চট্টগ্রাম প্রতিনিধি
সড়ক ও জনপথ বিভাগের চট্টগ্রাম কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী পিন্টু চাকমার বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠার পর পোর্ট এক্সেস রোড়ের টোল আদায়ে অনিয়ম আড়াল করতে অফিসে বসেই সার্ভে রিপোর্ট তৈরি করার প্রমাণ মিলেছে। জনৈক কারিমুল মওলা পোর্ট এক্সেস রোড়ের টোল আদায়ে অনিয়মের বিষয়ে লিখিত অভিযোগ জমা দেয় বিভিন্ন দপ্তরে। ঠিকাদার নিয়োগ না করে বিভাগীয় ব্যবস্থাপনায় টোল আদায়ের নামে প্রতিদিন এক লক্ষ বিশ হাজার টাকা লুটপাটের অভিযোগ তুলেন নির্বাহী প্রকৌশলী পিন্টু চাকমার বিরুদ্ধে।
এই বিষয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ হলে দৈনিক এই রোডে চলাচল করা প্রকৃত গাড়ির সংখ্যা নিয়ে সার্ভে করার নির্দেশ দেয়া হয়। গত সপ্তাহের সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে সার্ভে টিমের প্রতিনিধিদের টোল প়াজার আশপাশে দেখা যায় নি। সুত্রমতে, বছর জুড়ে টোল আদায়ের মাধ্যমে লুটপাটের অনিয়মের তথ্য আড়াল করতে সার্ভে প্রতিবেদন তৈরি করা হচ্ছে সড়ক ও জনপথের কার্যালয়ে বসেই। এই বিষয়ে সড়ক ও জনপথ বিভাগের কোন কর্মকর্তা কথা বলতে রাজি হন নি। তবে তাদের দাবি ২০২২ সালের ২৪ শে এপ্রিল পোর্ট এক্সেস রোড়ের টোল আদায়ের ইজারার মেয়াদ শেষ হবার কারণে বিভাগীয় ব্যবস্থাপনায় টোল আদায় করা হচ্ছে। শিগ্রই টোল প্লাজার ইজারার জন্য দরপত্র আহবান করা হবে।
বর্তমানে টোল আদায়ের বিষয়টি তদারকি করছেন জনৈক সাদ্দাম হোসেন। তিনি জানান, নির্বাহী প্রকৌশলী পিন্টু চাকমার নির্দেশে টোল আদায় করা হচ্ছে। প্রতিদিন হাজিরার ভিত্তিতে পাঁচশ টাকা মজুরী পাচ্ছেন। সওজের ফয়সল আবদুল্লাহ নামের অন্য এক প্রকৌশলী টাকা সংগ্রহ করছেন। ১২ জন কর্মচারীর বেতন হাজিরার ভিত্তিতে দেয়া হচ্ছে। '
সাদ্দাম জানান, আদায়কৃত টোল থেকে গত তিন মাসে দেনিক গড়ে ৭২ হাজার থেকে ৯৫ হাজার পর্যন্ত রাজস্ব জমা করা হয়েছে।
গেল সপ্তাহের কথিত সার্ভের সময়ে সরেজমিনে গিয়ে টোল রোডে জরিপ চালানো সার্ভে টিমের প্রতিনিধিদের দেখা মেলেনি। কর্মচারীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, সার্ভে করার জন্য কোন টিম স্পটেই যায় নি।
সওজের নির্বাহী প্রকৌশলী পিন্টু চাকমা গণমাধ্যমকে জানান, ইজারার মেয়াদ শেষ হবার কারণে বিভাগীয় ব্যবস্থাপনায় টোল আদায় করা হচ্ছে। রাজস্ব কমে যাবার কারণ হিসেবে পাশ্ববর্তী ইসাক ডিপোর অবৈধ পার্কিংসহ বিকল্প রোড় গড়ে উঠাকে দায়ি করেছেন তিনি। টোল আদায়ের জন্য নিয়োজিত কর্মচারীদের মাস্টার রোলে নিয়োগ দেয়া হয়েছে দাবি করেন তিনির।'
টোল আদায়ের জন্য নিয়োজিত কর্মকর্তা কর্মচারীদের বেতন সড়ক ও জনপথ বিভাগ থেকে দেয়া হচ্ছে বলে দাবি করা হলেও ২০২২ সালের মে মাস থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত বেতন প্রদান বাবত ভাউচার দেখানো হলেও বিস্তারিত কোন হিসাবের তথ্য মেলেনি। সুত্রমতে, অভিযোগ উঠার পর তড়িঘড়ি করে ২০২৩ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারীর ভাউচার তৈরি করা হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে , চট্টগ্রামের পোর্ট এক্সেস রোডের টোল আদায়ে, কোটি কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। পুরো প্রক্রিয়ার জন্য নির্বাহী প্রকৌশলী পিন্টু চাকমাকে দায়ি করেছেন সংশ্লিষ্টরা । চট্টগ্রাম সড়ক ও জনপথ বিভাগের অধীনে ভাড়াটে টোল আদায়কারীরা নানা কৌশলে টোলের সিংহভাগ টাকা রাজস্ব খাতে জমা না দিয়ে নিজেদের পকেট ভর্তি করে আসছেন এক বছরের বেশি সময় ধরে। সুত্রমতে গত কয়েক বছরে প্রকৃত অংক অতিরিক্ত অন্তত নয় কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে ।
কারিউল মওলা লিখিত অভিযোগ জমা দেয় সড়ক ও সেতু মন্ত্রীর দপ্তরে। সড়ক ও জনপথ বিভাগের কার্যালয়ে অভিযোগের অনুলিপি দেয়া হলে সার্ভে প্রতিবেদন তৈরির নির্দেশনা আসে প্রধান কার্যালয় থেকে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, চট্টগ্রাম সড়ক ও জনপথ বিভাগের মাশুল আদায় কার্যক্রমে সংস্থাটির কোন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ না করে নিয়োগ দেয়া হয়েছে বেসরকারী জনবল। সংস্থাটির কাছে এভাবে টোল মাশুল আদায় কাজ পরিচালনার জন্য নিয়োজিত লোকবলের জন্য কোন সরকারী আদেশ নেই।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী পিন্টু চাকমা টোল আদায়ের বিষয়ে সবকিছু জানেন। টোল আদায়ের জন্য ইউডিসি ভান নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে সড়ক ও জনপথ বিভাগ থেকে ইজারা দেয়া হয় ২০১৮ সালে। তবে সেই মেয়াদ গত বছরের ২৪ শে মার্চে শেষ হয়ে গেছে। '
কাগজে কলমে মাশুল আদায় করছে সড়ক বিভাগ চট্টগ্রাম, এমন তথ্য দেয়া হলেও বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। চট্টগ্রাম সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী পিন্টু চাকমা কৌশলে পুরো বিষয়টি আড়াল করে নিজের মনোনীত জনবল দিয়ে টোল আদায় কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে প্রায় দেড় বছর ধরে। ফলে সরকার প্রকৃত টোল আদায়ের পরিমান থেকে বিপুল অংকের রাজস্ব আদায় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। প্রকৃত আদায়কৃত টোল থেকে প্রতিদিন এক লাখ বিশ হাজার টাকা করে বছরে ৪ কোটি ৩৮ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে।
বেসরকারি একটি জরিপকারী প্রতিষ্ঠানের তথ্যমতে প্রতিদিন নূন্যতম গড়ে সাত থেকে আট হাজার গাড়ি এ রাস্তা দিয়ে চলাচল করে, এর বেশিরভাগই ট্যাঙ্কার, লরী, কাভারভ্যান, ট্রাক, পিকাপ। সেই হিসেবে এই টোল হতে দৈনিক আদায়কৃত মাশুলের পরিমাণ আনুমানিক ৩ লক্ষাধিক টাকার বেশি হলেও কার্যত গড়ে আশি হাজার টাকা সরকারী কোষাগারে জমা দিয়ে হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে অন্তত তিন লাখ টাকা ।
সেতু মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে,২০১৪ সালের টোল নীতিমালার ১৪ ধারা অনুযায়ী সড়ক ও জনপদ অধিদপ্তরের নিজস্ব জনবলের মাধ্যমে টোল আদায়ের পদ্ধতি থাকলেও টাকা বানানোর মেশিন হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে সেই নীতিমালাকে । নীতিমালারর তোয়াক্কা না করে পূর্বের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের লোকবল দিয়ে টোল আদায়ের কার্যক্রম চলাচ্ছেন নির্বাহী প্রকৌশলী পিন্টু চাকমা । এভাবে সড়ক ও জনপদ বিভাগের নাম ভাঙ্গিয়ে বছর বছর হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে কোটি কোটি টাকা ৷এরআগে একই নির্বাহী প্রকৌশলী পিন্টু চাকমার সহযোগিতায় কাজ শুরু না করেই দুইটি প্রকল্প প্রায় চার কোটি টাকা তুলে নেয় দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এমন অভিযোগ মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হলেও পার পেয়ে জান তিনি।
টোল আদায়ের তথ্য অনুযায়ী পোর্ট এক্সেস রোড়ের টোলের ইজারা শুরু হয় ২০১৮ সালে ২৪ শে ডিসেম্বর। আর শেষ হয় ২৩ শে ডিসেম্বর ২০২১ সালে। ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারী মাস পর্যন্ত সড়ক বিভাগের ব্যবস্থাপনায় নিজের লোক দিয়ে টোল আদায় করছেন নির্বাহী প্রকৌশলী পিন্টু চাকমা। ১৯ মাসে (৫৭৯ দিন) পোর্ট এক্সেস রোডের টোল বাবত জমা দেওয়া হয়েছে পাঁচ কোটি ৬৬ লাখ ২১ হাজার টাকা।
অভিযোগ উঠেছর অপারেশন এন্ড মেইনটেইননেস ( O& M) পদ্ধতিতে টোল আদায়ের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা লুটপাট করা হয়েছে। নথি অনুযায়ী ২০২১ সালের ডিসেম্বর (২৩ ডি) মাসে ইজারার মেয়াদ শেষ হয়। সেই মাসে আয় দেখানো হয়েছে ৩৫,৮৬,০০০/-। পরিবর্তী বছরের ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে আয় দেখানো হয়েছে ২৩,২২,০০০ টাকা। ২০২১ সালের নভেম্বর মাসে ৩১৩২০০০ টাকা রাজস্ব আয় দেখানো হয়েছিলো ; নিজস্ব ব্যবস্থাপনার নামে পিন্টু চাকমা ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে ২৫,৩৬০০০ টোল আদায় দেখিয়েছেন। ২০২১ সালের অক্টোবর ইজারাদার ৩৫২৫০০০ টাকা টোল আদায় দেখিয়েছিলেন। পরবর্তী বছরের একই মাসে ২৪, ৪৬ ০০০ টাকা আদায় হয়েছে সড়ক ও জনপদ বিভাগের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায়।
অনুসন্ধানে জানা যায় টোল আদায়ের সাথে সম্পৃক্ত কর্মচারীদের বেতন পরিশোধের কোন নথি নেই হিসাব বিভাগে। কিন্তু নির্বাহী প্রকৌশলী পিন্টু চাকমার দাবি মাস্টার রোলে কর্মচারীদের নিয়োগ ও বেতন দেয়া হচ্ছে। এই সংক্রান্ত কোন অফিস আদেশে দুইমাস করে অনুমোদন আনা হয়েছে, কাদের নিয়োগ করা হয়েছে সেটি দেখাতে সক্ষম হন নি তিনি। সুত্রমতে, টোল আদায়ে অনিয়মের অভিযোগ উঠার পর ২০২৩ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারী মাসে টোল আদায়ের সাথে সম্পৃক্ত কর্মচারীদের বেতন বাবত ভাউচার তৈরি করা হয়েছে।
প্রতিষ্ঠাতা : মেজর (অব) মোঃ মোদাচ্ছের হোসাইন, সম্পাদক মন্ডলির সভাপতি: বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুজ্জামান আহমেদ এমপি, ব্যবস্থাপনা সম্পাদক: তৌহিদ আহমেদে রেজা, বার্তা সম্পাদক: আসমা আহমেদ কর্তৃক ৫৪ কামাল আতাতুর্ক এভিনিউ সৈয়দ ভবন, ঢাকা-১২১৩ থেকে সম্পাদিত ও প্রকাশিত
© All rights reserved 2020 Daily Surjodoy