আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সমাবেশের নামে ফের ষড়যন্ত্র, তাণ্ডব ও সহিংসতায় মেতে উঠেছে বিএনপি-জামায়াত। শনিবার (২৮ অক্টোবর) তাদের হামলায় এক পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৫০ জনেরও বেশি পুলিশ সদস্য। তাদের হামলা থেকে রেহাই পায়নি রোগী বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সও।
বিএনপি ভুল রাজনীতি করছে মন্তব্য করে বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘তারা খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। আসন্ন জাতীয় নির্বাচন ভন্ডুল করতে তারা সহিংসতার আশ্রয় নিচ্ছে। সংঘাতে জড়িয়ে বিএনপি বিপজ্জনক পথে অগ্রসর হচ্ছে। ২০১২, ২০১৩ ও ২০১৪ সালেও তারা এমন সংঘর্ষে জড়িয়েছিল। তখন রাজশাহীতে পিটিয়ে পুলিশ হত্যা করেছিল বিএনপি-জামায়াত।’
পুলিশ সদস্য নিহত
রাজধানীর ফকিরাপুল চার রাস্তার মোড়ে বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীদের হামলার শিকার হয়ে পুলিশের এক কনস্টেবল নিহত হয়েছেন। তার নাম পারভেজ। বাড়ি মানিকগঞ্জের দৌলতপুরে। শনিবার বিকেল ৪টার দিকে মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সোয়া ৪টায় মৃত ঘোষণা করেন।
তার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগের আবাসিক সার্জন ডা. মোহাম্মদ আলাউদ্দিন।
তিনি বলেন, ‘মৃত অবস্থায়ই ওই পুলিশ সদস্যকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছিল। তার মাথায় গুরুতর আঘাত রয়েছে। আমরা ইসিজি করার পর নিশ্চিত হয়ে তাকে মৃত ঘোষণা করেছি।’
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (মিডিয়া) কে এন রায় জানান, সংঘর্ষের মধ্যে আহত প্রায় অর্ধশত পুলিশ সদস্যকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল ও রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
ডিএমপি জানিয়েছে, বিএনপির হামলায় রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে ২২ জন এবং ঢামেক হাসপাতালে ১৯ জন আহত পুলিশ সদস্য চিকিৎসাধীন।
প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা, পুলিশ বক্সে আগুন
রাজধানীর নয়া পল্টনে সমাবেশ উপলক্ষে কাকরাইলে আসা বিএনপি কর্মীরা প্রধান বিচারপতির বাসভবনের সামনে ককটেল বিস্ফোরণ এবং বাসভবনে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেছে। এ ছাড়া কাকরাইল পুলিশ বক্সেও আগুন দিয়েছে তারা।
প্রধান বিচারপতির বাসভবনের নিরাপত্তায় নিয়োজিত নুরুজ্জামান নামে একজন পুলিশ কনস্টেবল বলেন, বাইরের গার্ড রুমের দরজা ও জানালার কাচ এবং প্রধান বিচারপতির নামফলকের কাচ ভাঙচুর করেছে হামলাকারীরা। এ সময় কাকরাইল চার্চের সামনের পুলিশ বক্সও পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
বিজয়নগরে বাসে আগুন, ছড়িয়ে পড়ছে পাশের ভবনে
রাজধানীর বিজয়নগরে একটি বাসে আগুন দিয়েছে বিএনপি-জামায়াতের কর্মীরা। শনিবার বিকেলে নাইটিঙ্গেল মোড়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বাসটিতে আগুন দেয় তারা।
ঘটনাস্থল থেকে পাঠানো ভিডিওতে দেখা গেছে, আগুনে দাউ দাউ করে জ্বলছে যাত্রীবাহী এশিয়া লাইন পরিবহনের বাসটি। সেখান থেকে পাশের ভবনেও ছড়িয়ে পড়ছে আগুন। উপরের বৈদ্যুতিক তার পর্যন্ত আগুন পৌঁছে যাওয়ায় পাশের খুঁটিতে বিস্ফোরণ হতে দেখা যায়।
বাসটির পাশেই রাস্তায় বসে কাঁদতে কাঁদতে চালক মনির হোসেন জানান, আজ তার বাসে পুলিশ সদস্যদের আনা-নেয়া করছিলেন। একদল পুলিশ সদস্যকে নিয়ে বিকেল ৫টায় তিনি এখানে আসেন। পুলিশ সদস্যরা নেমে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরই বাসে আগুন দেয়া হয়।
এর আগে কাকরাইল, ফকিরাপুলসহ আশপাশের বিভিন্ন জায়গায় পুলিশের ওপর ব্যাপক হামলা চালায় বিএনপি-জামায়াত কর্মীরা। রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে আগুন দেয় তারা।
রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে অ্যাম্বুলেন্সসহ সাত গাড়িতে আগুন
রাজারবাগ পুলিশ লাইনস হাসপাতাল চত্বরে ঢুকে সাতটি গাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরা। এর মধ্যে একটি অ্যাম্বুলেন্স, একটি মাইক্রোবাস ও পাঁচটি মোটরসাইকেল রয়েছে।
শনিবার বিকেল ৩টার দিকে হাসপাতাল চত্বরে ঢুকে গাড়িগুলোতে আগুন দেয়া হয়। এ সময় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগী ও স্বজনদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ঘণ্টাখানেক পর পরিবেশ শান্ত হয়।
পুলিশ লাইনস হাসপাতাল থেকে কয়েক মিনিটের দূরত্বে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে দুপুরে বিএনপির সমাবেশ ছিল। এ উপলক্ষে সেখানে বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মীও সমবেত হয়েছিল। কিন্তু দুপুরের দিকে সহিংসতায় মেতে ওঠে তারা। এতে তাদের সমাবেশ পণ্ড হয়ে যায়।
সাংবাদিকরা বিএনপি-জামায়াতের হামলার প্রধান শিকার
শান্তিপূর্ণ সমাবেশের ডাক দিয়ে রাজধানীতে রীতিমতো তাণ্ডব চালিয়েছে বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীরা। পুলিশের ওপর হামলা, সরকারি স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ, সাংবাদিকদের ব্যাপক মারধরের অভিযোগ উঠেছে বিএনপি ও জামায়াতের বিরুদ্ধে। তাদের হামলায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ৪১ সদস্যসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমের অন্তত ২০ থেকে ২৫ জন সাংবাদিক আহত হয়েছেন।
ঘোষণা ছিল শান্তিপূর্ণ সমাবেশের। লোক সমাগম হওয়ার কথা শনিবার দুপুর ২টা থেকে। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসতে থাকে বিএনপির নেতাকর্মীরা। তাদের হাতে ছিল লাঠি। কাকরাইল মোড়ে তারা শুরু করে গাড়ি ভাঙচুর।
একটি বাস ও কয়েকটি পিকআপে করে আসা আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা কাকরাইলে নেমে বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে শান্তি ও উন্নয়ন সমাবেশে যোগ দিতে যাওয়ার সময় বিএনপির সমাবেশ থেকে আওয়ামী লীগের এক কর্মীকে লাঠি দিয়ে আঘাত করা হয়। পরে বাগ্বিতণ্ডার একপর্যায়ে সংঘর্ষ শুরু হয়। পরে বিএনপি নেতাকর্মীরা গাড়ি ভাঙচুর শুরু করে।
একপর্যায়ে কাকরাইল এলাকা পরিণত হয় রণক্ষেত্রে। ব্যাপক ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটে। আগুন দেয়া হয় পুলিশ বক্সে। এমনকি এ সময় প্রধান বিচারপতির বাসভবনে ঢিল ছুড়তে দেখা যায় বিএনপি নেতাকর্মীদের। বাদ যায়নি গণমাধ্যমের গাড়িও। সময় টিভির গাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করা হয়। বেশ কয়েকটি মোটরসাইকেলে আগুন দেয়া হয়।
বিএনপি-জামায়াতের হামলায় আহত সাংবাদিকরা হলেন: নিউ এইজের আহমেদ ফয়েজ, বাংলা ট্রিবিউনের প্রধান প্রতিবেদক সালমান তারেক শাকিল, ফটো সাংবাদিক সাজ্জাদ হোসেন ও নিজস্ব প্রতিবেদক জোবায়ের আহমেদ, দৈনিক কালবেলার প্রতিবেদক রাফসান জানি, আবু সালেহ মুসা, রবিউল ইসলাম রুবেল এবং তৌহিদুল ইসলাম তারেক, ঢাকা টাইমসের প্রতিবেদক সালেকিন তারিন, ব্রেকিং নিউজের ক্রাইম রিপোর্টার কাজী ইহসান বিন দিদার, দৈনিক ইনকিলাবের ফটো সাংবাদিক এফ এ মাসুম, দৈনিক ইত্তেফাকের মাল্টিমিডিয়ার রিপোর্টার তানভীর আহাম্মেদ, একুশে টিভির রিপোর্টার তৌহিদুর রহমান ও ক্যামেরাপারসন আরিফুর রহমান, দৈনিক দেশ রূপান্তর পত্রিকার সাংবাদিক আরিফুর রহমান রাব্বি, ইত্তেফাকের সাংবাদিক শেখ নাছের ও ফ্রিল্যান্সার মারুফ, ভোরের কাগজের ফটো সাংবাদিক মো. মাসুদ পারভেজ আনিস, নুরুজ্জামান শাহাদাৎ ও ক্যামেরাপারসন আরিফুল ইসলাম পনি।
রাফসানের সঙ্গে থাকা কালবেলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রাজন ভট্টাচার্য জানান, কাকরাইল মোড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বিএনপির নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ চলাকালে ভিডিও ফুটেজ নিচ্ছিলেন সাংবাদিক রাফসান জানি। পুলিশের ওপর হামলার এই ফুটেজ সংগ্রহকালে বিএনপির কর্মীরা রাফসানের ওপর হামলা চালায়।
তিনি আরও বলেন, এ সময় রাফসানের গলায় কালবেলার আইডিকার্ড ঝোলানো থাকলেও তাকে এলোপাতাড়ি মারধর করা হয়। হামলায় তার সারা শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। এছাড়া তার মোবাইল ফোনটিও ছিনিয়ে নেয় হামলাকারীরা।