সাম্য ও মানবতার এক উজ্জ্বল নক্ষত্র নজরুল ইসলাম
লীটা চৌধুরী
রামপুরা ঢাকা
Facebook Twitter share
মানুষকে নিয়েই পৃথিবী, মানুষের সুখ-শান্তির মধ্যেই সমগ্র পৃথিবীর সৌন্দর্য। মানুষ বলতে পৃথিবীর প্রতিটি মানুষকেই বুঝতে হবে, কাউকে বাদ দিয়ে নয়। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষই যদি সমান মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়, প্রতিটি মানুষের যদি মানবিক অধিকারের নিশ্চয়তা মেলে, তবেই পৃথিবী সৌন্দর্যের লীলাভূমিতে পরিণত হবে। আর এমন পৃথিবীই মানব জাতির সকলেই কামনা করেন, কেবল অত্যাচারীরা ব্যতীত। সুন্দর পৃথিবী-প্রত্যাশী মানবগোষ্ঠীর মধ্যে মুষ্ঠিমেয় যে ক’জন নকীবের ভূমিকা পালন করেছেন তাঁদেরই অন্যতম কাজী নজরুল ইসলাম।
Surjodoy.com
১৮৯৯ সালের ২৪ মে(১১ জ্যৈষ্ঠ, ১৩০৬ বঙ্গাব্দ) ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এ মানবতাবাদী মহান পুরুষ। তিনি ছিলেন কাজি ফকির আহমেদ ও জাহেদা খাতুনের ষষ্ঠ সন্তান। তাঁর ডাকনাম ছিল'দুখু মিয়া'।
The Daily surjodoy
জীবনের নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে চুরুলিয়া গ্রামের দুখু মিয়া হয়ে ওঠেন মানবতা ও মানবতন্ত্রের পুরোধা। নজরুলের সাম্যবাদ সর্বব্যাপী, সর্বপ্লাবী। এর মধ্যে নেই কোনো অস্পষ্টতা, নেই কোনো ভণিতা-ভণ্ডামি। এটি অবশ্য নজরুল-মানসের সাধারণ বৈশিষ্ট্য যে, তিনি যা বিশ্বাস করেছেন তাই বলেছেন এবং যা বলেছেন তাই করেছেন। কোনো কিছু পাশ কাটিয়ে মহাকাব্য রচনার কবি তিনি নন। বরং সবকিছুকে হৃদয়ে ধারণ করে, জীবনের সবটুকু আকুতি দিয়ে মানবমুক্তির সনদ রচনার মহামানব তিনি। তিনি কবিÑ এটি তার আংশিক পরিচয়; প্রকৃত অর্থে গোটা পৃথিবীকে সৌন্দর্যময় মহাকাব্যে রূপান্তরের মহাকবি তিনি। সেই অর্থে তিনি মানবকুলের অন্তরঙ্গ বন্ধুদের ।
The Daily surjodoy
নজরুল কেবল সাম্যের বাণী প্রচার করেননি, তিনি অসাম্যের কদর্য রূপটি প্রত্যক্ষ করেছেন, এর ভয়াবহতা হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেছেন এবং তাঁর সকল কর্ম ও সাধনা দিয়ে সব ধরনের অসাম্য দূর করার চেষ্টা করেছেন। তাঁর সেই পথচলায় সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে তিনি সমৃদ্ধ করেছেন আমাদের গোটা সাহিত্য, রেখে গেছেন মানবমুক্তির চিরকালীন উপাদান।
The Daily surjodoy
নজরুলের সাম্যবাদ চাপিয়ে দেয়া কোন বিষয় নয়, কারও দয়ার দানও নয়। বরং এটি প্রকৃতির আইনেরই অংশ যা অলঙ্ঘণীয়। এ পৃথিবীর মালিকানা কোন ব্যক্তি, জাতি, গোষ্ঠী বা দেশ বিশেষের নয়। মালিকানা একমাত্র আল্লাহর। আল্লাহর সৃষ্ট জীব হিসেবে সকল মানুষের সমঅধিকার রয়েছে সবকিছুর মধ্যে। আর এটিই সাম্যের মূলমন্ত্র। মানুষে মানুষে যারা বৈষম্যের জগদ্দল পাথর সৃষ্টি করে যাচ্ছে তাদের মূলোৎপাটন তো দূরের কথা, উল্টো তাদেরকে বীরের আখ্যা দেয়া হয়। প্রকৃতির বিধানের সাথে এ যেন এক নির্মম পরিহাস।
The Daily surjodoy
বৈষম্য সহ্য করা কোন মানুষেরই উচিত নয়। অত্যাচারিতদের বাহ্যত দুর্বল মনে হলেও কার্যত এরাই শক্তিশালী। কেননা এদের যে কেবল সংখ্যাধিক্যের শক্তি রয়েছে তা-ই নয়, এদের রয়েছে সততার অপরাজেয় শক্তি। অত্যাচারিতদের অপরিমেয় সেই শক্তির উদ্বোধন কামনা করেছেন নজরুল। এই বিপুল জনগোষ্ঠীকে তিনি শত শতাব্দীর ঘুম ভেঙে সামনে যাবার স্বপ্ন-সাহস দেখিয়েছেন, অধিকার-হারা মানবগোষ্ঠীকে অধিকার আদায়ের সংগ্রামে আত্মবিশ্বাস যুগিয়েছেন, তাদের শিখিয়েছেন দৃপ্ত উচ্চারণ-
The Daily surjodoy
"তোমার দেওয়া এ বিপুল পৃথ্বী সকলে করিব ভোগ,
এই পৃথিবীর নাড়ী সাথে আছে সৃজন-দিনের যোগ।"
অসাম্যের প্রতিবিধান অবশ্যই হবে। কারণ ‘সাম্য’ সত্য। আর অসাম্য হ’ল দৈত্যরূপী মিথ্যা। দৈত্যের হাত থেকে সত্যকে মুক্ত করে সুন্দর পৃথিবী প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নজরুলকে আমরা পাই আপোসহীন হিসেবে, একজন নিরন্তর সাধক হিসেবে। তাঁর এ সাধনাকে দেখেছেন ‘সুন্দরের সাধনা’ হিসেবে।
The Daily surjodoy
মানবসৃষ্ট অসাম্যের সকল প্রাচীর ভেঙে নজরুল সাম্যের গান শুনিয়েছেন। মানব-সাগরে তিনি সকলকে সমান দৃষ্টিতে দেখেছেন এবং সাম্যের বার্তা সকলের মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন।
সাম্যের এমন সাবলিল আহ্বান কেবল বাংলা সাহিত্যেই নয়; বরং বিশ্ব সাহিত্যেও আর কোন কবির কাব্যে আমরা পাইনি। তিনি মানুষকে দেখেছেন সৃষ্টির শ্রেষ্ঠতম নিদর্শন হিসেবে। মানুষের মধ্যে তিনি পারস্পরিক আত্মার সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছেন। ফলে তাঁর কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে সাম্যের সুললিত বাণী-
"গাহি সাম্যের গান।"
The Daily surjodoy
মানুষ এমন জীব যার মাঝে স্বয়ং স্রষ্টার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। আর এখানেই মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের মাজেজা। কিন্তু মানুষ যখন আপন স্রষ্টাকে আপনার মাঝে না খুঁজে অন্যত্র খুঁজে বেড়ায়, তখন একদিকে যেমন স্রষ্টার সাথে তার সহজাত সম্পর্কে ছেদ ঘটে, ঠিক তেমনি বিব্রত বোধ করেন স্বয়ং স্রষ্টা, অপদস্থ হয় গোটা মানব-সত্তা। তাই স্রষ্টাকে খুঁজতে হবে নিজের মধ্যে। তাতে স্রষ্টা এবং সৃষ্টি উভয়ের মাঝে সহজাত সম্পর্কটি অটুট থাকবে এবং মানুষ তার মর্যাদার জায়গাটি ধরে রাতে সক্ষম হবে।
The Daily surjodoy
নজরুল প্রতিটি মানুষের মাঝেই স্রষ্টাকে প্রত্যক্ষ করেন। মানব-হৃদয় হ’ল স্রষ্টাকে পাবার তীর্থস্থান। ‘এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোন মন্দির কাবা নাই’ কিংবা ‘কারো মনে তুমি দিও না আঘাত,সে আঘাত লাগে কাবার ঘরে, মানুষেরে তুমি যত কর ঘৃণা, খোদা যান তত দূরে সরে সাম্যের এসব অমোঘ বাণী যাঁর কাব্য-কাননে জোরে-শোরে বিঘোষিত হয়েছে, তিনি আমাদের নজরুল, সাম্যের সার্থক রূপকার এক অনন্য মহাপুরুষ।
The Daily surjodoy
নজরুল এমন সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার স্বপ্ন দেখেছেন যেখানে রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরু করে সকলে মিলে ন্যায় ও সাম্যের শুভ্র ঠিকানা প্রতিষ্ঠা করবে, যেখানে মানুষের মাঝে পারস্পরিক কোন ভেদাভেদ থাকবে না। এমনকি পাপী-তাপী, চোর-ডাকাতদেরও মানুষের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার সার্বিক প্রয়াস চালানো হবে পরম মমতায়।
The Daily surjodoy
নজরুল সাহিত্যে সাম্যের যে অমিয়ধারা প্রবাহিত হয়েছে তার উৎসমূল কোথায়? এ প্রশ্নের উত্তরে বোধ হয় এ কথা বলাই যথেষ্ট যে, তাঁর সৃষ্টি কোন বিলাসিতা ছিল না; বরং জীবনের অভিজ্ঞতা-সঞ্চিত। ড. সুশীলকুমার গুপ্ত লিখেছেন নজরুল কাব্যের এই বিদ্রোহাত্মক ভাবই পরবর্তী বাঙলা সাহিত্যে সাম্যবাদী ধারণা প্রচারে নজরুলের অবদান অবশ্য স্বীকার্য। বহু শিরোনামায় বিভক্ত ‘সাম্যবাদী’ কবিতায় নজরুল সাম্যবাদের প্রতি যে বিশ্বাস ও আন্তরিকতা দেখিয়েছেন, তার তুলনা বাঙলা সাহিত্যে প্রায় নেই বললেই চলে।’
The Daily surjodoy
নজরুল তাঁর জীবনের উষালগ্নেই রুটির দোকানে কাজ করে শ্রমজীবীদের দুর্দশা প্রত্যক্ষ করেছেন, যৌবনে যুদ্ধের ময়দানে মানবতার বিপর্যয় অবলোকন করেছেন, জীবনের নানাবিধ ঘাত-প্রতিঘাতে ধনী-দরিদ্রের প্রকট বৈষম্য, হিন্দু মুসলিম দ্বন্দ্ব-সংঘাত, মানুষে মানুষে হানাহানি, লোভাতুরের নির্মম থাবা ইত্যাদি দেখেছেন, হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেছেন এবং তাঁর জীবনের সর্বশক্তি দিয়ে এ সকল অনাচার-অবিচারের মূলোৎপাটনের চেষ্টা করেছেন, সৃষ্টি করে গেছেন অনবদ্য সব সাহিত্য; বাংলা সাহিত্যকে দিয়ে গেছেন অহংকারের একটি জায়গা যা নিয়ে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো যায়।
প্রতিষ্ঠাতা : মেজর (অব) মোঃ মোদাচ্ছের হোসাইন, সম্পাদক মন্ডলির সভাপতি: বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুজ্জামান আহমেদ এমপি, ব্যবস্থাপনা সম্পাদক: তৌহিদ আহমেদে রেজা, বার্তা সম্পাদক: আসমা আহমেদ কর্তৃক ৫৪ কামাল আতাতুর্ক এভিনিউ সৈয়দ ভবন, ঢাকা-১২১৩ থেকে সম্পাদিত ও প্রকাশিত
© All rights reserved 2020 Daily Surjodoy