ইমাম হোসেন জীবনঃ
বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রামের পেছনে দুটি কারণ ছিল, প্রথম পাকিস্তান বিশেষ করে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক থেকে রাজনৈতিক ও স্বাধিকার। দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিক উন্নয়ন অর্থাৎ এই ভূখণ্ডের মানুষের সার্বিক উন্নয়ন। নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে আমরা বর্তমান পর্যায়ে উপনীত হয়েছি।
তবে বিশেষ লক্ষণীয় যে, উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখার জন্য সচেষ্ট সবাই। কোন সরকার কতটুকু অর্জন করেছে, সেটার চুলচেরা বিশ্নেষণ এবং দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার কিন্তু বলা যেতে পারে একটা সন্তোষজনক জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে অন্যান্য দেশের তুলনায় বিশেষ করে অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের তুলনায়।
ইদানীং যে দুটি বিশেষ অর্জন নিয়ে আলোচনা চলছে, একটা হলো দেশ এখন নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে পরিচিত এবং আমাদের প্রত্যাশা আমরা দ্রুত উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবো।
আরেকটা হলো, এখন জাতিসংঘের সংজ্ঞা অনুযায়ী অনুন্নত দেশের পর্যায় থেকে উন্নয়নশীল পর্যায়ের দেশ হিসেবে গণ্য হবে। কতগুলো সূচকের ওপর ভিত্তি করে এসব পর্যায়গুলো ঠিক করা হয়। সরকার অবশ্য ২০২৬ সাল পর্যন্ত সময় নিয়েছে আনুষ্ঠানিকভাবে উন্নয়নশীল দেশের ঘোষণা করার জন্য। এটা একটা সঠিক পদক্ষেপ, কারণ নূ্যনতম পাঁচ বছর লেগে যাবে সব প্রস্তুতি সম্পূর্ণ করার জন্য এবং অবস্থানটিকে টেকসই হিসেবে দাঁড় করানোর জন্য।
কভিড-১৯-এর মহামারির ফলে সমগ্র বিশ্বের সব দেশের স্বাস্থ্য-আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক সব ক্ষেত্রে কতগুলো চ্যালেঞ্জ দেখা দিয়েছে। গতানুগতিক ধারায় সবকিছু আবারও স্বাভাবিক হয়ে এবং এগিয়ে যাবে এটা প্রত্যশা করা মোটেও সমীচীন হবে না।
সামষ্টিক অর্থনীতি পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, আমাদের প্রবৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, রেমিট্যান্স, মূল্যস্টম্ফীতি এবং বৃহৎ শিল্প ও সেবা খাত মোটামুটি সন্তোষজনক পর্যায়ে রয়েছে। তবে সেগুলোর সুফল সুষমভাবে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছায়নি। সমস্যাগুলো এখানেই।
দিনে দিনে ব্যক্তিগত আয় ও সম্পদের বৈষম্য বাড়ছে, কর্মসংস্থানের স্বল্পতা হেতু বেকার জনসংখ্যা (বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে) বাড়ছে, মূল্যস্টম্ফীতি বিশেষ করে খাদ্যদ্রব্য এবং অত্যাবশ্যকীয় সামগ্রীর (যাতায়াত, বাড়ি ভাড়া, স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদি) ব্যয়ভার বাড়ছে। যার ফলে দরিদ্র, নিম্নবিত্ত এমনকি মধ্যবিত্তদেরও আঘাত করছে।
কভিড-১৯-এর মহামারিতে আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ঘাটতি ধরা পড়েছে। আমাদের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার কিছুটা উন্নতি হলেও রোগের পরের ধাপ এবং নিরাময়ের ক্ষেত্রে দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগণ ভুগছে, শিশু ও মাতৃ অপুষ্টির হার, বিশেষ করে চরাঞ্চল ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখনও আশঙ্কাজনক। শিক্ষার হার বেড়েছে আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে, কিন্তু শিক্ষার মান বাড়েনি। শিক্ষা, প্রশিক্ষণ অনেক ক্ষেত্রে বিষয়াদির যথার্থতায় কিছুটা ঘাটতি থাকাতে শিক্ষা শেষে কর্মজীবন এমনকি আত্মকর্মসংস্থানেও তরুণ ও যুবকদের বেগ পেতে হচ্ছে।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান, যেমন ব্যাংক, বীমা, ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান, পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রণ ও তদারকির দুর্বলতার জন্য অর্থনৈতিক উন্নয়ন আরও দ্রুত ও জনগণের কল্যাণের জন্য সুষম হচ্ছে না। বিনিয়োগ আশানুরূপ নয় বিশেষ করে কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে খুবই স্বল্প। এগুলো হলো মোটা দাগে আমাদের মূল সমস্যা। সবকিছু ছাড়িয়ে যেটা দেখা যাচ্ছে, দুর্নীতি এবং অর্থের অপচয়।
নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনায় শক্ত প্রয়োগ এবং আইন ও নীতিমালার প্রয়োগ ও পরিপালনের অভাবে দিন দিন সব অর্জনগুলো হুমকির মুখে পড়ছে। এর ফলে হচ্ছে অর্থ পাচার, কিছুসংখ্যক ব্যক্তির অযৌক্তিক ভোগ বিলাস এবং সাধারণ জনগণের ওপর আর্থিক ও মানসিক চাপ, যাতে স্বাধীনতার মূল উদ্দেশ্যগুলোও ব্যাহত হতে পারে।
আমাদের প্রস্তুতির জন্য প্রয়োজন বেশ কিছু বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নেওয়া ও সেগুলো বাস্তবায়ন। প্রথমত, আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা বিশেষ করে নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো, উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো, বাজার ব্যবস্থায় প্রতিযোগিতা ও সুষম ক্ষেত্র আনা যা সব উদ্যোক্তা ও সৎ ব্যবসায়ীদের প্রেরণা জোগাবে। দ্বিতীয়ত, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় সংস্কার আনা, ব্যাংক কোম্পানি আইন, বীমা আইন, পুঁজিবাজার সম্পর্কিত আইন, প্রতিযোগিতা আইন এগুলোকে যুগোপযোগী করা এবং কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা। তৃতীয়ত, সরকারি আর্থিক ব্যবস্থাপনা আরও স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু করা।
সরকারি অর্থায়নে গ্রহণকৃত বিভিন্ন প্রকল্প, বিভিন্ন প্রশাসনিক কার্যক্রমে দুর্নীতি-অপচয় বন্ধ করা। প্রশাসনকে আরও স্বচ্ছ ও জবাবদিহিতামূলক করা। সরকারের রাজস্ব আদায় ও কর ব্যবস্থাকে আরও দক্ষ, কর্মতৎপর ও জনগণবান্ধব হিসেবে পরিণত করতে হবে। একইসঙ্গে এসব ক্ষেত্রে সব প্রক্রিয়া ও কার্যক্রম হতে হবে সুষম উন্নয়ন ও বৈষম্য হ্রাসের মাধ্যম হিসেবে। চতুর্থত, সরকারি প্রশাসন ও উন্নয়ন কার্যক্রম বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে।
সবকিছুই রাজধানী এবং কিছু বৃহৎ শহরভিত্তিক হয়ে যাচ্ছে, সেটার বিপরীত স্রোতে এখন যেতে হবে। স্থানীয় প্রশাসন, পল্লি অঞ্চলে সার্বিক উন্নয়ন, কৃষি ও সংশ্নিষ্ট, অত্যাশ্যকীয় ক্ষেত্র (পশুপালন, মৎস্য উৎপাদন ইত্যাদি) এবং পল্লি অঞ্চলে শিল্প-বাণিজ্যের বিস্তার এসব ক্ষেত্রে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। পঞ্চমত, শিল্প-বাণিজ্য প্রসারের ক্ষেত্রে রপ্তানি বহুমুখীকরণ, কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলোকে সরকারি ও বেসরকারি সব পর্যায়ে সম্প্রসারিত করতে হবে।
ইদানীং কভিড-১৯-উত্তর সরকারি আর্থিক প্রণোদনার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর এসব কর্মকাণ্ড মোটেও সন্তোষজনক নয়, এ রকম যেন পুনরাবৃত্তি না হয়। ষষ্ঠত, দেশের আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর, শৃঙ্খলা এবং জবাবদিহিতা আনতে হবে। সব শেষে যেটা উল্লেখ্য যে- সুশাসন, জবাবদিহিতা এবং সবক্ষেত্রে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত না করলে ভবিষ্যতে যে চ্যালেঞ্জগুলোর মোকাবিলা করতে হবে, সেগুলোর সুরাহা করা অত্যন্ত কঠিন হবে। সে জন্য দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং আপামর জনসাধারণের সহযোগিতা ও কার্যকরী অংশগ্রহণ।
প্রতিষ্ঠাতা : মেজর (অব) মোঃ মোদাচ্ছের হোসাইন, সম্পাদক মন্ডলির সভাপতি: বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুজ্জামান আহমেদ এমপি, ব্যবস্থাপনা সম্পাদক: তৌহিদ আহমেদে রেজা, বার্তা সম্পাদক: আসমা আহমেদ কর্তৃক ৫৪ কামাল আতাতুর্ক এভিনিউ সৈয়দ ভবন, ঢাকা-১২১৩ থেকে সম্পাদিত ও প্রকাশিত
© All rights reserved 2020 Daily Surjodoy