সম্প্রতি বহুল আলোচিত রিজেন্ট হাসপাতাল ও জেকেজি গ্রুপের প্রতারণার বিষয়ে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। শনিবার (১১ জুলাই) স্বাস্থ্য অধিদফতরের সহকারী পরিচালক (সমন্বয়) ডা. মো. জাহাঙ্গীর কবির স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে নিজেদের অবস্থান জানিয়ে ঘটনা দুটির ব্যাখ্যা দেয়া হয়।
সেখানে বলা হয়, “সম্প্রতি রিজেন্ট হাসপাতালের প্রতারণার বিষয়ে কিছু আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি স্বত্বাধিকারী মো. সাহেদ করিমের বিভিন্ন প্রতারণার খবরও বেরিয়ে আসছে। স্বাস্থ্য অধিদফতর তার বিষয়ে আগে অবহিত ছিল না। এ বছরের মার্চ মাসে আকস্মিকভাবে দেশে কোভিড-১৯ রোগীর সংখ্যা বেড়ে যায়। কোনো বেসরকারি হাসপাতাল কোভিড রোগী ভর্তি করতে চাইছিল না। অথচ অনেক রোগীরই পছন্দ থাকতো বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিক। এমন একটি ক্রান্তিকালে রিজেন্ট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ঢাকার উত্তরা ও মিরপুরে অবস্থিত ওই নামের দুটি ক্লিনিককে কোভিড হাসপাতাল হিসেবে ডেডিকেটেড করার আগ্রহ প্রকাশ করে।
মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তপক্ষ কর্তৃক নির্দেশিত স্বাস্থ্য অধিদফতরের হাসপাতাল বিভাগ সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের উদ্যোগ নেয়। তবে ক্লিনিক দুটি পরিদর্শনকালে চিকিৎসার পরিবেশ উপযুক্ত দেখতে পেলেও সেগুলোর লাইসেন্স নবায়ন ছিল না। বেসরকারিপর্যায়ে করোনারোগীদের চিকিৎসা সুবিধা সৃষ্টির মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে অপরাপর বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে উৎসাহ প্রদানের লক্ষ্যে লাইসেন্স নবায়নের শর্ত দিয়ে রিজেন্ট হাসপাতালের সাথে ২১ মার্চ সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করা হয়।
ওই সমঝোতা স্মারকের পূর্বে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক পরিচয় তো দূরের কথা টকশো ছাড়া আগে কখনও মো. সাহেদ করিমকে দেখেননি। তবে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের পর বেশ কয়েকবার তিনি স্বাস্থ্য অধিদফতরে এসেছিলেন। এ সময় সাহেদ তার সাথে বিভিন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তির যোগাযোগ আছে এবং তার ক্লিনিকগুলোতে কোন কোন বিশিষ্ট ব্যক্তির করোনায় আক্রান্ত আত্মীয় ভর্তি আছেন সেসব বলার চেষ্টা করতেন।
গোয়েন্দা ও অন্যান্য সূত্রে রিজেন্ট হাসপাতালের বিষয়ে কিছু অভিযোগ স্বাস্থ্য অধিদফতরের গোচরে আসছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ৬ জুলাই আকস্মিকভাবে স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রতিনিধির উপস্থিতিতে র্যাব কর্তৃক একটি যৌথ অভিযান চালানো হয়। রিজেন্ট হাসপাতালের নামে স্বাস্থ্য অধিদফতরের সমঝোতা স্মারকের বিষয়ে অধিদফতরের অবস্থান পরিস্কার। একটি মহতী উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে গিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতর প্রতারিত হয়েছে এবং ৭ জুলাই আইনানুযায়ী প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম বন্ধ করেছে। স্বাভাবিকভাবেই সমঝোতা স্মারকের আর কোনো মূল্য নেই।”
স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রত্যাশা, যারা এই প্রতারণার সাথে জড়িত তারা আইনের অধীনে যথাযথ শাস্তি পাবে। এই প্রসঙ্গে আরও জানানো হয় যে, ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতায় এবং নিজস্ব উদ্যোগে স্বাস্থ্য অধিদফতর বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ঝটিকা পরিদর্শন কার্যক্রম বৃদ্ধি করেছে, যা চলমান থাকবে।
জোবেদা খাতুন হেলথ কেয়ার (জেকেজি) নামে অপর একটি প্রতিষ্ঠানের প্রতারণার বিষয়েও স্বাস্থ্য অধিদফতর নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করে ব্যাখ্যা দিয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, “প্রতিষ্ঠানটির প্রধান সমন্বয়ক আরিফুল চৌধুরী ওভাল গ্রুপ লিমিটেড নামে একটি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট গ্রুপের স্বত্বাধিকারী। ওভাল গ্রুপ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক আয়োজিত স্বাস্থ্যসেবা সপ্তাহ ২০১৮- এর ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের দায়িত্ব পালন করে। চিকিৎসা পেশাজীবীদের সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনেরও একাধিক ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের দায়িত্ব পালন করে। কোভিড সংকট শুরু হওয়ার পর আরিফুল চৌধুরী স্বাস্থ্য অধিদফতরে আসেন এবং জানান যে, তিনি জোবেদা খাতুন হেলথ কেয়ার (জেকেজি) নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের প্রধান সমন্বয়ক। জেকেজি গ্রুপ দক্ষিণ কোরিয়ার মডেলে বাংলাদেশে কিছু বুথ স্থাপন করতে চায়। এসব বুথের মাধ্যমে পিসিআর পরীক্ষা করার জন্য নমুনা সংগ্রহ করে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পিসিআর ল্যাবরেটরিকে সরবরাহ করবে। এজন্য স্বাস্থ্য অধিদফতর বা সরকারকে কোনো অর্থ দিতে হবে না। ধারণাটি ভালো এবং করোনা পরীক্ষার নমুনা সংগ্রহ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন— এই বিবেচনা থেকে ওভাল গ্রুপের সাথে কাজের পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকায় জেকেজি গ্রুপকে অনুমতি দেয়া যায় বলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা স্বাস্থ্য অধিদফতর মনে করে।
একটি ভালো কাজের সাথে সংযুক্ত থাকার মানসে ঐতিহ্যবাহী তিতুমীর কলেজ কর্তৃপক্ষও জেকেজি গ্রুপের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়ায়। পরবর্তীতে প্রতারণার অভিযোগ পাওয়া গেলে স্বাস্থ্য অধিদফতর জেকেজি গ্রুপকে প্রদত্ত বুথ পরিচালনার অনুমতি বাতিল করে। স্বাস্থ্য অধিদফতর একটি সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান। তাই দ্রুত করোনা স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণের মূল লক্ষ্য ও সদিচ্ছা নিয়ে জেকেজি-কে অনুমতি দেয়। প্রতিষ্ঠানটি প্রতারণা করতে পারে, এমন ধারণা আদৌ আধিদফতরের ছিল না।
প্রসঙ্গত, উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ইদানিং কোনো কোনো স্বার্থান্বেষী মহল কল্পিত ও মিথ্যা তথ্য নিয়ে গণমাধ্যমকে বিভ্রান্ত করে অধিদফতরের সুনাম নষ্ট করার প্রয়াস চালাচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদফর ও মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দিন-রাত কঠোর পরিশ্রম করে, একই সঙ্গে শক্তি ও নিষ্ঠা দিয়ে কোভিডের মতো মহাদুর্যোগ মোকাবিলা করছেন। এই রোগটির বিষয়ে কারোরই কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী যদি অসততা বা অন্যায়ের আশ্রয় নেন সেক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের অবস্থান স্পষ্ট। অপরাধ প্রমাণিত হলে আইনানুযায়ী যথাযথ শাস্তি হোক, তা সকলেই প্রত্যাশা করে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান ও পদ্ধতিগত সাধারণ সীমাবদ্ধতাগুলোকে আমলে নেয়া হচ্ছে না। সহানুভূতির বদলে তীর্যক মন্তব্য এবং খণ্ডিত ও বিকৃতভাবে তথ্য উপস্থাপন করা হচ্ছে।
অশালীনভাবে মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে ব্যক্তিগত চরিত্র হননের প্রচেষ্টাও দেখা যাচ্ছে। এসবের পেছনে হীন ব্যক্তিস্বার্থও কাজ করছে বলে আমরা মনে করি। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, নিষ্ঠাবান কর্মকর্তারা এখন মিডিয়ায় বক্তব্য দিয়ে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করার বিষয়ে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন না। ফলে আরও বেশি করে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়ছে। কেউ অপরাধ করলে তদন্তেই তা ধরা পড়বে এবং শাস্তি হবে। তাই বলে মিথ্যা তথ্য দিয়ে নির্দোষ ব্যক্তির চরিত্র হনন এবং তাদের অপরাধি হিসেবে চিত্রিত করা কাম্য নয়। স্বাস্থ্য অধিদফতর এ বিষয়ে সকলের সুদৃষ্টি ও সহযোগিতা কামনা করে”— উল্লেখ করা হয় সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে।