ইদ্রিছ আলী,, দীঘিনালা প্রতিনিধিঃ
প্রকৃতির অপরুপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি পার্বত্য চট্টগ্রাম। বাংলাদেশের প্রায় এক দশমাংশ আয়তন জুড়ে খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবান এ তিনটি জেলা নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম গঠিত। এ তিন জেলার আয়তন প্রায় ১৩,২৯৫ বর্গ কিলোমিটার। ২০১১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী, পার্বত্য চট্টগ্রামের মোট জনসংখ্যা প্রায় ১৫,৮৭০০০ জন৷ মোট জনসংখ্যার অর্ধেক ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠী ও অর্ধেক বাঙালিদের বসবাস। ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠীরা নিজ নিজ ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম, ঐতিহ্য ও কৃষ্টির স্বকীয়তা বজায় রেখেছে যুগ যুগ ধরে৷
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর নেতৃত্বে বিভিন্নমুখী ও বাস্তবভিত্তিক কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়। এ অঞ্চল ধাপে ধাপে উন্নয়নের গতিধারায় যুক্ত হতে শুরু করে। বঙ্গবন্ধুই সর্বপ্রথম রাষ্ট্র প্রধান হিসেবে পার্বত্য অঞ্চলের পরিকল্পিত উন্নয়নে চিন্তা শুরু করেন। পার্বত্য এসব জেলার শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি উন্নয়নসহ সরকারী চাকুরী ও স্থানীয় চাকুরীতে পার্বত্যবাসীদের যৌক্তিক অংশগ্রহণসহ প্রভৃতি বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয়।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালোরাতে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী কুচক্রীদের হাতে জাতির পিতা সপরিবারে নিহত হওয়ার পর এ অঞ্চলের বহুমুখী উন্নয়ন পরিকল্পনা ও অগ্রযাত্রা বাঁধাগ্রস্থ হয়ে পরে৷ পরে বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাহসী উদ্যোগ গ্রহণ করে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং সেখানকার মানুষের ভাগ্যোন্নোয়নের জন্য এগিয়ে আসেন৷ স্বাধীনতা অর্জনের এ পঞ্চাশ বছরে তার ধারাবাহিক উন্নয়নে পাল্টে গেছে পাহাড়ি জনপদ। ফলশ্রুতিতে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিরাজমান পরিস্থিতি নিরাশনের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর সরকারের সাথে জাতীয় জনসংহতি সমিতির মধ্যে ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়৷ যা পাহাড়ের শান্তি চুক্তি নামে পরিচিত।
পার্বত্য চুক্তির শর্তানুযায়ী ১৯৯৮ সালের ১৫ জুলাই 'পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়' নামে একটি আলাদা বিশেষায়িত মন্ত্রণালয় সৃষ্টি করা হয়। ফলশ্রুতিতে পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের সার্বিক উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন উন্নয়ন কার্যক্রম ক্রমান্বয়ে বেগবান হয়৷
এ অঞ্চলকে দেশের উন্নয়নের মূল স্রোতধারায় সম্পৃক্ত করতে অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় পার্বত্য অঞ্চলের জনগণের আর্থসামাজিক উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দারিদ্র্যমোচন, আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি, সুপেয় পানি, অবকাঠামো নির্মাণ, সৌর বিদ্যুৎ সুবিধা প্রদান সম্প্রসারণ ইত্যাদি কার্যক্রমকে অগ্রাধিকার প্রদান করা হয়েছে। বর্তমান সরকারের প্রেক্ষিত পরিকল্পনার আলোকে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় উন্নত ও সমৃদ্ধ পার্বত্য চট্টগ্রাম বিনির্মানের লক্ষ্যে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা প্রনয়ণ করা হয়েছে৷
সূত্র মতে, ২০১৭ সাল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা প্রাক প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের মাতৃভাষায় বিনামূল্যে বই বিতরণ করা হয়। তাছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে ১৯৯৮-৯৯ সালের অর্থবছরের উন্নয়ন বাজেট ৬৮.৯০ টাকা থেকে ২০২০-২১ অর্থবছরে ৮৬৪.৪ কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম পল্লী উন্নয়ন প্রকল্প (২য় পর্যায়ে) ২০১৩-১৮ অর্থবছরে ২৫,২৮২.০০ লক্ষ টাকা ব্যয়ে ৫২টি উপ প্রকল্পের মাধ্যমে তিন পার্বত্য জেলায় বাস্তবায়িত উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম হলো-এইচবিসি ৮৪.৬২৮ কি.মি. রাস্তা, ১৫০৭ টি নলকূপ স্থাপন, ১১৮টি রিংওয়েল, ১২,২৪০টি সিঁড়ি, ১,৭৮১টি পাওয়ার টিলার ও পাওয়ার পাম্প,১৯টি পানি সংগ্রহকারী ট্যাংক , ৩৮,৮৮৮ মিটার সেচ নালা নির্মাণ, ২০৭ মিটার বাঁধ নির্মাণ, ৬টি ওয়াটার শেট নির্মাণ, ৩০১.১৫ মিটার ফুট ব্রীজ নির্মাণ, ৫৪৭.৫০ মিটার কালবার্ট নির্মাণ, ৪,০৩২.৯৫ মিটার ইউ ড্রেন নির্মাণ, ১০টি পুকুর খনন, ৯টি মার্কেট শেট নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়াও ভূমি অধিগ্রহণের আওতায় বান্দরবান জেলার ৩৩.৯২ একর জমিতে ২১২ পরিবারকে আংশিক ৩৭২.২৯ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড পার্বত্য অঞ্চলে উন্নয়ন মূলক কার্যক্রম বাস্তবায়নের অগ্রগামী একটি প্রতিষ্ঠান। সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড শিক্ষা, যাতায়াত, সমাজ কল্যান, ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ, কৃষি, ক্রীড়া ও সংস্কৃতি সহ বিভিন্ন আর্থসামাজিক ও আয় বর্ধনমূলক খাতের স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদী প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। তাছাড়া ২০১৩-১৮ অর্থবছরে শিক্ষা খাতে ৩,৬২৪.০০ লক্ষ টাকা ব্যায়ে ১৭টি দীর্ঘ মেয়াদি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে।শিক্ষাখাতে একাডেমিক ভবন নির্মাণ, ছাত্রাবাস-ছাত্রীনিবাস নির্মাণ, স্কুল কলেজে আসবাবপত্র সরবরাহ এবং কম্পিউটার ও মাল্টিমিডিয়া সামগ্রী সরবরাহ করেছে। শিক্ষাখাতে আরও উন্নিত করার লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি মেডিকেল কলেজ স্থাপন করা হয়েছে। তাছাড়া খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবান জেলার প্রতিটি উপজেলায় একটি করে কলেজ সরকারীকরণ করা হয়েছে। পানির সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে ২০১৩-১৮ মেয়াদে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড ৬৬০.০০ লক্ষ্য টাকা ব্যয়ে কৃষি, সেচ ও পানীয় জল খাতে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছে। একই অর্থ বছরে ৮টি দীর্ঘ মেয়াদি সমাজকল্যাণ খাতে প্রকল্প গ্রহণ করেছে৷ ভৌত অবকাঠামো খাতে একই অর্থ বছরে ৩,৫৭৬.০০ লক্ষ্য টাকা ব্যয়ে ১০ টি দীর্ঘ মেয়াদি প্রকল্প গ্রহণ করেছে। তিন পার্বত্য জেলার ২৬টি উপজেলার ১১৯ টি ইউনিয়নে ৪০০০ পাড়াকেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে প্রত্যন্ত এলাকার ১,৬৫,৩৪৩ পরিবারকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, পানি, পয়ঃব্যবস্থা ইত্যাদি মৌলিক সেবা প্রদান করছে।
পাহাড়ের প্রত্যন্ত এলাকায় বিদ্যুৎ সেবা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া পার্বত্য অঞ্চলের অন্যতম বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র কাপ্তাই থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলায় ৩৩ হাজার ভোল্টের বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে।
খাগড়াছড়ি জেলার বিভিন্ন উপজেলার সাথে যোগাযোগ নেটওয়ার্ক তৈরি করার লক্ষ্যে গ্রামীণ সড়ক অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পের ব্যয় ২,৮৪৩.০০ লক্ষ্য টাকা। বাস্তবায়িত কাজের মধ্যে ১৮ কি.মি. মাটির কাজ, ১৫ কি.মি. এইচবিবি করণ, ৬,১০০ মিটার এলইউ ড্রেইন, ৮৫ মিটার কালভার্ট ও ৩২৭ মিটার রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ উল্লেখযোগ্য।
রাঙামাটি জেলার উপজেলা সদরের সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের লক্ষ্যে গ্রামীণ সড়ক অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পের বরাদ্দ ছিল ৩,২০০.০০ লক্ষ্য টাকা। প্রকল্পের আওতায় রাঙামাটি সদর ও বাঘাইছড়ি এলাকায় ৪কি.মি. মাটির কাজ, ৩কি.মি. এইচবিবি করণ, ২১০০ মিটার এলইউ ও ৪৫ মিটার রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ করা হয়েছে। উপজেলা হেড কোয়াটারের সাথে দূর্গম গ্রামের সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং কৃষি পন্যের বাজার সম্প্রসারণের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
বান্দরবান জেলায় পল্লী অবকাঠামো নির্মাণের জন্য প্রাক্কলিত ব্যয় ৪,৮৯৮.০০ লক্ষ্য টাকা। প্রকল্পের অর্থায়নে লামা উপজেলার সরই ইউনিয়ন পরিষদ হতে হাসানভিটা রাস্তার মাথা পর্যন্ত নির্মাণ চলমান রয়েছে। এ পর্যন্ত ১.৫০ কি.মি. এইচবিবি করন, ১টি সিঙ্গেল বক্স কালভার্ট নির্মাণ, ৮০ মিটার রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ ও ৬টি ড্রেইন নির্মাণ করা হয়েছে।
তাছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর সামগ্রিক কল্যান নিশ্চিত করণ এবং বিভিন্ন অবকাঠামো খাতসহ অন্যান্য উন্নয়নে খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদ, রাঙামাটি জেলা পরিষদ ও বান্দরবান জেলা পরিষদের ভূমিকা অপরিসীম।
শান্তিচুক্তির ২ যুগে পাল্টে গেছে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনপদ। এ উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি আর্থ সামাজিক উন্নয়নে সরকারকে আরও জোড়ালো ভূমিকা নেওয়ার দাবী এ অঞ্চলে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর।
প্রতিষ্ঠাতা : মেজর (অব) মোঃ মোদাচ্ছের হোসাইন, সম্পাদক মন্ডলির সভাপতি: বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুজ্জামান আহমেদ এমপি, ব্যবস্থাপনা সম্পাদক: তৌহিদ আহমেদে রেজা, বার্তা সম্পাদক: আসমা আহমেদ কর্তৃক ৫৪ কামাল আতাতুর্ক এভিনিউ সৈয়দ ভবন, ঢাকা-১২১৩ থেকে সম্পাদিত ও প্রকাশিত
© All rights reserved 2020 Daily Surjodoy