নিজস্ব প্রতিবেদক: বুড়িগঙ্গার লঞ্চডুবিতে ৩৪ জনের মৃত্যুর ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন দিলেও দুর্ঘটনার কারণ ও এর জন্য কারা দায়ী তার প্রকাশ করেনি। ফলে সদরঘাটের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ যায়গায় এতো মানুষের প্রাণ হানিতে জড়িতরা দেশবাসী দৃষ্টির আড়ালেই থেকে যাচ্ছে। নতুন কোনো ইস্যুতে এ মর্মান্তিক হারিয়ে যাবে। অভিজ্ঞ মহলের আশঙ্কা অন্য সব দুর্ঘটনার মতোই এক সময় চাপা পরে যাবে মর্নিং বার্ড এর ৩৪ যাত্রীর প্রাণহানির ঘটনা।
মর্নিং বার্ডকে চাপা দেয়ার ঘটনায় ময়ূর-২ নামের লঞ্চটিকে দায়ী করে প্রতিবেদন দিয়েছে ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিটি। কমিটি সদরঘাট থেকে খেয়াঘাট সরিয়ে নেওয়া এবং সদরঘাটে অলস লঞ্চ বসিয়ে না রাখাসহ ২০ দফা সুপারিশ করেছে। তদন্ত কমিটি বলছে, মুন্সিগঞ্জ থেকে ঢাকার সদরঘাটের উদ্দেশে ছেড়ে আসা মর্নিং বার্ডকে ময়ুর–২ প্রথমে ধাক্কা দিলে লঞ্চটি আড়াআড়ি হয়ে যায়। এরপর লঞ্চটির ওপর ময়ূর-২ উঠিয়ে দেওয়া হয়। কমিটি দুর্ঘটনার জন্য ময়ূর–২ লঞ্চের মাস্টার (চালক) ও সে সময় লঞ্চ চালানোর সঙ্গে যুক্ত অন্যদের প্রধানত দায়ী করেছে।
বুড়িগঙ্গার লঞ্চডুবির ঘটনায় নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) তদন্ত কমিটি গঠন করে। তবে ওই ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের নাম এবং দুর্ঘটনার কারণ এখনই প্রকাশ করা হচ্ছে না। পুলিশের তদন্তের জন্য এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে মন্ত্রণালয়।
আজ মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে নৌ প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বুড়িগঙ্গায় লঞ্চডুবির ঘটনায় মামলা হয়েছে। ওই মামলার প্রতিবেদন প্রকাশের কথা রয়েছে ১৭ আগস্ট। পুলিশের দায়ের করা মামলার তদন্তের স্বার্থে দুর্ঘটনার কারণ এবং কারা দায়ী, তা প্রকাশ করা যাচ্ছে না।
বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান গোলাম সাদেক গণমাধ্যমকে বলেন, বুড়িগঙ্গায় মর্নিং বার্ড লঞ্চ ডুবিয়ে দিয়ে ৩৪ জনের মৃত্যুর জন্য দায়ী ময়ূর-২ নামের লঞ্চটি। লঞ্চটির মাস্টার আবুল বাশারসহ অন্যরা। পুলিশের তদন্ত কার্যক্রমে যাতে কোনো ধরনের বিঘ্ন না ঘটে, সে জন্য লঞ্চ দুর্ঘটনার কারণ এবং যাঁদের নাম উঠে এসেছে, তা প্রকাশ করা হচ্ছে না।
একজন রিমান্ডে
লঞ্চ দুর্ঘটনায় পুলিশের দায়ের করা মামলায় আবদুস সালাম নামের এক আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে সদরঘাট নৌ থানা–পুলিশ। ঘটনার রহস্য উদঘাটনের জন্য ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (সিজিএম) আদালত আসামি আবদুস সালামকে তিন দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার অনুমতি দিয়েছেন। সদরঘাট নৌ-থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রেজাউল করিম গণমাধ্যমকে বলেন, বুড়িগঙ্গার লঞ্চ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ময়ূর-২ লঞ্চের কেরানি হিসেবে কর্মরত ছিলেন আবদুস সালাম। ঘটনার পর থেকে তিনি পলাতক ছিলেন। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি জানিয়েছেন, ঘটনার দিন ময়ূর-২ লঞ্চে মাস্টারসহ লঞ্চের ৮ থেকে ১০ জন কর্মচারী উপস্থিত ছিলেন।
সদরঘাটে অলস লঞ্চ রাখা যাবে না
গত ২৯ জুন সকাল ৮টার দিকে মুন্সিগঞ্জের কাঠপট্টি থেকে মর্নিং বার্ড নামের যাত্রীবাহী লঞ্চ সোয়া ৯টার দিকে ঢাকার সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালের কাছাকাছি চলে আসে। তখন সদরঘাটের ডকইয়ার্ডে অলস বসে থাকা ময়ূর-২ লঞ্চটি লালকুঠি ঘাটে আসার জন্য রওনা হয়।
নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের গঠন করা তদন্ত কমিটির সদস্য ঢাকা জেলা নৌ-পুলিশের প্রধান খন্দকার ফরিদুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, অলস বসে থাকা ময়ূর-২ লঞ্চটি সদরঘাটের লালকুঠি ঘাটে আসার জন্য রওনা হয়। তখন মুন্সিগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসা মর্নিং বার্ড সদরঘাটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। তখন পেছন থেকে ময়ূর-২ নামের লঞ্চটি বেপরোয়া গতি নিয়ে এসে মর্নিং বার্ডকে প্রথমে ধাক্কা দেয়। ওই ধাক্কার পর মর্নিং বার্ড লঞ্চটি আড়াআড়ি হয়ে গেলে তার ওপর দিয়ে ময়ূর-২ চালিয়ে দেয়। তখন সঙ্গে সঙ্গে মর্নিং বার্ড ডুবে যায়।
বুড়িগঙ্গায় নৌ-দুর্ঘটনা কমিয়ে আনার জন্য সদরঘাটে যাতে কোনো লঞ্চ অলস বসে না থাকতে পারে, সেই ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি। কমিটির প্রতিবেদন বলছে, সদরঘাটে পল্টুন ছাড়া আর কোনো লঞ্চ রাখা যাবে না। পর্যায়ক্রমে সদরঘাটে থাকা শিপইয়ার্ড ও ডকইয়ার্ড উঠিয়ে দিতে হবে। সদরঘাটে কোনো খেয়াঘাট রাখা যাবে না। লঞ্চের সামনে, পেছনে, মাস্টার ব্রিজ, ইঞ্জিন রুম, ডেকে ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা (সিসিটিভি) বসাতে হবে। মাস্টারের দেখার সুবিধার জন্য ব্যাক ক্যামেরার ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
ফিটনেসবিহীন লঞ্চ চলাচল বন্ধ নিশ্চিত করার সুপারিশ করে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন বলছে, প্রতিটি লঞ্চে জীবনরক্ষাকারী লাইফ জ্যাকেট ও বয়া রাখতে হবে। সব নদীপথে বিভিন্ন নৌযানের গতি সীমিত করে দিতে হবে।
টিকিট ছাড়া যাত্রী ওঠানো বন্ধ করা নিশ্চিত করতে হবে, উল্লেখ করে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন বলছে, প্রত্যেক লঞ্চে ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত টিকেট বিক্রি বন্ধ করতে হবে। টিকিট দেখানো ছাড়া যাত্রীকে লঞ্চে উঠতে দেওয়া যাবে না। প্রশস্ত ও ব্যস্ত নদীতে যথাযথ সনদধারী মাস্টার ও ড্রাইভার ছাড়া নৌযান পরিচালনা করা যাবে না।
ঢাকার সদরঘাটে নৌ-পুলিশের সংখ্যা বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন বলছে, লঞ্চ বা জাহাজ ঘাট ত্যাগ করার আগে ভয়েজ ডিক্লারেশন জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক করতে হবে। লঞ্চে কতজন যাত্রী নেওয়া হচ্ছে, কোন মাস্টার জাহাজ চালাচ্ছেন, তা সেখানে উল্লেখ করতে হবে। নৌযানের ফিটনেস ও নৌ–কর্মীদের যোগ্যতা সনদ ইস্যুতে নৌপরিবহন অধিদপ্তরকে আরও কঠোর ভূমিকা পালন করতে হবে। সদরঘাটে নৌ–পুলিশের জনবলের সংখ্যা ৯ জন থেকে বাড়িয়ে কমপক্ষে ২৫ জন করতে হবে। নৌযান ও নৌ–কর্মীদের চলাচলের অবস্থান নিশ্চিত করার জন্য নৌযান ও নৌ–কর্মীদের ডেটাবেজ তৈরি করতে হবে।