তুহিন হোসেন, পাবনা ঃ
পাবনা জেলার ঈশ্বরদীর প্রত্যন্ত গ্রাম রূপপুরের নতুনহাট। পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পকে (আরএনপিপি) কেন্দ্র করে একসময়ের প্রায় বিরানভূমি এখন যেন অচেনা আধুনিক কোনো শহর। এখানেই মেলবন্ধন ঘটে গেছে বাংলা আর রুশ ভাষার মধ্যে। বাঙালিরা রুশ ভাষায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। রাশিয়ানরাও বাংলা বলছে।
বিপণিবিতানগুলো বাঙালিদের, ক্রেতা রাশিয়ানরা। রাশিয়ানরা জেনে গেছে 'দবরু উত্তরা' না বলে 'শুভ সকাল' বললে বাঙালিদের পিয় হওয়া যাবে। আর বাঙালিরাও বুঝে গেছে 'কেমন আছেন' না বলে 'কাক ভাচ ডেলা' বললে রশিয়ানরা খুশি হবে।এভাবেই নতুনহাট মোড়ে রাশিয়ানদের আবাস গ্রিনসিটি এলাকায় দিন-রাত বাঙালি ও রাশিয়াদের ভাবের আদান-প্রদান হচ্ছে। এক পক্ষ অন্য পক্ষের ভাষা ব্যবহারে সাবলীল হয়ে উঠছে।
গ্রিনসিটি এলাকার বিপণিবিতান, রেস্টুরেন্টসহ বিভিন্ন পণ্যের দোকানগুলোর সাইনবোর্ডে নাম লেখা হয়েছে রাশিয়ান ভাষায়। টানানো হয়েছে রাশিয়ান ভাষায় বিলবোর্ড। কেউ প্রথমবারের মতো নতুনহাট এলাকায় বেড়াতে এলে রুশ ভাষা লেখা সাইনবোর্ড, রাশিয়ানদের চলাফেরা, স্থানীয় ব্যবসায়ীদের মুখে রাশিয়ান ভাষা শুনে তাঁর কাছে স্থানটিকে রাশিয়ার কোনো একটি শহর বলেই মনে হতে পারে। গ্রিনসিটিতে বসবাসরত রাশিয়ানদের কাছে জানা যায়, সাধারণত রাশিয়ার নাগরিকরা তাঁদের মাতৃভাষা রুশকি রূপপুরের নতুন হাটে তৈরি পোশাক কিনছেন এক রুশ নাগরিক। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজে এসে অন্য ভাষা শেখার সেই অনাগ্রহটা অনেকটা কেটেছে। এখন তাঁরা বাংলা ভাষায় কথা বলেন। ভাষার সঙ্গে বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিতি ঘটেছে তাঁদের।
আবার রাশিয়ানদের সঙ্গে বিভিন্ন প্রয়োজনে যোগাযোগ বাড়াতে তাঁদের অনুকরণ করে রুশকি ভাষা শিখেছে বাঙালি শ্রমিক, দোকানি, গাড়িচালকসহ বিভিন্ন পেশার বাঙালিরা। প্রকল্পে কর্মরত প্রায় ৩২ হাজার বাঙালি । তাঁরা কাজ করছেন রুশ, বেলারুশ, ইউক্রেন, জর্জিয়া, তাজিকিস্তান, কাজাখস্তান, ভারতসহ প্রায় সাড়ে তিন হাজার বিদেশি নাগরিকের সাথে। ২৫০ থেকে ৩০০ জন বাঙালি দোভাষী এখানে কর্মরত। প্রকল্পে রাশিয়ান বিদেশিদের মুখে বাংলা ভাষা। আর বাঙালিদের মুখে রুশ ভাষা। বিগত আট বছর ধরে এই দুই ভাষার মেলবন্ধন ঘটে গেছে। নতুনহাটের রাশিয়ান পল্লী গ্রিনসিটির সামনের কাপড় ব্যবসায়ী মো. সাজ্জাদ হোসেন এক রাশিয়ানকে রুশকি ভাষাতেই বললেন, 'কেমন আছেন? কিছু লাগবে?' ওই রাশিয়ান বাংলাতে বললেন, 'একটু বড় মাপের ফুল প্যান্ট চাই।'ফল বিক্রেতা রায়হান আলী বলেন, 'কয়েক বছর ধরে নতুনহাট গ্রিনসিটি এলাকায় ফল বিক্রি করছি। রাশিয়ানরা দোকানে এসে কমলা দেখিয়ে সাদ্রারিন, মাল্টা দেখিয়ে এমেলতিন, আঙুর দেখিয়ে ভিনাগ্রাফ বলত। এভাবে শুনতে শুনতে রাশিয়ান ভাষা শিখে গেছি। কিন্তু ওদের মধ্যে পুরনোরা এখন কমলা, আঙুর, মাল্টা এসবও শিখে ফেলেছে। প্রকল্পের নির্মাণকাজের ম‚ল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রাশিয়ান মালিকানাধীন এটমস্টয় এক্সপোর্টের (এএসই) সঙ্গে কমরত বিভিন্ন সহঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা জানান, ২০১৩ সালে প্রকল্পের নির্মাণকাজ শুরু হলে রাশিয়াতে লেখাপড়া করা বাঙালিদের দোভাষী হিসেবে এখানে রাশিয়ান প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়োগ দেওয়া হয় এসব দোভাষী রাশিয়ানের সহযোগিতার পাশাপাশি বাঙালিদের রাশিয়ার ভাষা শেখাতে কোচিং সেন্টারও চালু করে। প্রকল্পের নির্মাণকাজের পাশাপাশি স্থানীয় দোকানগুলোতে কেনাকাটা করার জন্য বাঙালি দোভাষীদের সঙ্গে নিতেন রাশিয়ানরা। কিন্তু কয়েক বছরের ব্যবধানে রাশিয়ানদের অনেকেই বাংলা ভাষার অনেক কিছুই শিখে গেছেন। বাঙালি সংস্কৃতি, খাবার, আচার-ব্যবহার সম্পর্কেও তাঁরা এখন অবগত। প্রকল্পে কর্মরত শ্রমিকদের সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠায় তাঁদের বাড়ির বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও যোগ দিচ্ছেন রাশিয়ানরা। শুধু রূপপুর এলাকা নয়, ঈশ্বরদী, পাবনা, কুষ্টিয়া, নাটোরসহ
আশপাশের এলাকার দোকানি, পরিবহন শ্রমিক, হোটেল ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ কম-বেশি রুশ ভাষা শিখে গেছেন। এ কারণে অনেক ক্ষেত্রেই এখন রাশিয়ানরা দোভাষী তেমন আর ব্যবহার করছেন না। প্রকল্পে বাঙালি শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের প্রশিক্ষক রাশিয়ার নাগরিক মি. ডেনিশ জানান, তিনি রূপপুর প্রকল্পে কাজে এসে বাংলা ভাষা ও এ ভাষার ব্যাকরণ শিখেছেন। এখন তিনি বাঙালি শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি পুরোপুরি বাংলা ভাষায় পরিচালনা করছেন। এতে বাঙালি শ্রমিকরা খুব সহজেই প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে সক্ষম হচ্ছেন। তিনি আরো বলেন, বাংলা বাঙালি জাতির গৌরবের ভাষা। ভাষার জন্য বিশ্বের প্রথম জাতি হিসেবে বাঙালিরা রক্ত দিয়েছে। এ তথ্য জানার পর বাঙালিদের আচার-আচরণ, বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান, পোশাক সবই তাঁর খুবই ভালো লেগেছে। তাই তিনি চামচ ছেড়ে বাঙালির মতো হাত দিয়ে খাবার খান। বাঙালিদের পোশাক পরেন। ডেনিশ জানান, প্রত্যেক রাশিয়ান কম বেশি বাংলা ভাষা শিখেছে, বাংলা বর্ণমালার সঙ্গে পরিচিত হয়েছে। জানা যায়, ২০১৩ সালে এ প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ার পর রাশিয়া থেকে পর্যায়ক্রমে ১০ হাজারের মতো শ্রমিক- কর্মচারী এসেছেন।
প্রতিষ্ঠাতা : মেজর (অব) মোঃ মোদাচ্ছের হোসাইন, সম্পাদক মন্ডলির সভাপতি: বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুজ্জামান আহমেদ এমপি, ব্যবস্থাপনা সম্পাদক: তৌহিদ আহমেদে রেজা, বার্তা সম্পাদক: আসমা আহমেদ কর্তৃক ৫৪ কামাল আতাতুর্ক এভিনিউ সৈয়দ ভবন, ঢাকা-১২১৩ থেকে সম্পাদিত ও প্রকাশিত
© All rights reserved 2020 Daily Surjodoy