ড. মীজানুর রহমান
১০ ডিসেম্বর ২০২২ গোলাপবাগ মাঠে দেশের অন্যতম রাজনৈতিক দল বিএনপি তার অতি বাম থেকে আরম্ভ করে অতি ডান মিত্রদের নিয়ে ২৭ দফা “রাষ্ট্র মেরামত” কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। এর আদল অনেকটা সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের ১৯ দফা কর্মসূচির মত। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীদের নিয়ে জাতি পুনর্নির্মাণের একটা ইঙ্গিত ১৯ দফাতেও ছিল। ১৯৭৭ সালের ৩০শে এপ্রিল ঘোষিত দফাগুলোতে রাজাকার-আল বদরদের নিয়ে জাতীয় ঐক্য ও সংহতি সুদৃঢ় করার যে ঘোষণা জেনারেল জিয়াউর রহমান (১৯৩৬-১৯৮১) দিয়েছিলেন তারই আজকের রূপ হচ্ছে “রেইনবো নেশন”। ২৭ দফার দ্বিতীয় দফায় বাংলাদেশকে একটা “রংধনু জাতিতে” পরিণত করার ঘোষণা দেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ডক্টর খন্দকার মোশারফ হোসেন । কয়েক বছর আগের ব্যাপক সাড়া জাগানো অথচ কার্যত ব্যর্থ সড়ক আন্দোলনের স্কুল ছাত্রদের স্লোগান ধার করে “রাষ্ট্র মেরামতের” এই অন্যতম দফাটিতে বলা হয়েছে, “প্রতিহিংসা এবং প্রতিশোধের রাজনীতির বিপরীতে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক রেইনবো নেশন প্রতিষ্ঠা করা” হবে। যেমনটি ঘোষণা করেছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা (১৯১৮-২০১৩)। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার প্রথম মাসেই তিনি এই ঘোষণা দেন। মূলত দক্ষিণ আফ্রিকার শান্তিতে নোবেলজয়ী AvP© বিশপ ডেসমন্ড টুটোই (১৯৩১-২০২১) ১৯৯৪ সালে প্রথম এই দুই শব্দের বাক্যাংশটি চয়ন করেছিলেন। এ বিষয়ে তিনি কয়েকটি টিভি অনুষ্ঠানে তাঁর ধারণা বিস্তৃত করেছিলেন। ‘Old Testament’ -এ বর্ণিত নুহ্ নবীর বন্যার সময় ব্যবহৃত নৌকাটিকে তিনি রূপালঙ্কার (মেটাফোর) হিসাবে ব্যবহার করেছিলেন। নুহ্ নবীর নৌকায় পাপীদেরকে তোলা হয়নি। লক্ষনীয় বিএনপি ঘোষিত রেইনবো নেশনেও বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসীদের কি অবস্থান হবে তা বলা হয়নি !
(মেটাফোরে কোন ব্যক্তি, বস্তু বা অন্য কোন কিছুকে এমন একটা জিনিসের সাথে তুলনা করা হয় যার সাথে এর কোন মিল নেই অর্থাৎ মেটাফোরে সাধারণত দুটি ভিন্ন ব্যক্তি বা বস্তুর মধ্যে কাল্পনিকভাবে একটি সাধারণ গুণের উল্লেখ করা হয়; যেমনটা করেছিলেন উইলিয়াম শেক্সপিয়ার (১৫৬৪-১৬১৬) তাঁর “As you like it” নাটকে। ১৫৯৯ সালে রচিত এবং ১৬২৩ সালে প্রকাশিত উইলিয়াম শেক্সপিয়রের এই হাস্যরসাত্মক নাটকটিতে রূপক উপমা হিসেবে পৃথিবীটাকে নাট্যমঞ্চের সাথে তুলনা করেছিলেন। উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের ভাষায়,” All the world’s stage, / And all the men and women merely players; / They have their exists and their entrances /And one man in his time plays many parts,…” ) টুটোর ধারণার আরো বিস্তৃত ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে নেলসন ম্যান্ডেলা বলেন, “Each of us is as intimately attached to the soil of this beautiful country as are the famous Jacaranda trees of Pretoria and the Mimosa trees of the Bushveld- a rainbow at peace with itself and the world…”
বহু জাতি-গোষ্ঠীতে বিভক্ত বহু ভাষাভাষী (দক্ষিণ আফ্রিকায় রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত ভাষার সংখ্যা ১৩ টি) একটা দেশকে সুসংঘটিত করার জন্য ম্যান্ডেলার এই উদ্যোগ যথার্থই ছিল। ম্যান্ডেলা তাঁর দক্ষিণ আফ্রিকাকে বহু বর্ণে বর্ণিল একটি রংধনু জাতি হিসেবেই দেখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ম্যান্ডেলা তখন কল্পনাও করতে পারেন নাই অল্প কিছুকালের মধ্যেই তাঁর বর্ণিল রংধনু জাতি একটি বিবর্ণ জাতিতে রূপান্তরিত হবে। দক্ষিণ আফ্রিকা বর্তমানে আইন শৃংখলার বিবেচনায় পৃথিবীর তলানির দিক থেকে ১৩৭ তম দেশ। ২০১৮ সালের Gallup জরিপে ১০০ এর মধ্যে মাত্র ৫৮ স্কোর পেয়ে পৃথিবীতে নিচের দিক থেকে কেনিয়ার সাথে যৌথভাবে ষষ্ঠ অবস্থান পায়। সাব-সাহারা অঞ্চলে এই দেশটির আইনশৃঙ্খলা সর্বনিম্ন পর্যায়ে আছে। তাদের পিছনে পৃথিবীর আরমাত্র পাঁচটি দেশ অবস্থান করছে (গ্যাবন, দক্ষিণ সুদান, আফগানিস্তান এবং ভ্যানিজুয়েলা)। একই জরিপে ৫০ শতাংশ লোক বলেছে বিগত এক বছরে সে কোন না কোন অপরাধ কর্মের শিকার হয়েছে। প্রতি এক লক্ষ লোকের মধ্যে ৩৩ জন খুন হয়েছে। পৃথিবীর ভয়ংকর জায়গাগুলোর একটি হচ্ছে আজকের দক্ষিণ আফ্রিকা। সম্প্রতি এই খুনের সংখ্যা আরো বেড়েছে। এই সংখ্যা এখন প্রতি লক্ষে ৩৬ জন, প্রতিদিন গড়ে ৫৭ জন।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিভিন্ন দেশের মত হতে চাওয়া অথবা বাংলাদেশ বিভিন্ন দেশের মত হয়ে যাবে এরূপ বলা তেমন নতুন কিছু নয়। যেমন এই দেশে একসময় স্লোগান শোনা গিয়েছিল, “আমরা সবাই তালেবান বাংলা হবে আফগানিস্তান”, “তোয়াব ভাই তোয়াব ভাই চাঁদ- তাঁরা পতাকা চাই (পাকিস্তান!)”, অথবা কিছুদিন আগে শ্রীলঙ্কা যখন চরম আর্থিক দুর্দশায় পড়েছিল তখন অনেকেই বলেছিল আমরা শ্রীলঙ্কার মত হয়ে যাব। কখনো কখনো যারা দেশকে অনেক উন্নত দেখতে চায় তাঁরা সুইজারল্যান্ড বা সিঙ্গাপুরের মত হতে চায় । এইসব আলোচনায় এতদিন আমরা এশিয়া এবং ইউরোপের মধ্যেই ছিলাম। এই প্রথম আমরা আফ্রিকা পর্যন্ত পৌঁছে গেলাম, তাও আবার দক্ষিণ আফ্রিকার অনুকরণে “রেইনবো ন্যাশন” হওয়ার নামে ।
২৭ দফার ১৬ নং দফায় বলা হয়েছে, “ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার”। অথচ মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত সংবিধানের অন্যতম স্তম্ভ ধর্মনিরপেক্ষতাকে বাদ দিয়ে সংবিধানটিতে প্রথম ধর্মীয় লেবাস পরিয়ে দেন সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমান, পরবর্তীতে তাঁর উত্তরসূরী আরেক স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদ (১৯৩০-২০১৯) রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম কায়েম করে এখন স্বর্গবাসী হয়েছেন। সংবিধানের প্রারম্ভিক দিকের এ সকল ক্ষতগুলো এখনো পুরোপুরি মুছে ফেলা না গেলেও সংবিধানের ২৮ (১) ধারাটি এখনো অক্ষুন্ন আছে । যাতে বলা আছে, “কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারীপুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না।” সংবিধানের এই ধারাটিতে সকল নাগরিকের সম অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে, অতএব এটি মেরামত করে এখানে রেইনবো নেশন তৈরির একমাত্র উদ্দেশ্য হতে পারে স্বাধীনতা বিরোধী যুদ্ধ অপরাধীদের জন্য একটি বিশেষ অবস্থান তৈরি করা।
“রেইনবো নেশন” থিওরির বিপরীতে ২০২২ সালের ২৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিল অধিবেশনে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী এবং বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা “স্মার্ট বাংলাদেশ” বিনির্মাণের প্রত্যয় ঘোষণা করেন। এটা করেছেন তিনি ডিজিটাল বাংলাদেশ রূপান্তরের ধারাবাহিকতায়। অনেকটা বলা যায় আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর উন্নয়নের অনিবার্যতাই হচ্ছে স্মার্ট বাংলাদেশ। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ধাক্কায় ডিজিটাল, ভৌতবিজ্ঞান ও জীভবিজ্ঞানের দেয়াল ধসে যাচ্ছে। অসংখ্য কাজেই করা যাচ্ছে সশরীরে উপস্থিত না থেকে, স্পর্শবিহীনভাবে। এটাই এখন বৈশ্বিক বাস্তবতা, যার ছোঁয়া লেগেছে আমাদের জাতীয় ও দৈনন্দিন জীবনে। ২০১৪ সালে ১৪ ই নভেম্বর থেকে সিঙ্গাপুর পৃথিবীর প্রথম স্মার্ট জাতি হিসেবে যাত্রা শুরু করে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রযুক্তি, যেমন- কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), NLP, সেন্সর, রোবটিক্স, আরোপিত বাস্তবতা (AR), ভার্চুয়াল বাস্তবতা (VR), ইন্টারনেট অফ থিংস (loT), Big Data, Data Analytics, ব্লক চেইন ইত্যাদি জাতীয়ভাবে ব্যবহারের পরিকল্পনা ঘোষণা করে স্মার্ট জাতি রূপান্তরের প্রধান লক্ষ্য ছিল সামগ্রিক উৎপাদনশীলতা বাড়ানো, সিঙ্গাপুরবাসীদের জীবনমান বৃদ্ধি, দেশের মেধা দেশে রাখা এবং বিদেশি মেধাকে সিঙ্গাপুরে আকর্ষণ করা। সিঙ্গাপুর স্মার্ট জাতি হওয়ার চেষ্টায় তিনটি মূল স্তম্ভ নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এগুলো হচ্ছে- ডিজিটাল অর্থনীতি, ডিজিটাল সরকার এবং ডিজিটাল সমাজ।
ডিজিটাল দুনিয়ায় বৈশ্বিক ব্যবসা-বাণিজ্য, লেনদেন এবং উৎপাদন ব্যবস্থা বদলে যাচ্ছে। আমাদের ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলো এর সাথে সংশ্লিষ্ট জনবলকে এই পরিবর্তনের উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। ডিজিটাল সরকার স্মার্ট জাতি তৈরির অন্যতম নিয়ামক। প্রত্যেক নাগরিক প্রযুক্তির সুবিধা ভোগ করবে এবং প্রযুক্তি ব্যবহারে অভ্যস্ত হবে, স্বাচ্ছন্দ্য ও নিরাপদ বোধ করবে। ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি এবং শিক্ষা স্মার্ট জাতি গঠনের অন্যতম চাবিকাঠি। নাগরিকদের প্রত্যেকে প্রযুক্তি ব্যবহারের সমঅধিকার ভোগ করবে এবং প্রযুক্তির সাথে খাপ খাইয়ে নিবে এবং প্রযুক্তির নিরাপত্তার ব্যাপারে নিশ্চিত থাকবে। অর্থাৎ ই-সিটিজেন, ই-ইকোনমি, ই-গভর্নমেন্ট, ই-সোসাইটির সম্মিলিত ফলই হচ্ছে স্মার্ট রাষ্ট্র। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ডিজিটাল বাংলাদেশ যেমন আজকের বাস্তবতা, স্মার্ট বাংলাদেশও তেমনি আগামীর অনিবার্যতা।
লেখক :
অধ্যাপক, মার্কেটিং বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।