সুর্যদয় ডেস্ক:করোনাভাইরাস প্রতিরোধে ঢাকা মহানগরী ও জেলার যেসব এলাকা বা ওয়ার্ডকে ‘রেড, ইয়েলো ও গ্রিন জোন’ হিসেবে চিহ্নিত করে লকডাউন প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তাতে কিছু অদলবদল আসছে। চিহ্নিত করার প্রক্রিয়ার শুরুর দিকে এলাকাভিত্তিক মোট সংক্রমিতদের তালিকা ধরেই কাজ হয়। এ কারণেই রাজধানীর মিরপুর, মোহাম্মদপুর, উত্তরার মতো বড় বড় কিছু এলাকাকে ‘রেড জোন’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ নিয়ে লকডাউন বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ ও সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। এলাকার মানচিত্র তৈরিতেও জটিলতা দেখা দিয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে এখন জরুরি ভিত্তিতে নতুন করে মোট আক্রান্তদের থেকে যারা সুস্থ হয়ে গেছে কিংবা মৃত্যুবরণ করেছে তাদের বাদ দিয়ে মানচিত্র তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। এখন কেবল ১৪ দিনে যাদের করোনা শনাক্ত হয়েছে তাদের তথ্য সংগ্রহ করে প্রতি এক লাখ জনগোষ্ঠীর মধ্যে ৬০ জন ধরে ‘রেড জোন’ চিহ্নিত করা হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মার্চ থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত মোট আক্রান্ত হিসেবে যাদের এলাকাভিত্তিক পরিসংখ্যানে দেখানো হয় সেখান থেকে সুস্থ হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের বাদ না দিলে সঠিক চিত্র পাওয়া যাবে না। কারণ ১০১ দিনে অনেক এলাকায় সংক্রমণ বেড়েছে, কমেছে। আবার সুস্থও হয়েছে। সেখান থেকে এলাকা ধরে ধরে সুস্থ হওয়াদের বাদ দিলে চিহ্নিত এলাকায় অদলবদল আসতে পারে।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ড. মুশতাক হোসেন বলেন, “শুরু থেকে এ পর্যন্ত সুস্থ হওয়ার কয়েকটি চক্র ১৪ বা ২১ দিন কেটে গেছে। অর্থাৎ ওই সময়ের মধ্যে যারা আক্রান্ত হয়েছে এবং তাদের মধ্যে যারা বেঁচে আছে তারা করোনামুক্ত। তাই তাদের ধরে ‘রেড জোন’ চিহ্নিত করা হলে ভুল হবে। সে কারণে ওই ‘রেড জোন’ থেকে সুস্থ হওয়াদের ‘গ্রিন জোনে’ ফেলতে হবে। এ ক্ষেত্রে ১৪ দিনের মধ্যে যারা পজিটিভ হয়েছে তারাই কেবল ‘রেড জোনে’ পড়বে। সেইসঙ্গে যেই এলাকায় ১৪ দিনে প্রতি লাখে গড়ে ৬০ জন আক্রান্ত পাওয়া যাবে শুধু সেই এলাকাই লকডাউনের আওতায় আসবে।”
আইইডিসিআরের তথ্য অনুসারে, মোট আক্রান্ত হিসাবে ঢাকার সর্বোচ্চ ১০টি এলাকার তালিকায় রয়েছে মিরপুর (১২৮০), উত্তরা (৬৪১), মোহাম্মদপুর (৫৭৭), মহাখালী (৫১৫), মুগদা (৪৮৮), যাত্রাবাড়ী (৪৮১), ধানমণ্ডি (৪৪৫), মগবাজার (৩২৭), তেজগাঁও (৩১২) ও কাকরাইল (৩০৪)। এ হিসাব সংক্রমণ শনাক্তের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত। এখন তাদের মধ্যে কোন এলাকায় কারা সুস্থ হয়েছে, কারা ১৪ দিনের মধ্যে পজিটিভ হয়েছে তা খুঁজে বের করার কাজ করছে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের এটুআই প্রকল্প ও আইইডিসিআর। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনমতো ফোন করেও তথ্য নেওয়া হচ্ছে আক্রান্তদের কাছ থেকে। আবার আইইডিসিআরের কাছে থাকা তথ্যের সঙ্গে চলছে যাচাই-বাছাই।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. আবুল কালাম আজাদ জানান, নাগরিকদের জীবন-জীবিকা নির্বাহের বিষয়কে বিবেচনায় নিয়ে সারা দেশে ৬৬ দিন সাধারণ ছুটির পর গত ৩১ মে থেকে সীমিত পরিসরে বিভিন্ন অর্থনৈতিক কার্যক্রম চালু করা হয়। কিন্তু সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে করোনা সংক্রমণের হার বেড়ে যাওয়ায় সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন, ২০১৮ (২০১৮ সালের ৬১নং আইন)-এর সংশ্লিষ্ট ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সরকারের অনুমোদনক্রমে গত ১০ জুন নতুন কিছু নির্দেশাবলি জারি করা হয়েছে। এখন তা বাস্তবায়নের নানামুখী কাজ চলছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে এটা শেষ হলেই কোন এলাকায় কবে লকডাউন শুরু হবে তা স্থানীয় কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দিবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, নতুন এসব নির্দেশনা অনুযায়ী করোনাভাইরাসসৃষ্ট কভিড-১৯ রোগের চলমান ঝুঁকি বিবেচনায় দেশের যেকোনো ছোট বা বড় এলাকাকে ‘রেড, ইয়েলো ও গ্রিন জোন’ হিসেবে চিহ্নিত করা এবং সেখানে লকডাউন বাস্তবায়ন করা হবে। এলাকা চিহ্নিত করে সেটা ঘোষণার ক্ষমতা সংশ্লিষ্ট জেলার সিভিল সার্জনের কাছে অর্পণ করা হয়েছে। তবে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সিভিল প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা ও সশস্ত্র বাহিনী এবং স্বেচ্ছাসেবকদের সহায়তায় এলাকা চিহ্নিত করার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে হবে। সুনির্দিষ্টভাবে সংশ্লিষ্ট এলাকার কোন অংশে লকডাউন কার্যকর হবে এবং এর পরিধি কী হবে তা স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে ও কভিড-১৯ সংক্রান্ত স্থানীয় কমিটিগুলোকে নির্ধারণ করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এ বিষয়ে একটি বিস্তারিত গাইডলাইন তৈরি করে স্থানীয় কর্তৃপক্ষগুলোকে দিয়েছে। এ ছাড়া চিহ্নিত এলাকার (জোন) সংজ্ঞা ও বাস্তবায়ন কৌশল সময়ে সময়ে পর্যালোচনা করে পরামর্শ দেওয়ার জন্য একটি কেন্দ্রীয় কারিগরি গ্রুপ গঠন করা হয়েছে।
ওই সূত্রটি জানায়, প্রাথমিকভাবে তিনটি জেলায় (গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদী) এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের রাজাবাজার (পূর্ব রাজাবাজার) এবং দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ওয়ারীতে পরীক্ষামূলকভাবে এলাকা চিহ্নিত করে লকডাউন কার্যকরের পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। বর্তমানে গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদীর চিহ্নিত এলাকা এবং ঢাকার পূর্ব রাজাবাজার পরীক্ষামূলক লকডাউনে রয়েছে। ওয়ারীতে লকডাউন কার্যকরে সুনির্দিষ্ট এলাকা চিহ্নিতকরণের কাজ চলছে। এই অভিজ্ঞতা দেশের অন্যান্য এলাকায় কাজে লাগাতে সহায়ক হবে। দেশের বিভিন্ন জেলা ও নগরে এ গাইডলাইন অনুসারে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ পরিস্থিতি পর্যালোচনা করছে। পাশাপাশি প্রয়োজনীয় সুপারিশ প্রণয়ন করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মতামত অনুযায়ী এলাকাভিত্তিক লকডাউন পদ্ধতি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এ এস এম আলমগীর বলেন, ‘ম্যাপিং (এলাকা চিহ্নিতকরণ) নিয়ে আইইডিসিআর ও এটুআইর (এক্সেস টু ইনফরমেশন) টিম কাজ করছে। পুরো বিষয়টি চূড়ান্ত হতে আরো কিছুটা সময় লেগে যাবে। তবে ঠিক কত দিন লাগবে সেটা নিশ্চিত করে এখনই বলা যাচ্ছে না।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কেন্দ্রীয় কারিগরি গ্রুপের সদস্যসচিব ডা. জহিরুল করিম জানান, অব্যাহতভাবে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করে এলাকাভিত্তিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা এবং অধিকতর বাস্তবমুখী সংজ্ঞা ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নির্ধারণের কাজ চলছে। ঢাকা সিটি করপোরেশনসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সংজ্ঞানুযায়ী যেখানে যখন প্রয়োজন তখন ‘রেড জোন’ ঘোষণা করা হবে। কাজেই ‘রেড জোন’ ঘোষণা বা পরিবর্তন একটি চলমান প্রক্রিয়া। স্থানীয় পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়েই যখন প্রয়োজন তা করা হবে এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষ তা বাস্তবায়ন করবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের থেকে গতকাল মঙ্গলবার পাঠানো এক বিবৃতিতে জানানো হয়, প্রাথমিকভাবে ‘রেড জোনের’ জন্য যেসব বিধিনিষেধ নির্ধারণ করা হয়েছে সেগুলো হচ্ছে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে বর্ধিত সময়ে কৃষিকাজ, গ্রামাঞ্চলে কলকারখানা ও কৃষি পণ্য উৎপাদন কারখানায় কাজ করা যাবে। তবে শহরাঞ্চলে সব বন্ধ থাকবে। বাসা থেকেই অফিসের কাজ করতে হবে। কোনো ধরনের জনসমাবেশ করা যাবে না। কেবল অসুস্থ ব্যক্তি হাসপাতালে যেতে পারবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে শুধু প্রয়োজনে বাসা থেকে বের হতে পারবে। রিকশা ভ্যান, অটোরিকশা, ট্যাক্সি বা নিজস্ব গাড়ি চলাচল করবে না। ‘রেড জোনের’ ভেতর সড়ক পথ, নদীপথ ও রেলপথে কোনো যান চলাচল করবে না। জোনের ভেতরে ও বাইরে মালবাহী নৌযান ও জাহাজ কেবল রাতে চলাচল করতে পারবে। প্রতিটি এলাকায় সীমিত পরিমাণে প্রবেশ ও বহিরাগমন পয়েন্ট নির্ধারণ করে কঠোরভাবে জনগণের যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ‘রেড জোনে’ মুদি ও ওষুধের দোকান খোলা থাকবে। রেস্টুরেন্ট ও খাবার দোকানে কেবল হোম ডেলিভারি সার্ভিস চালু থাকবে। যেখানে বাজার খোলা থাকবে সেখানে শুধু প্রয়োজনে নির্দিষ্ট সময়ে যাওয়া যাবে। শপিং মল, সিনেমা হল, জিম-স্পোর্টস কমপ্লেক্স, বিনোদনকেন্দ্র বন্ধ থাকবে। আর্থিক লেনদেন বিষয়ক কার্যক্রম যেমন টাকা জমাদান-উত্তোলন স্বাস্থ্যবিধি মেনে কেবল এটিএমের মাধ্যমে করা যাবে। তবে সীমিত ব্যাংকিং ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। এলাকার সন্দেহজনক রোগীদের নমুনা পরীক্ষা করা হবে। শনাক্ত রোগীরা হোম আইসোলেশন বা প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশনে থাকবে। মসজিদ-উপাসনালয়ে শুধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সামাজিক দূরত্ব মেনে ইবাদত-উপাসনা করতে পারবেন। লকডাউন বাস্তবায়নকালে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ সবার প্রয়োজনীয় নাগরিক সেবাসহ অন্যান্য সুবিধা-অসুবিধার দিকে খেয়াল রাখবে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। সাধারণভাবে ‘রেড জোন’ ২১ দিনের জন্য বলবৎ হবে। পরিস্থিতির উন্নতি হলে ‘রেড জোন’ পরিবর্তন করা হবে। এ ক্ষেত্রে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ১৫ জুন জারি করা প্রজ্ঞাপন অনুসরণ করতে বলা হয়েছে।