‘মা’ ছাড়া ঈদ
লেখক, প্রবাসী সাংবাদিক মোহাম্মদ ফিরোজ
জেদ্দা সৌদি আরব।
Facebook Twitter Instagram share
ঘুম ভাঙতেই বুকটা ছ্যাত করে উঠল। কান্নায় বুকটা ফেটে যাচ্ছে এমন অবস্থায় সারা রাত কান্না করেছি।প্রতিদিন গাড়ি ড্রাইভ করে জেদ্দা থেকে মক্কায় যেতে হয় চাকরিতে, যেতে যেতে ফোনে সেজ ভাই এর সাথে কথা বলতে পারছিলাম না যতদূর গেছি মক্কা পর্যন্ত কান্না আর কান্না করতে গেছি।
Surjodoy.com
হায়রে প্রবাস জীবন গতবছর আমার মা ঈদের সময় ছিল এই এই দুনিয়ায়, ঈদের নামাজ পড়ে আগে মায়ের সাথে ফোন করে কথা বলতাম আর কান্না করতাম, ঐ প্রান্তে মাও কান্না করত, এক সময় কান্না থামিয়ে মা আমাকে শান্তনা দিত বাবা আগামী ঈদে চলে আয় এক সাথে ঈদ করব, আজ ঈদ আসছে কিন্তু আমার মা এই ঈদে নেই।
The Daily surjodoy
চাকরি শেষ করে ভোরে বাসায় ফিরে পাঁচটার সময় ঈদের নামাজ পড়তে বাসা থেকে বের হয়ে রাস্তায় কান্না মাখা মুখে অনেকক্ষণ দাড়িয়ে ছিলাম শুধু মা এর কথা মনে পড়ছিল। ঈদের নামাজ পড়ে সবার সাথে কথা সালাম বিনিময় করছি ঠিক কিন্তু আমার অন্তরে একটু আনন্দ নেই, মনটা অনেক অনেক খারাপ, শুধু মা মা আর মায়ের কথা মনে পড়ছে। মাকে ঈদের নামাজ পড়ে এসে ফোন দিতে পারিনি মা বলে ডাকতে পারিনি। মা তুমি আমাকে ছেড়ে কেন চলে গেলে আজ তোমার ছেলে ডাকছে তোমায়, কে দেবে শান্তনা।
The Daily surjodoy
মা’ ঈদের সময় আমি যতক্ষণ ফোন করে নতুন শাড়ি পড়তে না বলতাম ততক্ষণ পড়ত না, আজ মা ছাড়া ঈদ কার কাছে ফোন করব কাকে বলব তুমি ঈদের নতুন শাড়ি এখনও পড়নি মা। মা ! এই একটা শব্দ আমাদের জীবনে জীবনের সমান। আমাদের জীবনে মা একটা এমন জায়গা যা আমরা ঠিক সুস্পষ্ট ভাবে ব্যাখ্যায় করতে পারিনা। মা আমাদের সেই গাছ তলা যেখানে জীবনের কঠোর তপ্ত রোদের মধ্যে একফালি ছায়া যেখানে আমরা চলার পথে কিছুটা বিশ্রাম পাই। মা আমাদের বাড়ির সেই কোনটা যেখানে আমরা আর সবকিছু ভুল হলে গিয়ে বসে নিঃস্বাস নি। আমাদের জীবনে আমাদের মা ই একমাত্র মানুষ যে এক্কেবারে ভেতর থেকে বোঝে, মায়েদের কিছু বলে দিতে হয়না আমাদের, আমাদের মুখ দেখলেই কেমন করে যেন আমাদের মনের অবস্থা বুঝে ফেলে।
The Daily surjodoy
গত বছর জুনের ২৯ তারিখ আমার মা আমাকে ছেড়ে এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেছে আমাকে এতিম করে। তখন খুব খারাপ সময় পার করেছি, বৈশ্বিক মহামারী করোনা ভাইরাস সংক্রমণের কারণে সৌদি আরব সহ পৃথিবীর প্রায় দেশে কঠোর লকডাউন চলছিল।
The Daily surjodoy
জুনের ২০ তারিখ বুধবার, আমি রাতে আমার মায়ের সাথে কথা বলেছি তখন মায়ের শরীর টা একটু খারাপ ছিল, মা তখন আমার ভাই এর বাসায় ছিল, আমি ভাবীর ফোন ইমুতে কল দিয়ে মায়ের সাথে কথা বলছি মাকে জিজ্ঞেস করলাম মা তোমার চেহারা এমন দেখাচ্ছে কেন? মা বলল না কিছু না এমনি শরীর ভালো লাগছে না। তখন আমি ফোনটি ভাবীকে দিতে বলি আর ভাবীকে বলি মাকে ডাক্তার এর কাছে নিয়ে যাও, ভাবী ঠিক আছে বলে মায়ের হাতে আবার ফোন দিল মা তখন ভাত খেতে চায়নি আমি ফোনে থেকে জোর করে খেতে বলি আর ফোনটি রেখে দিলাম আর বাসায় এসে কাজ কর্ম ছেড়ে ঘুমাতে ঘুমাতে রাত হয়ে যায়।
The Daily surjodoy
২১ জুন বৃহস্পতিবার ভোরে আমার সেজ ভাই ফোনের উপর ফোন করে আমি বলতে পারি না হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে দেখি ভাই এর ফোন আমি ভয়ে তাড়াতাড়ি ফোন করি আর ভাই ফোন রিসিভ করে বলে মা খুব অসুস্থ মাকে শহরে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমি ফোন কেটে দিয়ে মাকে ফোন করি মা ফোন রিসিভ করতে পারছে না, তখন আমি কান্নায় ভেঙে পড়ি কান্না করতে ভাতিজাকে ফোন করি তখন সেই রিসিভ করে আর ভিডিও কলে আমাকে দেখায় আমি মা মা করে কান্না করতে করতে ভেঙে পড়ি মা শুধু বলেছিল অপুত আমি মনে হয় আর বাঁচব না। আজও মায়ের সেই শব্দ আমার কানে বাজে, মাকে এই ভাবে হারিয়ে ফেলব কখনো কল্পনা করতে পারিনি। মায়ের আত্মা দেহ ছেড়ে চলে যায়। ওই মুহুর্তগুলো আমার জীবনের চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তখন থেকে আমার নতুন নামকরণ হলো এতিম ছেলে। আমি এতিম হয়ে গেলাম সারা জীবনের জন্য। আর এটাই ঠিক।
The Daily surjodoy
আমার কাছে মা মানে শুধু একটা রক্ত মাংসের অবয়ব না বদলে কিছু প্রশ্ন, কিছু উষ্ণ সমস্যা, কিছু অসম্ভব কষ্টের সময়ে পাওয়া খানিকটা আরাম আর অনেকটা ভালোবাসা সীমাহীন, অর্থহীন, স্বার্থহীন ভালোবাসা।
আমরা যারা প্রবাসে থাকি তাদের জন্য ঈদ অনেক কষ্টে আর বেদনার প্রকোপ মাখা ঈদ, ইচ্ছা করলে যেতে পারি না প্রিয় জনের কাছে, ইচ্ছা করলে যেতে পারিনি মায়ের মৃত্যুর, আগে পরে! হায়রে প্রবাস জীবন! সবার জন্য আজ ঈদ! কিন্তু আজ আমার শোকের দিন।
The Daily surjodoy
দেশে বসে সুন্দর সুন্দর গল্পের ইতি টানা যায়, দেশে বসে প্রবাসের অনুভূতি নেয়া যায় না। কষ্টের, হৃদয় দহন অনুভব করা যায় না, প্রত্যেক প্রবাসীর রয়েছে অব্যক্ত, নীল কষ্ট। এ যেন সংগ্রামী জীবনযুদ্ধের এক একটি উপাখ্যান।প্রবাসে প্রত্যক প্রবাসীর কর্মব্যস্ততার মাঝেও মনটা থাকে দেশে। সবকিছুর পরেই প্রবাসীদের জীবন চলে নিরন্তর। লক্ষ্যের পেছনে অক্লান্ত পরিশ্রম করে এ যোদ্ধারা। এ জীবনে যখন তারা ব্যর্থতার তিক্ত স্বাদ পায়, তখন চোখ বুঝে সয়ে যায়। ঝিনুক নীরবে সহে, ঝিনুক নীরবে সহে যায়, হাসিতে মুক্তা ফলায়।
The Daily surjodoy
আজ এক বছর হতে চলছে প্রায় আমার আগে মা আমাকে ছেড়ে পরপারে চলে গেছেন। মাকে ছাড়া এটাই প্রথম ঈদ। মাকে হারিয়ে কোথাও কোনো সান্ত্বনা খুঁজে নেওয়ার জায়গা অবশিষ্ট থাকল না। বাবা ছয় বছর আগেই চলে গেছে বাবা চলে যাওয়ার পরেও মা কখনো বুঝতে দেইনি বাবার শোক সবসময়ই আগলে রেখেছে আমাকে আমার অন্য ভাই বোনদের চেয়ে বেশি আমাকে আদর করতেন, ভালোবাসতেন তাই আমার সব ভাই বোনেরা বলতো মাকে, তুমি শুধু ওকে বেশি ভালোবাস আদর করো।
The Daily surjodoy
এই মধুময় সুন্দর দিনগুলো আর আসবে না। মা, তুমি চলে গেছো। কিন্তু তুমি যে, সুন্দর, মধুময় দিনগুলো রেখে গেছ সেই দিনগুলো কখনো ভুলতে পারব না। সারাজীবন ওই দিনগুলো ধরে রাখতে হবে এবং তোমার কথা মনে পড়বে। মা তুমিতো চলে গেছ। যাওয়ার পর আমার যে কি অবস্থা, কি কষ্ট তা বলে বোঝাতে পারব না। মা জানো, এতিম হবার যে কত যন্ত্রণা তা আগে বুঝতে পারিনি, এখন বুঝি। কত যন্ত্রণা।
The Daily surjodoy
প্রত্যেক মানুষের কোন না কোন কষ্ট থাকে। তবে আমার কষ্ট একটু ভিন্ন। আমার জীবন সব সময় অম্লান বেদনায় ভরপুর। আর জীবনে সব সময় কষ্ট থেকে যাবে। এ কষ্টের আর শেষ হবে না। কষ্ট সব সময় আমার পিছু হাটবে। প্রিয়জন হারানোর কত বেদনা, দুঃখ, কান্না, বেদনার তা এখন আমি বুঝি। প্রিয়জন হারালে মনে হয় পৃথিবীর সব কিছু হারিয়েছি। প্রিয়জনের মধ্যে সবচেয়ে কাছের মানুষ হচ্ছে মা। প্রিয় মাকে যদি কেউ হারায় তাহলে মনে হয় পৃথিবীর সব কিছু হারালো।