লন্ডন থেকে জমির উদ্দিন সুমন :
ব্রিটিশ কোম্পানি রিঅ্যাকশন ইঞ্জিন এমন এক হাইপারসোনিক বিমান তৈরি করছে যেটি শব্দের চেয়েও পাঁচগুণ দ্রুতগতিতে উড়তে পারে।
ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান কার্নেগিএনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস-এর পদার্থবিজ্ঞানী জেমস অ্যাকটন বলেন, হাইপারসোনিক অস্ত্র তৈরিতে
যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীন বিভিন্ন ধরনের নকশা নিয়ে কাজ করছে।
এই গবেষণায় অগ্রবর্তী তিনটি দেশই এই খাতে
বিপুল সামরিক বরাদ্দ ব্যয় করছে। তবে হাইপারসোনিক বিমান তৈরির গবেষণার বেশিরভাগ চলছে বেসরকারি বিমান
নয়, জঙ্গিবিমান তৈরির লক্ষ্যে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি’র বাংলা সংস্করণের এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য
জানা গেছে।
ব্রিটিশ কোম্পানির হাইপারসোনিক বিমানটি মাক-৫ বা প্রতি ঘণ্টায় ৬,৪০০ কিলোমিটার পথ উড়তে পারবে। মাক-১
হচ্ছে গতিমাপক সংখ্যা। শব্দ প্রতি ঘণ্টায় ১২৩৫ কিলোমিটার পথ উড়ে যেতে পারে। কোম্পানির যুক্তরাষ্ট্র শাখার
প্রধান অ্যাডাম ডিসেল বলেন, আমার চাকরি জীবনের একটা বড় অংশ কেটেছে দ্রুতগতিতে উড়তে পারে এমন সব বিমান
তৈরি করে।
রিঅ্যাকশন ইঞ্জিন কোম্পানির লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে এরা এমন একটি যাত্রীবাহী বিমান তৈরি করবে, লন্ডন
থেকে সিডনি যেতে যার সময় লাগবে মাত্র চার ঘণ্টা। এখন সময় লাগে ২১ ঘণ্টারও বেশি। লস অ্যাঞ্জেলস থেকে
টোকিও যেতে এই বিমানের সময় লাগবে মাত্র দু'ঘণ্টা।
মাক-৫ গতিতে একটি বিমান উড়ে গেলে যে পরিমাণ তাপ তৈরি হবে তা সহ্য করতে পারে এমন উপকরণ তৈরির যেমন
গবেষণা চলছে, তেমনি বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছেন এর সঙ্গে তাল মেলাতে পারে এমন প্রযুক্তি তৈরি করতে। এসব হিসাব
মিলে গেলেই পৃথিবীর ভূমণ্ডলের ভেতর দিয়ে শব্দের চেয়ে পাঁচগুণ গতিতে উড়ে যাওয়া সম্ভব হবে বলে তারা মনে
করছেন।
তবে হাইপারসোনিক বিমান তৈরির চেষ্টা কিন্তু নতুন নয়। যুক্তরাষ্ট্র সেই ১৯৬০ সালেই এক্স-১৫ নামে একটি
হাইপারসোনিক রকেট তৈরি করেছিল। এবং আন্তমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র যাকে আইসিবিএম বলা হয়, সেগুলো যখন
মহাকাশ থেকে আবার বায়ুমণ্ডলে ফিরে আসে তখন তার হাইপারসোনিক গতি থাকে।
এখন বিশ্ব পরাশক্তিগুলো এমন অস্ত্র তৈরির চেষ্টা করছে যেটি বায়ুমণ্ডলের ভেতর দিয়ে উড়ে যেতে পারবে। উচ্চতাপ
থেকে রক্ষার জন্য একে আর মহাশূন্যে পাঠানোরই প্রয়োজন হবে না। আর এই অস্ত্র দিয়ে শুধু শহর নয়, যেসব
লক্ষ্যবস্তু নড়াচড়া করতে পারে তাকেও আঘাত করা সম্ভব হবে।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দফতর পেন্টাগনে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে মার্কিন প্রতিরক্ষা বাহিনীর
হাইপারসোনিক গবেষণা বিভাগের উপ-পরিচালক মাইক হোয়াইট জানান, প্রতিপক্ষ শক্তি তাদের এক্ষেত্রে ‘আমাদের
শ্রেষ্ঠত্বকে চ্যালেঞ্জ করছে’। আর এটিই এই খাতে মার্কিন গবেষণাকে গতিশীল করছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
হাইপারসোনিক মিসাইল তৈরির মূল সমস্যা লক্ষ্যবস্তুকে আঘাত করার সঠিকত্ব। আর ঠিক এই কারণেই চীনের হাতে
হাইপারসোনিক ক্ষেপণাস্ত্র থাকলে মার্কিন বিমানবাহী রণতরীগুলোকে চীনা উপকূলকে অনেক দূরে রেখে চলাচল
করতে হবে।
হাইপারসোনিক মিসাইল যখন উড়ে যেতে থাকে তখন তাপমাত্রার কারণে মিসাইলের চারপাশে একটা গ্যাসের প্লাজমা
আবরণ তৈরি হয়। এজন্য মিসাইলের যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটে। সামরিক যোগাযোগের স্যাটেলাইট মিসাইলকে
আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, এবং লক্ষ্যবস্তু যদি চলমান হয় তাহলে মিসাইল আর লক্ষ্যভেদ করতে পারে না।
হাইপারসোনিক মিসাইলের আরেকটি বড় সমস্যা তার রাসায়নিক পরিবর্তন। অতি দ্রুতগতি এবং উচ্চ তাপমাত্রার ফলে
অক্সিজেনের অণুগুলো ভেঙে পরমাণুতে পরিণত হয়। আর সেটা মিসাইলের ইঞ্জিনের দক্ষতাকে অনেকখানি কমিয়ে
ফেলে।
কিন্তু এরপরও হাইপারসোনিক গবেষণায় নাটকীয় অগ্রগতি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ২০১০ সালে প্রশান্ত মহাসাগরে
হাঙ্গরের মুখের মতো দেখতে এক্স-৫১ হাইপারসোনিক মিসাইলের পরীক্ষা চালিয়েছে, যেটি পাঁচ মিনিটেরও বেশি সময়
ধরে হাইপারসোনিক ছিল। এটি অনেক উঁচু দিয়ে উড়ে যাওয়া একটি বি-৫২ বম্বার থেকে ছোড়া হয়। মিসাইলের সঙ্গে
লাগানো ছিল একটি বুস্টার রকেট, যেটি প্রথম ধাপে মিসাইলটিকে ৪.৫ মাক গতি এনে দেয়। তারপরই মিসাইলটির
নিজস্ব ইঞ্জিন চালু হয় এবং তার গতি আরও বেড়ে যায়।
হাইপারসোনিক বিমানের গবেষণায় এসব সমস্যা দূর হলেই আগামী ১৫ বছরের মধ্যে যাত্রীবাহী হাইপারসোনিক বিমান
আকাশে পাখা মেলবে বলে আশা করছেন বিজ্ঞানীরা। হাইপারসোনিক বিমানে দ্রুততম সময়ে ভিআইপিরা এক জায়গা
থেকে আরেক জায়গায় যেতে পারবেন, এমন সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে চায় মার্কিন বিমানবাহিনী। তারা বিশেষভাবে
মার্কিন প্রেসিডেন্টের জন্য হাইপারসোনিক বিমান তৈরি করতে চায়।
সে জন্য বিমান বাহিনী আটলান্টাভিত্তিক একটি কোম্পানিকে দায়িত্ব দিয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্টের জন্য ২০ জন
যাত্রীবাহী একটি বিমান নির্মাণের সম্ভাবনা পরীক্ষা করে দেখার জন্য। মাক-৫ গতিতে আকাশে উড়বে যে স্বল্প
ক'জন ভাগ্যবান তার সঙ্গে যুক্ত হবে মার্কিন প্রেসিডেন্টের নাম।