জল, পাহাড়, পাথর আর সবুজেঘেরা অঞ্চল সিলেট। প্রকৃতির অকৃপণ সৌন্দর্য এখানকার সম্পদ। থরে থরে সাজানো অপূর্ব সব দৃশ্য দেখতে দেশ-বিদেশের অগুনতি মানুষ ছুটে আসেন এখানে। সিলেটের অর্থনীতিতে তাই পর্যটন অন্যতম বড় নিয়ামক।
সেই পর্যটন এখন ধুঁকছে। করোনাভাইরাস নামক মহামারির কবলে পড়ে স্থবিরতা ঘিরে ধরেছে এখানকার পর্যটনখাতকে। গেল প্রায় দেড় বছরে সিলেটের পর্যটনে ক্ষতির পরিমাণ হাজার কোটি টাকারও বেশি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। ক্ষতির ধাক্কা সামাল দিতে সরকারের সহযোগিতা চান তারা।
পর্যটনের সাথে জড়িত ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে জানা গেছে, বাংলাদেশে করোনার হানা দেয়ার পর গত বছরের মার্চ মাসের শেষ দিকে পর্যটনেও ধাক্কা লাগে। এরপর এই ধাক্কা কেবলই দীর্ঘায়িত হয়েছে। করোনার কারণে একের পর এক লকডাউন, নানা বিধিনিষেধের বেড়াজালে পর্যটনখাত ঝিমিয়ে পড়ে।
সিলেটে পর্যটন কেন্দ্রের মধ্যে রয়েছে বিছনাকান্দি, জাফলং, রাতারগুল, লালাখাল, সাদাপাথর। সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর, তাহিরপুরে টেকেরঘাট নিলাদ্রি, শিমুলবাগানও পর্যটকদের পছন্দের স্থান। এছাড়া মৌলভীবাজারের হাকালুকি হাওর, মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, মাধবপুর লেক, হামহাম জলপ্রপাত, মণিপুরি পাড়া, শ্রীমঙ্গল চা বাগান, হবিগঞ্জের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানসহ সিলেটজুড়ে অসংখ্য পর্যটনকেন্দ্র রয়েছে।
স্বাভাবিক সময়ে এসব কেন্দ্রে পর্যটকদের ঢল লেগেই থাকে। কিন্তু গেল প্রায় দেড় বছর ধরে পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে খা খা অবস্থা বিরাজ করছে। এই দেড় বছরে মাঝে মাঝে লকডাউন না থাকলেও পর্যটনকেন্দ্রে ঘুরাঘুরিতে সিংহভাগ সময়ই নিষেধাজ্ঞা ছিল।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সিলেটে পর্যটনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত হোটেল, মোটেল, রেস্ট হাউজ, রেস্টুরেন্ট, পরিবহন ও পর্যটন কেন্দ্রগুলো ঘিরে গড়ে ওঠা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো। করোনাকালে এসবে দেখা দিয়েছে সংকট। স্বাভাবিক সময়ে পর্যটকে ভরপুর থাকা সব হোটেল ও রেস্ট হাউজ গেল দেড় বছরে সিংহভাগ সময়ই ছিল খালি। পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে যারা নৌকা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন বা বিভিন্ন পণ্যের পসরা সাজিয়ে যারা বসে থাকেন, তাদেরকেও সংকটময় সময় পার করতে হয়েছে।
সিলেট চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রি সূত্র সিলেটভিউকে জানিয়েছে, লকডাউন থাকলে বা পর্যটনকেন্দ্রে যাতায়াতে নিষেধাজ্ঞা থাকলে প্রতিদিন সিলেট বিভাগের পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে কতো টাকার ক্ষতি হয়, এ বিষয়ে গেল বছর একটি নিরীক্ষা হয়েছে। সিলেট চেম্বার এবং সিলেট মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রি মিলে এ নিরীক্ষা করে। সেখানে দেখা যায়, একদিন লকডাউন বা পর্যটনকেন্দ্র বন্ধ থাকলে সিলেটের পর্যটনখাতে প্রায় ৩ কোটি টাকার ক্ষতি হয়।
এ হিসেবে গেল দেড় বছরে সিলেটের পর্যটনখাতে হাজার কোটি টাকারও বেশি ক্ষতি হয়েছে।
দীর্ঘ লকডাউন শেষে গত পরশু, বৃহস্পতিবার থেকে সকল পর্যটনকেন্দ্র খুলে দিয়েছে সরকার। স্বাস্থ্যবিধি মেনে পর্যটকরা ঘুরতে পারবেন। তবে খোলার দিনে সিলেটের পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে খুব বেশি ভিড় দেখা যায়নি। হোটেল, মোটেলগুলোতেও এখনো বাইরে থেকে আসা পর্যটকদের চাপ বাড়েনি। কাল শুক্রবার ছুটির দিন হওয়ায় কিছু কিছু কেন্দ্রে পর্যটকদের আনাগোনা থাকলেও তা আশাব্যঞ্জক নয় বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
তবে সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন, করোনা পরিস্থিতি যদি আর খারাপের দিকে না যায়, পরিস্থিতির যদি উন্নতি ঘটে এবং লকডাউন না থাকে, তবে ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াবে সিলেটের পর্যটনখাত। বিশেষ করে আসছে শীত মৌসুমের দিকে চেয়ে আছেন এ খাত সংশ্লিষ্টরা। এ মৌসুমেই সবচেয়ে বেশি পর্যটকের আনাগোনা থাকে।
জানতে চাইলে সিলেট হোটেল অ্যান্ড গেস্ট হাউজ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমাত নূরী চৌধুরী জুয়েল বলেন, পর্যটনখাতে যে ক্ষতি হয়েছে, তা পূরণ হওয়ার নয়। আমরা দুই চেম্বার মিলে অ্যাসেসমেন্ট করে দেখেছি, প্রতিদিন লকডাউনে পর্যটনখাতে ৩ কোটি টাকার ক্ষতি হয়।
তিনি বলেন, পর্যটনের নিষেধাজ্ঞা মাত্রই শেষ হয়েছে। এখনই পরিস্থিতি বোঝা যাবে না। ডিসেম্বর (শীত মৌসুম) নাগাদ এ খাতের পরিস্থিতি বোঝা যাবে। তখন যদি পরিস্থিতি খারাপ হয়, তবে সংকট আরও ঘনীভূত হবে।
সিলেট চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সহসভাপতি তাহমিন আহমদ বলেন, ‘পর্যটনখাতে ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করা অসম্ভব। কারণ, এ খাতের সাথে অনেকগুলো ছোট ছোট খাত জড়িত। হোটেল, মোটেল, রেস্টুরেন্ট তো আছেনই, পানের দোকানদার, নৌকার মাঝি, গাড়ির চালকরাও এ খাতের সাথে জড়িয়ে আছেন। এর মধ্যে স্থবিরতা যদি দীর্ঘ সময়ের জন্য হয়, তখন ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ আরও কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।’
নগরীর হোটেল নির্ভানা ইনের এই ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ‘গেল দেড় বছরের মধ্যে আমরা মাত্র পাঁচ-ছয় মাস সময় পেয়েছি। বাকি সময় বিধিনিষেধে সব বন্ধ রাখতে হয়েছে, বাইরে থেকে মানুষও আসতে পারেনি। সবদিক বিবেচনায় এ সময়ে হাজার কোটির টাকারও বেশি ক্ষতি হয়েছে পর্যটন খাতে।’
জানা গেছে, ক্ষতি কাটিয়ে ওঠতে সহযোগিতা চেয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরের সাথে চিঠি চালাচালি করছেন সিলেটের ব্যবসায়ীরা। প্রণোদনা দেয়ার কথা বলা হয়েছে, ভ্যাট ও ট্যাক্স মওকুফের দাবি জানানো হয়েছে চেম্বারের পক্ষ থেকে। কিন্তু এক্ষেত্রে কোনো অগ্রগতি হয়নি।
ব্যবসায়ী নেতা তাহমিন আহমদ বলেন, ‘পর্যটনখাতের সাথে সংশ্লিষ্টরা এখন সংকটে। আমরা প্রণোদনার জন্য সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে চিঠি চালাচালি করেছি। কিন্তু সেটা হয়নি। আমরা এও বলেছি, প্রণোদনা না দিলে অন্তত এক বছরের জন্য এ খাতের ভ্যাট ও ট্যাক্স মওকুফ করা হোক। তাতে আমরা ক্ষতি কিছুট কাটিয়ে ওঠতে পারবো। এ বিষয়টিরও অগ্রগতি নেই।’