1. dailysurjodoy24@gmail.com : admin2020 : TOWHID AHAMMED REZA
মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের অবদান
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৪:৪২ অপরাহ্ন
সংবাদ শিরোনাম ::
সাভার উপজেলার নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে ২ জনসহ মোট ১১ প্রার্থী মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেন ভিজিডি কাড না দেওয়ায় সৈয়দপুর পৌর মেয়রের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ও পথসভা নৈতীক স্খলন ও সিমাহীন আর্থিক অনিয়মের প্রতিবাদে সৈয়দপুর পৌর মেয়রের অপসারনের দাবীতে \ সংবাদ সম্মেলন টেলিভিশন ক্যামেরা র্জানালিস্ট অ্যাসোসয়িশেন (টিসিএ) নেতৃত্বে   সোহলে ও জুয়েল কলাতিয়া বাজারের যানজট ও ফুটপাত দখল মুক্ত করলেন কলাতিয়া পুলিশ ফাঁড়ি “বাংলাদেশ সূফী ফাউন্ডেশন পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে রমজান মাসে যাত্রা শুরু করবে” নীলফামারীতে উৎসবমুখর পরিবেশে চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। নীলফামারী টেলিভিশন ক্যামেরা জার্নালিষ্ট এসোসিয়েশনের আহবায়ক কমিটি গঠন এস আই আল মামুন এর বিরুদ্ধে মিথ্যা অপপ্রচার চালানো হয়েছে – ভুক্তভোগী সজল কুমিল্লা জেলা আইনজীবী সমিতির ম্যানেজিং কমিটির নির্বাচন ৭ই মার্চ

মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের অবদান

  • আপডেট টাইম : সোমবার, ১ মে, ২০২৩, ৪.৪৭ পিএম
  • ১৪৪ বার পঠিত

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী

৭১-এর ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু ছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ছাত্র সমাজ ছাড়াও ইপিআর এবং পুলিশ বাহিনী। সেজন্য ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজারবাগ পুলিশ লাইন ও পিলখানা ইপিআর ঘাঁটিতেই প্রথম আক্রমণ চালিয়েছিলো হানাদার বাহিনী। হাজার হাজার পুলিশ স্বাধীনতার বেদীমুলে তাদের শ্রেষ্ঠতম সম্পদ মূলবান জীবন উৎসর্গ করে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান হিসেবে পরিগণিত হয়।

৭১-এর ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করার পর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে বাংলার মাটি থেকে উৎখাত করার জন্য যে প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু হয়েছিলো, সে যুদ্ধে পুলিশবাহিনী উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে কর্মরত পুলিশের মোট সদস্য সংখ্যা ছিল ৩৩,৯৯৫ জন। তš§ধ্যে ২৫ মার্চ ও পরবর্তী সময়ে ১৩,০০০ পুলিশ পাকিস্তান সরকারের আনুগত্য অস্বীকার করে কর্মস্থল ত্যাগ করে। ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকেই পুলিশবাহিনীর বাঙালি সদস্যরা চলমান পরিস্থিতির উপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে শুরু করে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথেও যোগাযোগ ও সংবাদপ্রদান চলতে থাকে। পূর্ব পাকিস্তানের পুলিশবাহিনীর অধিকাংশই ছিল বাঙালি। আর তাদের নিয়ন্ত্রণ করত প্রাদেশিক সরকার। এ কারণে সামরিক সরকার প্রথম থেকেই পুলিশবাহিনীর প্রতি সন্দিহান হয়ে পড়ে। এজন্য অসহযোগ আন্দোলন চলার সময় তারা পুলিশকে দায়িত্ব না দিয়ে সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব দেয়। পূর্ব পাকিস্তান পুলিশের বাঙালি সদস্যরা প্রথম থেকেই আন্দোলনে একাত্ম হয়ে যায়।
অসহযোগের শুরুতে মার্চের প্রথম সপ্তাহে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। সশস্ত্র বাহিনী বিভিন্ন জায়গায় গুলি চালিয়ে অনেককে হত্যা করে। হরতালের মধ্যে লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ এবং চোরাগোপ্তা হামলা চলতে থাকে। এছাড়া বাঙালি-অবাঙালি দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ৩ মার্চ এক বিবৃতিতে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার উপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, ‘নইলে আন্দোলনের উদ্দেশ্য নস্যাৎ হবে।’ মার্চের প্রথম সপ্তাহে পুলিশের আইজি তসলিম উদ্দিন আহমদ এবং স্পেশাল ব্রাঞ্চের ডিআইজি এ এস মেজবাহউদ্দিন ধানম-িতে তাঁর বাসায় সাক্ষাৎ করেন। বঙ্গবন্ধু তাদেরকে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হওয়ায় আওয়ামী লীগের নির্দেশ মেনে চলার পরামর্শ দেন। তারাও সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসেবে আওয়ামী লীগের প্রতি পুলিশ প্রশাসনের পূর্ণ আনুগত্যের নিশ্চয়তা প্রদান করেন। এ সময় বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্বার্থে অরাজকতাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, ‘আমার স্পষ্ট নির্দেশ রইল, যে যেখানে থাকুন নিষ্ঠার সাথে নিজ দায়িত্ব পালন করুন।’
৪ মার্চ সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহতদের উদ্দেশে গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এদিন রাজারবাগ পুলিশ লাইনের বাঙালি সদস্যগণ ‘জয়বাংলা’ স্লোগানের মাধ্যমে জনগণের মিছিলের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে। ৭ মার্চের ভাষণে শেখ মুজিব আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব সেনাবাহিনীর পরিবর্তে পুলিশ ও ইপিআর বাহিনীকে দেওয়ার কথা বলেন। ৭ মার্চের পর থেকে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে গোপনে প্রস্তুতি চলতে থাকে। এ সময়ে পুলিশ লাইনে কর্মরত ১৯ জন সুবেদার ও সার্জেন্টের মধ্যে ১৪ জন ছিল অবাঙালি। এজন্য পুলিশদের পরস্পরের সাথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে গোপনীয়তা রক্ষা করতে হয়।
বাঙালি পুলিশদের দাবির মুখে রাজারবাগ (পুলিশ হেডকোয়ার্টার) অস্ত্রাগারের সামনে পাকিস্তানি পতাকার পরিবর্তে বাংলাদেশের পতাকা ওঠানো হয়। পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা প্রধান মেজর জেনারেল আকবর পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ব্রিফিংয়ের সময় পুলিশ বিভাগ কার্যকর ভূমিকা পালন করছে না বলে অভিযোগ করেন। এর জবাবে আইজি তসলিম উদ্দিন আহমদ বলেন যে, সামরিক সরকার নিজের কার্যক্রমের ফলাফলের জন্য পুলিশ বিভাগকে দায়ী করছে। প্রকৃতপক্ষে প্রয়োজন সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান।
১৪ মার্চ আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে অসামরিক প্রশাসন পরিচালনার জন্য ৩৫টি কার্যবিধি ঘোষণা করা হয়। আইন-শৃঙ্খলা সম্পর্কিত বিধিটি (৩নং) ছিল নি¤œরূপ :
ক. ডিসি ও মহকুমা প্রশাসকগণ তাদের কোনো দপ্তর না খুলে নিজ নিজ এলাকার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পালন করবেন এবং উন্নয়ন কাজ ও প্রয়োজনমতো এই নির্দেশ কার্যকরী বা প্রয়োগ করার দায়িত্ব পালন করবেন। তারা এই সকল দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে আওয়ামী লীগ সংগ্রাম পরিষদের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ও সহযোগিতা বজায় রাখবেন।
খ. পুলিশ এবং বাঙালি ইপিআর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পালন করবেন এবং প্রয়োজনবোধে আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সাথে যোগ দেবেন।
গ. জেল দপ্তরের কাজ চলবে এবং জেল ওয়ার্ডারগণ তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে যাবেন।
ঘ. আনসার বাহিনী তাদের দায়িত্ব পালন করবেন।
১৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু গাড়িতে কালো পতাকাসহ প্রেসিডেন্টের বৈঠকে যোগ দেন। গাড়ি প্রবেশের সময় প্রেসিডেন্ট ভবনে ডিউটিরত পুলিশরা তাঁকে অভিবাদন জানায়। আর প্রেসিডেন্টের ডিউটিতে নিয়োজিত পুলিশ ট্রাক ও জিপগুলোতেও কালো পতাকা ওঠানো হয়।
পুলিশবাহিনীকে আন্দোলন থেকে পৃথক করার জন্য ৮ মার্চ এক সরকারি প্রেসনোট জারি করে বলা হয়, সারা প্রদেশে ইপিআর ও পুলিশের গুলিতে এক সপ্তাহে ১৭৮ জন নিহত হয়েছে এবং ৩৫৮ জন আহত হয়েছে। অর্থাৎ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার্থে পুলিশ এই গুলি চালিয়েছে। কিন্তু অসহযোগ আন্দোলন চলাকালীন সম্পূর্ণ সময়ে কোনো সংবাদমাধ্যমেই আসেনি যে পুলিশ গুলিবর্ষণ করেছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমদ প্রেসনোটের বিবৃতিকে প্রত্যাখ্যান করে বলেন, পুলিশ ও ইপিআর জনতার উপর গুলি চালিয়েছে বলে যে অভিযোগ করা হয়েছে তা অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও বানোয়াট।
পূর্ব পাকিস্তানের পুলিশবাহিনীকে ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর আওতায় নিয়ে আসার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময়ে পাকিস্তানি মনোভাব জানা যায়। ফেব্রুয়ারির শেষদিকে নির্বাচন পরবর্তী এক কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয় রাওয়ালপি-িতে। এতে অংশগ্রহণ করেন সামরিক গোয়েন্দাপ্রধান ব্রিগেডিয়ার আকবর, গোয়েন্দা বিভাগের পরিচালক নেসার হোসেন রিজভী, পূর্ব পাকিস্তান স্পেশাল ব্রাঞ্চের ডিআইজি এ এস মেজবাহউদ্দিন আহমদ, প্রতিরক্ষা সচিব গিয়াসুদ্দিন আহমদ, স্বরাষ্ট্রসচিব সাদেক আহমদসহ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাবৃন্দ। এক পর্যায়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এতে যোগ দেন। এখানে ডিআইজি মেজবাহউদ্দিন আহমেদ পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি তুলে ধরেন। তিনি শেষ করেন এই বলে যে, ‘শক্তির প্রয়োগে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব হয়ে গেছে। কেন্দ্রে যে ব্যবস্থাই গ্রহণ করা হোক না কেন সেক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের সমর্থন থাকতে হবে।’ তাঁর এই বক্তব্য পশ্চিমা কাউকেই সন্তুষ্ট করতে পারেনি এবং সিদ্ধান্ত ছাড়াই কনফারেন্স শেষ হয়।
লে. জেনারেল টিক্কা খান ৭ মার্চ দায়িত্ব গ্রহণের পর পুলিশ বিভাগের সাথে বৈঠকে মিলিত হন। এই বৈঠকে চিফ সেক্রেটারি শফিউল আজম, স্বরাষ্ট্রসচিব (প্রাদেশিক) এম মুজিবুল হক, আইজি তসলিমউদ্দিনসহ পদস্থ পুলিশ কর্মকর্তাগণ উপস্থিত ছিলেন। টিক্কা খানের এক প্রশ্নের জবাবে যখন পুলিশ কর্মকর্তারা জানান যে, একমাত্র ক্ষমতা হস্তান্তরের মধ্যেই সমাধান নিহিত; তখন টিক্কা খান বলেন, ‘তোমরা চাঁদ ছুঁতে চাইছ’। এই আলোচনাতেও কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি।
ঢাকার বাইরের জেলাগুলিতেও পুলিশ সদস্যরা একই ধরনের কার্যক্রম চালায়। ৩ মার্চ পাবনা পুলিশ লাইনে পুলিশ-জনতার এক সমাবেশে পুলিশরা জনতার সকল কর্মকা-ে সহযোগিতার কথা বলেন। এছাড়া পাবনার পুলিশ সুপার চৌধুরী আবদুল গাফফার এবং ডিসি নূরুল কাদের খানকে সংগ্রাম কমিটির সদস্য করা হয়। মার্চের মধ্যভাগ হতে ছাত্রদের উদ্যোগে এবং পুলিশদের সহায়তায় সশস্ত্র প্রশিক্ষণ শুরু হয়। বরিশাল, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের পুলিশসহ সকল এলাকার পুলিশ সদস্যরা আন্দোলনে যোগ দেয়।
ইপিআর এবং পুলিশবাহিনী যে প্রদেশের জনগণের সমরশক্তির মূল উৎস তা পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বুঝতে পেরেছিল। জনগণের বিরুদ্ধে কোনো সামরিক কার্যক্রমে তারা যে অস্ত্র ধরবে না এটা তাদের কাছে স্পষ্ট ছিল। ঢাকার অপারেশন সার্চলাইটের প্রধান মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী খান বলেন, ‘পূর্বাঞ্চলের পুলিশ প্রধান সর্বপ্রথম তার বাহিনীসহ পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে আওয়ামী লীগ কমান্ডের হাতের পুতুলে পরিণত হয়েছিলেন এবং তাদেরকে সম্পূর্ণ সহায়তা করেন। ঢাকার স্পেশাল ব্রাঞ্চের সদর দপ্তর থেকে গোপন নির্দেশের মাধ্যমে প্রতিটি জেলার এসপিদেরকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য বেশি পরিমাণে আনসার নিয়োগ ও তাদের মাঝে অস্ত্র বণ্টন করতে বলা হয়। প্রতিরোধ যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রের অন্যতম উৎস ছিল এই অস্ত্রগুলি। অপারেশন সার্চলাইটের অন্যতম লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করে আন্দোলনকে নেতৃত্বশূন্য করে দেওয়া। কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি। এ সম্পর্কে রাও ফরমান আলী বলেন, ‘পুলিশের সহায়তা ব্যতীত পশ্চিম পাকিস্তান আর্মির পক্ষে নেতৃবৃন্দকে চিহ্নিত করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। একমাত্র শেখ মুজিব ছাড়া উল্লেখযোগ্য অন্য কোনো নেতাকেই গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি।’ এ কারণে পাক সরকার ২৬ মার্চের পরে তসলিমউদ্দিন আহমদকে সরিয়ে অবাঙালি মোজাফফর আহমেদ চৌধুরীকে আইজি নিয়োগ করে।
চট্টগ্রাম
চট্টগ্রামের জেলা পুলিশ সুপার ছিলেন শামসুল হক। এ সময়ে দামপাড়া জেলা পুলিশ লাইন ছাড়াও সিডিএ মার্কেটে ইপিআর পুলিশের অবস্থান ছিল। ২৫ মার্চ রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রমণের সংবাদ চট্টগ্রামে পৌঁছার পূর্বেই চট্টগ্রামের ইপিআরের বাঙালি সৈন্যরা এবং বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈন্যরা বিদ্রোহ করে। তাদের সাথে যোগাযোগ স্থাপিত হয় পুলিশ লাইনের। এ সময়ে দামপাড়া পুলিশ লাইনের আর আই ছিলেন আকরাম হোসেন। তিনি প্রাথমিকভাবে পুলিশ লাইনের নিরাপত্তার জন্য লাইনের চারপাশে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলেন। গৃহীত নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল :
ক. ম্যাগাজিন গার্ডে ১ জন সুবেদার, ২ জন হাবিলদার, ১ জন নায়েক এবং ২০ জন কনস্টেবল। ৫টি বাংকারে এই ফোর্স অবস্থান নেয়।
খ. ১নং গেটে সুবেদার মালিকের নেতৃত্বে ১৮ জন কনস্টেবল
গ. ২নং গেটে ১ জন হাবিলদারের নেতৃত্বে ৫ জন কনস্টেবল
ঘ. ৩নং গেটে ১ জন হাবিলদারের নেতৃত্বে ৫ জন কনস্টেবল
ঙ. টহলের জন্য ১ জন নায়েকের অধীনে ৩ জন কনস্টেবলকে দায়িত্ব প্রদান করা হয়।
এই পুলিশ সদস্যরা আর আই আকরাম হোসেন এবং সুবেদার মালিকের নেতৃত্বে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
২৬ মার্চ প্রতিরোধের প্রথমেই পুলিশ সুপার শামসুল হকের নেতৃত্বে লালদীঘি এলাকায় পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে কন্ট্রোল রুম স্থাপন করা হয়। ২৫ মার্চ রাতে ডিসি অফিস এবং এম আর সিদ্দিকীর বাসভবনে আওয়ামী লীগ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন এসপি শামসুল হক। একই সাথে দামপাড়া পুলিশ লাইন এবং সিডিএ মার্কেটের বাঙালি পুলিশরা পরস্পর যোগাযোগ স্থাপন করে। সিডিএ মার্কেটের ইপিপিআর পুলিশের উচ্চ অফিসার এবং অধিকাংশ পুলিশ সদস্য অবাঙালি হওয়ায় রাতের মধ্যেই সেখানের বাঙালি পুলিশরা অস্ত্রসহ কন্ট্রোল রুমে পুলিশ সুপারের সঙ্গে যোগ দেয়। এরপর পুলিশ সুপার তাঁর বাহিনীকে প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত করেন। চট্টগ্রামের পুলিশ বাহিনী সেখানকার ইপিআর ও বেঙ্গল রেজিমেন্টের সহযোগী হিসেবে যুদ্ধে যোগ দেয়। নিজ বাহিনীর সৈন্যস্বল্পতা উপলব্ধি করে চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার পার্বত্য চট্টগ্রামের ডিসি ও এসপির কাছে সাহায্যের আবেদন জানান। এর পরিপ্রেক্ষিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে একজন এসএএফ সুবেদারসহ ২০ জন পুলিশ সদস্যকে চট্টগ্রামে পাঠানো হয়। পুলিশ সুপার তাদেরকে দামপাড়া পুলিশ লাইনের প্রধান গেটে প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত করেন।১
২৭ মার্চ চট্টগ্রাম শহরে ইপিআর সুবেদার গণির নেতৃত্বে ইপিআরের সাথে পুলিশ সদস্যরা একীভূত হয়ে সিডিএ মার্কেটে পশ্চিম পাকিস্তানি পুলিশের অবস্থান আক্রমণ করে দখল করে নেয়। এখানে অবাঙালি পুলিশদের অধিকাংশ নিহত হয়। কেউ কেউ পালিয়ে গেলেও বাকিরা বন্দী হয় এবং তাদেরকে পুলিশ সুপারের কন্ট্রোল রুমে নিরাপত্তা হেফাজতে রাখা হয়। এ সময়ে পুলিশ বাহিনীকে নতুন করে বিন্যস্ত করে ইপিআর বাহিনীর সাথে টাইগার হিল, রেলওয়ে হিল, বন্দর এলাকা এবং স্টিমার টার্মিনালের প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত করা হয়। ২৭ মার্চ পাকসৈন্যরা নৌঘাঁটি থেকে গোলাবর্ষণ করে।২ এ-সময়ে চট্টগ্রামের পুলিশবাহিনী অসামরিক লোকদের উদ্ধার ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ২৯ মার্চ লালদীঘির কন্ট্রোল রুম থেকে পুলিশ সদস্যদেরকে ইপিআর বাহিনীর সাহায্যের জন্য শুভপুর ব্রিজে রি-ইনফোর্সমেন্ট হিসেবে পাঠানো হয়। তাদেরকে ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের কাছে পাকবাহিনী আক্রমণ করে। আকস্মিক আক্রমণে দুটি গাড়ি ধ্বংস হয় এবং বেশ কিছু পুলিশ হতাহত হয়। তারা পিছু হটে বাওয়ানী জুট মিলের সামনে অবস্থান নেয়। একই রাতে পাকসৈন্যরা আবারও তাদেরকে আক্রমণ করে। ব্যাপক হতাহতের মুখে পুরো বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।
২৯ মার্চ ভোরে বেলুচ রেজিমেন্টের সৈন্যরা দামপাড়া পুলিশ লাইনের দক্ষিণ-পূর্ব এবং উত্তর-পূর্ব দিক থেকে এক যোগে আক্রমণ করে। পাহাড়ের ঢালে এবং বাংকারে অবস্থান নিয়ে পুলিশ সদস্যরা তাদের আক্রমণ প্রতিহত করতে থাকে। কোনোভাবেই অগ্রসর হতে না পেরে তারা মূল সড়কের ড্রেনের মধ্য দিয়ে মেইন গেটের কাছাকাছি চলে আসে। এখানে অবস্থানরত পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে আসা পুলিশ সদস্যরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই আক্রান্ত হয়। পাকবাহিনীর এই কৌশল বুঝতে না পারায় এখানের প্রায় সবাই নিহত হয়। এরপরে পাকবাহিনীর ভারী মেশিনগান ও ৩ ইঞ্চি মর্টারের সামনে পুলিশের প্রতিরোধ খুব দ্রুত ভেঙে পড়ে এবং ভোর ৬টায় দামপাড়া পুলিশ লাইনের পতন ঘটে। এ যুদ্ধে পার্বত্য চট্টগ্রামের ২০ জন পুলিশের মধ্যে সুবেদার মালেকসহ ১৮ জন নিহত হন।৩ এছাড়া আর আই আকরাম আহত অবস্থায় বন্দী হয়ে পরে নিহত হন। ২০-২৫ জন পুলিশ গুরুতর আহত হয়।
পাক বাহিনীর চট্টগ্রাম শহরের পতন হলে এস পি শামসুল হক ও কোতোয়ালী থানার ওসি আবদুল খালেককে পাকিস্তানি বাহিনী নির্মমভাবে হত্যা করে। ক্যাপ্টেন রফিকের বিদ্রোহের আলোচনায় দেখা গেছে, তিনি পাকিস্তানিদের প্রচ- আক্রমণের মুখে ২৭ মার্চ রেলওয়ে পাহাড়ে তাঁর হেডকোয়ার্টারের অবস্থান ছেড়ে কোতোয়ালী থানায় এসে অবস্থান নিয়েছিলেন। চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মানিক মিয়া অসহযোগ আন্দোলনের সাথে একাত্ম ছিলেন। পটিয়ায় অবস্থানরত মেজর জিয়াউর রহমানের সাথে তিনি বেতারের বেলাল মোহাম্মদের সাক্ষাতের ব্যবস্থা করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে মেজর জিয়া কালুরঘাট পৌঁছে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করেন।
কাপ্তাই উইং (১৭নং) এর ‘এ’ কোম্পানির সুবেদার আবদুল গণি ২৬ মার্চ অবাঙালি ইপিআরদের বন্দী করে তাদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক (কার্যালয় রাঙামাটি) এইচ টি ইমামের কাছে হস্তান্তর করেন। ১৩ এপ্রিল জেলা প্রশাসক রাঙামাটি থেকে তাঁর কার্যালয় রামগড়ে স্থানান্তরিত করেন। তিনি এখানে প্রশাসনিক কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য সুলতান আহমদ, ফণিভূষণ ত্রিপুরা, মফিজুর রহমান, সুবোধ বিকাশ ত্রিপুরা ও শফিকুর রহমানকে লিখিতভাবে পৃথক পৃথক দায়িত্ব অর্পণ করেন। এছাড়া শরণার্থীদের জন্য তিনি লঙ্গরখানা পরিচালনা করেন। রামগড়ের টেলিফোন ব্যবস্থা সচল রাখা হয়। আর জেলা প্রশাসকের নির্দেশে কন্ট্রোল রুমও খোলা হয়। রামগড়ের পতন পর্যন্ত এইচ টি ইমাম এ ব্যবস্থা অব্যাহত রাখেন।

১। আফসান চৌধুরী : বাংলাদেশ ১৯৭১; প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৯১।
২। এ এস এম সামছুল আরেফিন (সম্পাদক) : মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের ভূমিকা; পৃ. ৪১।
৩। এ এস এম সামছুল আরেফিন (সম্পাদক) : প্রাগুক্ত; পৃ. ৪২।

লেখক: জৈষ্ঠ্য সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা, গবেষক, সাংস্কৃতিক সংগঠন ও লেখক।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..

Comments are closed.

© All rights reserved  2020 Daily Surjodoy
Theme Customized BY CreativeNews