ফারহানা বি হেনা
সম্ভাবনাময় হাওর পর্যটন
সাগর > সায়র > হাওর। ভাষাবিদদের মতে সাগর শব্দের অপভ্রংশ সায়র থেকে হাওর শব্দের উৎপত্তি। অনেক পণ্ডিত মনে করেন প্রায় চার হাজার বছর আগে আজকের হাওরাঞ্চলই ছিল প্রাচীন লোকসাহিত্য বেহুলা লখিন্দরে উল্লিখিত লৌহিত সাগরের বিশাল জলরাশি। সম্ভবত ষষ্ঠ শতাব্দীতে সমুদ্র থেকে বিবর্তিত হয়ে হাওরের উৎপত্তি। প্রকৃত অর্থে হাওর হচ্ছে এক বিস্তৃত জলমগ্ন বা জলশূন্য নিম্নভূমি, যা বর্ষায় অথৈ জলের আধার আবার শুকনা মৌসুমে ফসলের ভান্ডার। দেশের পূর্ব-উত্তরাংশের কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, সিলেট, মৌলভীবাজার ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া- এই সাতটি জেলার ৫৭ উপজেলা নিয়ে বাংলাদেশের হাওর এলাকা গঠিত। আট হাজার ৫৯০ বর্গকিলোমিটার পরিধির বিশ্বের সর্ববৃহৎ মিঠাপানির একক ওয়াটার বডি এই হাওর অঞ্চল। প্রকৃতি, লোকসাহিত্য, সংগীত, সংস্কৃতি, বৈচিত্র্যময় খাদ্যসম্ভার আর বর্ণিল উৎসব নিয়ে আমাদের হাওর অঞ্চল পর্যটনের সম্ভাবনাময় গন্তব্য। দেশের নদী, পাহাড় ও সমুদ্রের সঙ্গে হাওর যুক্ত হয়ে আমাদের পর্যটন সম্ভারকে করেছে বৈচিত্র্যময় ও সমৃদ্ধ।
হাওরের প্রকৃতি তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে ভাস্বর। তার তুলনা সে নিজেই। একই স্থান রূপ বদলের ভিন্নতায় প্রকৃতির অপরূপ মায়াশোভিত চিত্র তুলে ধরে। হাওরের অপরূপ প্রকৃতির শোভা ঋতুতে ঋতুতে পরিবর্তন হয় নানান অবয়বে। বাংলাদেশের ষড় ঋতুর ঋতু বৈচিত্র্য আর বৈশিষ্ট্য এত সুন্দরভাবে হাওর অঞ্চল ছাড়া দেশের আর কোথাও দেখা যায় না। হাওর হলো ঋতু বৈচিত্র্যের চারণভূমি, লীলা নিকেতন। বর্ষায় দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশি, ভাসমান দ্বীপসদৃশ ছোট ছোট গ্রাম, ভেসে চলা পালতোলা নৌকা বা নানান শব্দ তৈরি করে জল ছিটিয়ে ছুটে চলা ইঞ্জিনের নৌকা, থেমে থেমে মাঝির কণ্ঠে গীত লোকগান, হিজল-তমাল আর নলখাগড়ার বন, জলে ভেসে বেড়ানো হাঁসের পাল, সন্ধ্যায় কুপিবাতি আর জোনাকপোকার আলো-আঁধারির মোহনীয় রূপ।
হাওর মানেই পার্বণ। বারো মাসে তেরো পার্বণ বহুল প্রচলিত কথাটিও যেন এখানে অনেকটাই মিথ্যে। আবহমানকাল ধরে হাওর অঞ্চলের আচার, ব্রত, উৎসব ও লোকাচার বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে বিশেষ করে লোকসংস্কৃতিকে সচল, সজীব ও প্রাণবন্ত রেখেছে। এই প্রাণবন্ত ধারা দেশের লোকসংস্কৃতি ও উৎসবকে পরিপকস্ফতা দান করে হাজার বছরের প্রাচীন বাঙালি সংস্কৃতির ধারায় এনেছে বৈচিত্র্য ও ঐশ্বর্য।
হাওর আমাদের শস্য ও মৎস্য ভান্ডার। দেশের উৎপাদিত খাদ্যশস্য ও শাকসবজির একটি বড় অংশ আসে হাওর থেকে। নানান প্রজাতির দেশি মাছের আধার হাওরে প্রায় ১৫০ প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়। খাদ্যের প্রাচুর্যতা এখানে জন্ম দিয়েছে নানান ধরনের খাবার আর পিঠাপুলির। হাওরের তাজা মাছের নানান পদ, বর্ষায় হাঁসের মাংস ও ডিম, বিখ্যাত চ্যাপা শুঁটকির নানান আয়োজন, নকশি পিঠা, অষ্টগ্রামের বিখ্যাত পনির যে কোনো খাদ্য রসিকের মন দখল করে নেওয়ার জন্য যথেষ্ট। বৈচিত্র্য ও সমৃদ্ধ খাদ্য সম্ভারের পাশাপাশি হাওরের কুটির শিল্পও যথেষ্ট সমৃদ্ধ। নানান রঙের হাতপাখা, নকশিকাঁথা, মাটির পাত্র, বেত ও বাঁশ দিয়ে তৈরি বিভিন্ন সরঞ্জাম মানুষকে আকৃষ্ট করবেই।
হাওরের উর্বর মাটি, বিশাল জলরাশি এবং মানবকুল এখানকার শ্রেষ্ঠ সম্পদ। এই সম্পদ ব্যবহার করে ইকো-ট্যুরিজম ও কমিউনিটি ট্যুরিজম প্রবর্তন করার উৎকৃষ্ট ক্ষেত্র এ অঞ্চল। বর্ষাকালে হাওরের ২৬ হাজার গ্রামের প্রায় ২ কোটি মানুষের ৬০ ভাগ মানুষ অবসর সময় কাটায়। পর্যটন শ্রমঘন শিল্প হওয়ায় একজন পর্যটকের আগমনে সেবা খাতে ১১ জনের সরাসরি কর্মসংস্থান হয়। পরোক্ষভাবে কাজ পান আরও ৩৩ জন। বাংলাদেশ ট্যুরিস্ট পুলিশের হিসাব অনুযায়ী ২০১৯ সালে দেশে অভ্যন্তরীণ পর্যটকের সংখ্যা ছিল এক কোটি ৫৭ লাখ। এ ছাড়াও প্রতিবছর প্রায় তিন লাখ বিদেশি পর্যটক বাংলাদেশ ভ্রমণ করে। এদের একটি অংশকে হাওর ভ্রমণে আগ্রহী করতে পারলে হাওরের অবসর সময় কাটানো বিশালসংখ্যক মানুষের বিকল্প কর্মসংস্থানের উপায় হতে পারে পর্যটন। এতে নতুন নতুন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা সৃষ্টি হবে। পরিকল্পিতভাবে পর্যটন শিল্পের বিকাশের ফলে দারিদ্র্য বিমোচন, গ্রামীণ অবকাঠামো ও অর্থনীতির উন্নয়নের পাশাপাশি পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়ায় লোকসংস্কৃতি, সংগীত ও কুটির শিল্প পুনরুজ্জীবন লাভ করে বিকশিত হবে। হাওরাঞ্চলের মানুষের জীবনমানের উন্নয়নের পাশাপাশি নারীর ক্ষমতায়নেরও অন্যতম উপায় হবে পর্যটন।
ইদানীং বাংলাদেশের তরুণসহ নানান বয়সী লোকের কাছে হাওর জনপ্রিয় হতে শুরু করেছে। এ ধারা ধরে রেখে হাওরকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে জনপ্রিয় ও টেকসই পর্যটন গন্তব্যে পরিণত করার জন্য বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড কাজ করছে। ইতোমধ্যে হাওরাঞ্চলের সব জেলার জনপ্রতিনিধি, সরকারি কর্মকর্তা, পর্যটন অংশীদার ও গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের সঙ্গে এ বিষয়ে করণীয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। হাওরের পর্যটন সম্ভাবনাকে উপযুক্ত প্রচারণার মাধ্যমে পর্যটকদের কাছে তুলে ধরার কার্যক্রম নেওয়ার পাশাপাশি কমিউনিটি ট্যুরিজম প্রবর্তনে হাওরকে প্রাধান্য দিয়ে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে। হাওরের বিভিন্ন জায়গায় পর্যটন সুবিধা প্রবর্তনে কাজ চলমান রয়েছে। পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশ ট্যুরিস্ট পুলিশও সেখানে আন্তরিকভাবে কাজ করছে। হাওরে ক্রুজ পরিচালনা ও বোট হাউসে বসবাসের ব্যবস্থা প্রচলনের পরিকল্পনাও বিবেচনা করা হচ্ছে। এ ছাড়াও হাওর অঞ্চলের পর্যটনের বিস্তারিত উন্নয়ন রূপরেখা অন্তর্ভুক্ত থাকবে পর্যটন মহাপরিকল্পনায়ও।
Leave a Reply