ইমাম হোসেন জীবন চট্টগ্রামঃ
মারী ও মুক্তির চিত্রকলা
দীর্ঘ দেড় বছর পর গত পরশু চট্টগ্রাম চারুকলা ইনস্টিটিউটে ‘সময়, স্মৃতি, অস্তিত্ব’ শীর্ষক দলীয় দৃশ্যশিল্প প্রদর্শনী দেখা হলো। এর মূল ভাবনাটি ছিল এই ‘নিও-নরমাল’ সময়ে শিল্পীদের অস্তিত্বের জানান দেওয়া, যার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে বিগত বিক্ষত সময়টার দুঃসহ স্মৃতির অভিজ্ঞান। এর অন্যতম উদ্যোক্তা শিল্পী ও ইনস্টিটিউটের শিক্ষক শায়লা শারমিন স্বাতী। তারই আমন্ত্রণে প্রদর্শনী দেখতে গিয়ে এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা হলো।
চট্টগ্রাম চারুকলা ইনস্টিটিউটে এর প্রতিষ্ঠাতা শিল্পী রশীদ চৌধুরীর নামে চমৎকার, দৃষ্টিনন্দন একটি চিত্রশালা রয়েছে। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণ ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা না থাকায় এটি ক্রমেই প্রদর্শনীর প্রায় অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। কিন্তু স্বাতী ও তার সহশিল্পীরা গ্যালারির এই মলিন, ভঙ্গুর অবস্থাকে তাদের শিল্পকর্মের প্রধান প্রেরণা হিসেবে নিয়ে তাকে উল্টো সুযোগ, সম্ভাবনা ও শক্তিরূপে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেন। তারই ১১ জন শিক্ষার্থীর সঙ্গে মিলে অনেকটা পারস্পরিক শিক্ষা প্রদান ও গ্রহণের আদলে একটি পরিপূর্ণ সহযোগিতামূলক যৌথ শিল্পের জন্ম দেন।
স্বাতী ও তার সহশিল্পীরা গ্যালারির দোতলার এক প্রান্তে লক্ষ্য করেন, করোনার দীর্ঘ অবকাশে দেয়ালের ফাটলের ফোকর দিয়ে বাইরের দালানসংলগ্ন একটি চারাগাছের শিকড়বাকড় সব ভেতরে ঢুকে দেয়ালজুড়ে সাম্রাজ্য বিস্তার করেছে; নকশা ও বিন্যাসে ঠিক শিল্পকর্মের মতো। স্বাতী ও তার দল তখন সিদ্ধান্ত নেন, প্রকৃতির এই স্বতঃস্টম্ফূর্ত শিল্পকর্মকে নষ্ট না করে একে ঘিরেই নির্মাণ করবেন তাদের নিজস্ব শিল্প।
এভাবেই জন্ম নেয় তাদের যৌথ শিল্পকর্ম ‘কথোপকথনের জন্য একটি পরিসর’। সেই নির্জনে, নিভৃতে গড়ে ওঠা শিকড়বাকড়ের নিসর্গ শিল্প ঘিরে তারা সযত্নে নির্মাণ করে দেন জল, মাটি, বীরুৎ ও গুল্মের সমাহারে প্রাকৃতিক প্রতিবেশ। এরই সঙ্গে কক্ষের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেন দেয়ালের অপর প্রান্তের সেই বৃহৎ বিটপীর থেকে খসে পড়া সতেজ ও শুকনো পাতা দিয়ে তৈরি আরও কয়েকটি চিন্তাউদ্দীপক, দৃষ্টিনন্দন স্থাপনাচিত্র। এমনকি দেয়ালগাত্রের সেই আদি শিকড়-শিল্পের ওপর বাইরের বিশাল মাতৃবৃক্ষটির একখানি স্নিগ্ধ, সবুজ ভিডিওচিত্রের প্রলেপ মাখিয়ে দিতেও তারা ভোলেন না। বস্তুত স্বাতী ও তার ১১ শিল্পারোহীর নির্মিত এই অনন্য স্থাপনা শিল্প নিসর্গের সঙ্গে নগরের, শিল্পের সঙ্গে শিল্পীর কথোপকথনের এক ফলপ্রসূ পরিসর হয়ে ওঠে।
গ্যালারির পলেস্তারা-খসা দেয়ালের ভগ্নদশাকে কাজে লাগিয়ে ব্যতিক্রমী, ভাবনাজাগানিয়া আরেকটি কাজ করেছেন চারুকলার শিক্ষক তাসলিমা আকতার বাঁধন। তার ‘দেয়ালকাব্য’ ভাঙাচোরা দেয়ালের স্বয়ংসৃষ্ট টেক্স্চারকেই তুলে এনেছে গোলাকার বিভিন্ন ক্যানভাসে। আর এসবের মাঝখানে স্থাপিত হন মুখোশ-পরিহিতা বীরকন্যা প্রীতিলতা; মুখোশখানি একদিকে করোনাকালের পরিচয়বাহী, অন্যদিকে বিপ্লবী তৎপরতার অনুষঙ্গ। কাজটি আরও এক ভিন্নতর মাত্রা পায় তার ওপরে একটি ভিডিও প্রক্ষেপণের সুবাদে। আমরা এই দেয়ালেরই গোপন অভিসারিকা কয়েকটি টিকটিকি ও ইঁদুরকে সহসা প্রাণ পেয়ে একটি যথার্থ দেয়ালকাব্যের কল্পরূপ হয়ে উঠতে দেখি।
প্রদর্শনীর আরও দুটি উল্লেখযোগ্য অন্তর্ভুক্তি ইনস্টিটিউটের দুই শিক্ষক শারদ দাশের ‘রুক্ষ ছালের আখ্যান’ এবং সুব্রত দাশের ‘বাতায়নের ভেতর দিয়ে দেখা প্রতিবেশ’। শারদের শিল্পকর্মটি এক ধরনের স্থাননির্দিষ্ট কাজ এই অর্থে যে, এটি এই বিদ্যাঙ্গনেরই একটি কর্তিত বৃক্ষের শাখা-প্রশাখা আর ছাল-বাকলের বুদ্ধিদীপ্ত ব্যবহারে তৈরি। এর মধ্য দিয়ে তিনি নির্মম নগরায়ণেরই বেদনার্ত বিষাদগাথা বয়ান করেন।
অপরদিকে সুব্রতর কাজটিকে এক ধরনের মরমি মিনিমালিস্ট শিল্পকর্ম বলা যেতে পারে, যেখানে তিনি তার পাঠদান কক্ষের জানালার ভেতর দিয়ে দেখতে পাওয়া, চরাচরজুড়ে চলমান সংক্রমণ ও মৃত্যুর মিছিল বিষয়ে ভ্রুক্ষেপবিহীন যে ‘আনন্দময় ভুবন’খানি ‘বাইরে খেলা করে’, বৃক্ষপল্লবের বুকে ঝিরিঝিরি বাতাসের নিরন্তর দুলুনিতে তারই চিরকালীন ছবি তুলে রাখেন ক্যামেরায়।
প্রদর্শনীর অপর চার শিল্পী প্রণব মিত্র চৌধুরী, কিংশুক দাশ চৌধুরী, সুফিয়া বেগম ও উত্তম কুমার বড়ূয়া মূলত দ্বিমাত্রিক তলে কাজ করেছেন এই বিরূপ সময় ও তার বহুমাত্রিক অভিঘাতটুকু তাদের ক্যানভাসে ধরে রাখার প্রয়াসে। সব মিলিয়ে, বহু আকাঙ্ক্ষিত করোনাবসানের আবাহনলগ্নে বেশ একটা মুক্তির আস্বাদই বুঝি নিয়ে এসেছিল এ প্রদর্শনীটি চট্টগ্রামের শিল্পানুরাগীদের জন্য। আয়োজকদের আন্তরিক ধন্যবাদ ও অভিনন্দন।