোইন মাদক সেবন করা হয়। কিন্তু কোকেন, এমফিটামিনক বা ফেনইথাইলামিন মাদক বাংলাদেশে সেবনের লোক খুঁজে পাওয়া যায় না। দু-একজনের সামর্থ্য থাকলেও তারা আসক্ত নয়। মূলত ট্রানজিট হিসেবে চট্টগ্রামে কোকেনগুলো আসে। সেখান থেকে অন্য দেশে পাচার হয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক মাদক পাচারকারী চক্রের গডফাদাররা ধরা ছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে। এ কারণে কোন দেশ থেকে কারা কিভাবে বাংলাদেশে মূল্যবান প্রাণঘাতী মাদক আনছে আবার কোন দেশে পাচার করছে তার বেশিরভাগ মাদক চালানই শনাক্তের বাইরে থেকে যাচ্ছে।
প্রতিষ্ঠাতা : মেজর (অব) মোঃ মোদাচ্ছের হোসাইন, সম্পাদক মন্ডলির সভাপতি: বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুজ্জামান আহমেদ এমপি, ব্যবস্থাপনা সম্পাদক: তৌহিদ আহমেদে রেজা, বার্তা সম্পাদক: আসমা আহমেদ কর্তৃক ৫৪ কামাল আতাতুর্ক এভিনিউ সৈয়দ ভবন, ঢাকা-১২১৩ থেকে সম্পাদিত ও প্রকাশিত
© All rights reserved 2020 Daily Surjodoy