মানবজীবনে শান্তি ও মুক্তির জন্য প্রয়োজন
Facebook Twitter share
প্রকৃতির অনুকূল আল্লাহর বিধান অনুসরণ করা। ঈমান মানে বিশ্বাস ও নিরাপত্তা এবং সমাজের কল্যাণে নিবেদিত হওয়া। ইসলামি শরিয়তের সব বিধান এই আলোকেই সুবিন্যস্ত।
ইসলামে মাদক সেবন নিষিদ্ধ। ইসলামে অন্য যেসব নিষিদ্ধ বা অপরাধ হিসেবে বিবেচিত বিষয় রয়েছে, সেগুলো থেকে ব্যক্তি চাইলেই সহজে বিরত থাকতে পারে। অর্থাৎ, ইচ্ছা করলে এসব অপরাধ থেকে সরে থাকা যায়। কিন্তু মাদক গ্রহণ এমন এক অপরাধ, যা নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকে না বরং মাদকসেবী নিজেই মাদক বা নেশার নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। চাইলেই সেখান থেকে বেরিয়ে আসা যায় না। অর্থাৎ, সে নেশাকে ছাড়তে চাইলেও নেশা তাকে সহজে ছাড়ে না বা ছাড়তে চায় না।
Surjodoy.com
বর্তমান সময়ের মারাত্মক সমস্যাবলির মধ্যে মাদক ও মাদকাসক্তি অন্যতম একটি। বিশেষত যুব সমাজের জন্য মাদক ও মাদকাসক্তি মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিনিয়ত এর বিষাক্ত ছোবলে আক্রান্ত হচ্ছে অসংখ্য সম্ভাবনাময় জীবন।
মাদকাসক্তি আধুনিক সভ্যতার ভয়ংকরতম ব্যাধিগুলোর অন্যতম। বিশ্বে অগণিত সফল জ্ঞানী, বুদ্ধিজীবী, টেকনিশিয়ান ও অনুরূপ সফল মানুষের জীবন ও পরিবার ধ্বংস হয়েছে মদের কারণে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিশ্বের ৭৬ মিলিয়ন মানুষ মদপানের কারণে সৃষ্ট বিভিন্ন কঠিন রোগে ভুগছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুসারে, বিশ্বের সব রোগ-ব্যাধির ৩.৫ শতাংশ মদপানজনিত। মদপান ও মাতলামির কারণে প্রতিবছর শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই ১৮৫ বিলিয়ন ডলার নষ্ট হয়। ইসলাম আল্লাহর ভয়ের পাশাপাশি আইনের মাধ্যমে এ ভয়ংকর ব্যাধি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করেছে।
The Daily surjodoy
মাদক হলো নেশা উদ্রেককারী সব বস্তু, যা মানুষের মস্তিষ্কের স্বাভাবিকতাকে নষ্ট করে দেয়, যার প্রভাবে মস্তিষ্ক ঠিকভাবে কাজ করে না। মাদক সন্ত্রাসবাদ ও অপরাধকে উত্সাহিত করে। শরিয়তের বিধানের দর্শনকে ‘মাকসিদে শরিয়া’ নামে অভিহিত করা হয়।
শরিয়তের উদ্দেশ্য হলো পাঁচটি। জীবন রক্ষা, সম্পদ রক্ষা, জ্ঞান রক্ষা, বংশ রক্ষা, বিশ্বাস বা ধর্ম রক্ষা। হত্যার পরিবর্তে হত্যার বিধান রাখা হয়েছে জীবন সুরক্ষার জন্য। সেখানেও রয়েছে দিয়াত বা রক্তপণ দিয়ে নিহতের অভিভাবকের কাছ থেকে ক্ষমার সুযোগ। চুরির দায়ে হাত কাটার বিধান আছে সম্পদ সুরক্ষার জন্য। এখানেও রয়েছে অপেশাদার অভাবীদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা ও ক্ষমার সুযোগ। সব ধরনের মাদক বা নেশাদ্রব্য হারাম করা হয়েছে জ্ঞান বা বুদ্ধি–বিবেক সুরক্ষার জন্য। মাদক গ্রহণের জন্য কঠোর শাস্তির বিধান রাখা রয়েছে।
The Daily surjodoy
কুরআন কারিমে মাদক নিষিদ্ধের বিষয়টি তিনটি ধাপে এসেছে। প্রথমে বলা হয়েছে, ‘লোকেরা আপনাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। বলুন, এতদোভয়ের মধ্যে আছে মহাপাপ এবং মানুষের জন্য অপকারও, কিন্তু এগুলোতে উপকারের চেয়ে ক্ষতিই বেশি’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ২১৯)।
দ্বিতীয় পর্যায়ে বলা হলো, ‘হে মুমিনগণ! মদ, জুয়া, পূজার বেদি ও ভাগ্য নির্ণায়ক শর ঘৃণ্য বস্তু, এগুলো শয়তানের কার্য। সুতরাং তোমরা তা বর্জন করো, যাতে তোমরা সফল হতে পারো’ (সুরা-৫ মায়েদা, আয়াত: ৯০)।
The Daily surjodoy
সর্বশেষে ঘোষণা করা হলো, ‘শয়তান তো মদ ও জুয়া দ্বারা তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ ঘটাতে চায় এবং তোমাদিগকে আল্লাহর স্মরণে ও নামাজে বাধা দিতে চায়। তবে কি তোমরা নিবৃত্ত হবে না?’ (সুরা-৫ মায়েদা, আয়াত: ৯১)।
মুসলিমদের জন্য মদ, হেরোইন ও অন্যান্য মাদকদ্রব্য ক্রয়-বিক্রয় করা হারাম। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ মদপান, তা ক্রয়-বিক্রয় ও এর বিনিময় হারাম করেছেন।’ (মুসনাদে আবি হানিফা, হাসকাফির বর্ণনা, হাদিস : ৩৫)
তবে যার কাছে বা ঘরে অথবা দোকানে মাদকদ্রব্য পাওয়া যায়, কিন্তু মদপান প্রমাণিত হয়নি, তার ওপর ‘হদ’ তথা শরিয়ত কর্তৃক নির্ধারিত দণ্ড প্রয়োগ করা হবে না। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ‘তাজির’ তথা সাধারণ অনির্ধারিত শাস্তি প্রয়োগ করা হবে। মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধান সার্বিক বিবেচনায় এদের ওপর কঠিন থেকে কঠিনতর শাস্তিও প্রয়োগ করতে পারেন। (খুলাসাতুল ফাতাওয়া : ৩/৩৯, রদ্দুল মুহতার : ৪/৩৯)
The Daily surjodoy
একটি হাদিসে চতুর্থবার মদপানে লিপ্ত হলে মৃত্যুদণ্ডের বিধান বর্ণিত হয়েছে। এ বিষয়ে আলেমদের অভিমত হলো, এ হাদিসের বিধান রহিত হয়ে গেছে। হাদিসটি হলো, মুয়াবিয়া (রা.) সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মদপান করে, তাকে চাবুকপেটা করো। যদি সে চতুর্থবার মদপানে লিপ্ত হয়, তাহলে তাকে মেরে ফেলো।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৪৮২, তিরমিজি, হাদিস : ১৪৪৪)
ইমাম তিরমিজি (রহ.) হাদিসটির ব্যাখ্যায় বলেন, আমি ইমাম বুখারি (রহ.)-কে এ কথা বলতে শুনেছি, তিনি আরো বলেছেন—আগে মদপানকারীর মৃত্যুদণ্ডের বিধান ছিল, পরে তা বাতিল করা হয়েছে। অনেক ইসলামী আইনবিদ মনে করেন, যদিও ‘হদ’-এর ক্ষেত্রে বিধানটি রহিত, তবে মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধান সার্বিক বিবেচনায় ভালো মনে করলে মাদকদ্রব্য নির্মূলে ‘তাজির’ হিসেবে এরূপ ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিতে পারবেন। এ বিবেচনায় জনসাধারণের কল্যাণে দেশ থেকে মাদকদ্রব্য নির্মূলের উদ্দেশ্যে মাদক ব্যবসায়ী ও মাদকের ব্যাপক প্রসারকারীকে রাষ্ট্রপ্রধান মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিতে পারবেন। (আল আরফুশ শাজি : ৩/১৩৬, আত-তাশরিউল জিনাঈ : ১/৬৮৮)
The Daily surjodoy
যে কোনো মাদকবস্তু কেনা-বেচা এবং সেবনও হারাম। মদ সেবনের দ্বারা মানুষের বিবেক ঠিক থাকে না। তখন তার দ্বারা যে কোনো অপরাধ সংগঠিত হতে পারে। তাই মাদকের ব্যাপারে কুরআন ও হাদিসে এসেছে কঠোর হুঁশিয়ারি।
আল্লাহপাক তাদের অভিসম্পাত দিয়েছেন, যারা মদ পান করে, যারা অন্যকে পান করায়, যারা বিক্রি করে, যারা ক্রয় করে, যারা তা নিংড়ায়, যারা উৎপাদন করে, যারা বহন করে এবং যাদের নিকটে বহন করা হয়- এটাই হাদীসের ভাষ্য।
পবিত্র কুরআনের এসব আয়াতের মাধ্যমে বুঝে আসে মদ সেবনের মধ্যে রয়েছে মহাপাপ। মদ বিক্রি করে দুনিয়ায় কিছু সামান্য উপকার পাওয়া যায়; যেটা হালাল নয়। মদ সেবনের দ্বারা সামান্য উপকারিতা থাকলে ৯৯% এর ক্ষতি থাকায় মদ হারাম।
The Daily surjodoy
বুখারি শরীফের এক হাদীসে যা হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) থেকে আনাস শুনেছেন, ‘কিয়ামতের আলামতের মধ্যে অজ্ঞতা ও মূর্খতা বেড়ে যাবে, ইলম হ্রাস পাবে, যেনা-ব্যভিচার প্রকাশ্য হতে থাকবে (যা আজ অহরহ হয়ে চলছে), অবাধে মদপান চলবে, পুরুষের সংখ্যা হ্রাস পাবে, নারীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। এমনকি অবস্থা এমন পর্যায়ে এসে পৌঁছাবে যে, পঞ্চাশজন নারীর পরিচালক হবে মাত্র একজন পুরুষ।
আব্দুল্লাহ ইবনে আস (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, মদ্যপায়ী অসুস্থ হলে তাকে দেখতে ও সেবা করতে যেও না। মোটকথা, ইসলাম নেশাজাতীয় সব ধরণের দ্রব্যকে হারাম ঘোষণা করেছে। এমনকি ইসলামের প্রাথমিক যুগে মাদকসেবনকারীকে শাস্তিস্বরূপ ৪০ দোররা দেয়া হতো। হযরত ওমর (রাঃ)-এর সময় ৮০ দোররা দেয়া হতো।
The Daily surjodoy
ঈমানী তরবিয়ত ও আখেরাতমুখী জীবনবোধের পাশাপাশি যে বিষয়টি এ বিপ্লব সাধন ও রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে তা হচ্ছে সমাজের সর্বস্তরে ‘আমর বিল মারুফ ও নাহি আনিল মুনকার’ কার্যকর থাকা এবং অপরাধের শাস্তি-বিধান ও দন্ড প্রয়োগে কোনোরূপ অবিচার কিংবা শিথীলতা না থাকা।
The Daily surjodoy
কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা মাদক নিয়ে বলেছেন-
মানুষ ফেরারি হলে কাঁদে মানবতা
গিরিগৃহে অশ্রুসিক্ত পাথুরে দেবতা;
মানুষ খাদক হলে মাদক কারবারি
জনপদে নেমে আসে ঘোর মহামারী;
মুছে যায় ঘুচে যায় মানুষের নাম,
থাকে না তো মানুষের কানাকড়ি দাম।
মদাচারী কোনোকালে নয় সদাচারী,
যতই হাঁকাক সে-ও শাড়িবাড়িগাড়ি!
মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণে সবচেয় বড় ভূমিকা রাখতে পারে পরিবার। কেননা, প্রতিটি পরিবার হল মানুষের প্রথম পাঠাগার। জীবন গড়ার সব কিছু এই পাঠাগার থেকে মানুষের প্রথম শিক্ষা। আবার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সু-শিক্ষা দেয়ার মাধ্যমে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে।
The Daily surjodoy
বিশ্বশান্তি, সমৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতার জন্য সর্বস্তরে মাদক পরিহার করতে হবে। মাদকের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন ও পারিবারিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। মাদক নিয়ন্ত্রণ শুধু আইনি ও সামাজিক বিষয় নয়, বরং এটি ঈমান ও আমলের সঙ্গে সম্পর্কিত অতীব জরুরি বিষয়।
মেরাজের রাতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিভিন্ন অপরাধের শাস্তি কেমন হবে তা দেখেছেন। মদ, মাদক ও নেশা গ্রহণকারীদের শাস্তিও তিনি সে রাতে দেখেছেন। তিনি দেখেছেন-
‘তিনি মদ, মাদক ও নেশা গ্রহণকারীদের শাস্তি দেখলেন। তারা জাহান্নামিদের শরীর থেকে নির্গত বিষাক্ত নোংরা পুঁজ পান করছে।’
The Daily surjodoy
মুমিন মুসলমানের উচিত, মাদক সেবন থেকে বিরত থাকা। কেননা এ নির্দেশ মেনে চলা ফরজ ইবাদত। আল্লাহ তাআলা বান্দার জন্য সব ধরনের নেশা সৃষ্টিকারী জিনিসই হারাম করেছেন। আল্লাহর নির্দেশ অমান্যকারী ব্যক্তি কিভাবে পরিপূর্ণ ঈমানদার হতে পারে।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে মাদক সেবনের ছোবল থেকে রক্ষা করুন। কুরআন হাদিসের নির্দেশনা অনুযায়ী মদ, মাদক ও মাদকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব জিনিস থেকে মুক্ত থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।
প্রতিষ্ঠাতা : মেজর (অব) মোঃ মোদাচ্ছের হোসাইন, সম্পাদক মন্ডলির সভাপতি: বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুজ্জামান আহমেদ এমপি, ব্যবস্থাপনা সম্পাদক: তৌহিদ আহমেদে রেজা, বার্তা সম্পাদক: আসমা আহমেদ কর্তৃক ৫৪ কামাল আতাতুর্ক এভিনিউ সৈয়দ ভবন, ঢাকা-১২১৩ থেকে সম্পাদিত ও প্রকাশিত
© All rights reserved 2020 Daily Surjodoy