সিলেটে প্রতিনিয়ত চোখের সামনে কৃষকের একমাত্র সম্বল আবাদি জমি নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে। আর তা চেয়ে চেয়ে দেখতে হচ্ছে অসহায় কৃষককে। শুধু ফসলি জমিই নয়, সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর ভাঙনে শত শত বাড়িঘর, মসজিদ, বিদ্যালয়, হাটবাজারসহ বিস্তীর্ণ জনপদ হারিয়ে যাচ্ছে।
অথচ দেখার কেউ যেন নেই। ২০১৯ সালে এ জনপদকে রক্ষার ব্যাপারে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে ডিও লেটার দিয়েছিলেন প্রয়াত সংসদ সদস্য মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী। মন্ত্রণালয় আট সদস্যবিশিষ্ট একটি উচ্চপর্যায়ের কারিগরি কমিটি গঠন করে।
প্রতিবেদনে ‘কুশিয়ারা ও সুরমা নদীর উভয় তীরে বেড়িবাঁধ পুনর্বাসন ও তীর সংরক্ষণ’ ও ‘সিলেট জেলার জকিগঞ্জ উপজেলাধীন সীমান্ত নদীতীর সংরক্ষণ ও উন্নয়ন’ শীর্ষক দুটি প্রকল্প গ্রহণের সুপারিশ করে কমিটি। কিন্তু দীর্ঘ ১৮ মাস অতিবাহিত হলেও জনগুরুত্বপূর্ণ এই প্রকল্প প্রণয়নে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই।
এই সময়ের মধ্যে ভয়াবহ নদীভাঙনের কবলে পড়ে ঘরবাড়ি হারিয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে শত শত পরিবার।
ভুক্তভোগীরা বলেছেন, প্রতি বছরই সরকারি কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধিরা আসেন। নানা আশ্বাস দিয়ে যান। তবে স্থায়ী কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। যা হয় তা হলো, জোড়াতালি দিয়ে কোনোরকম কাজ শেষ করেন ঠিকাদাররা।
তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নদীভাঙন রোধে কার্যকর পদক্ষেপ চলমান। সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর ভাঙন রোধে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকার দুটি প্রকল্প প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দেওয়া কারিগরি প্রতিবেদনটি যুগান্তর প্রতিবেদকের হাতে এসেছে।
জানা যায়, কুশিয়ারা ও সুরমা নদীর উজানের অংশ ভূ-প্রাকৃতিকভাবেই অত্যন্ত সর্পিলাকার হওয়ায় সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন পরিমাণের প্রবাহ নদীর গতিপথের উত্তল অংশে বাধাগ্রস্ত হয়। এতে এক দিকে ভাঙন সৃষ্টি, আরেক দিকে পলি জমে চর সৃষ্টি হয়। সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার,
গোলাপগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ, বালাগঞ্জ ও ওসমানীনগর উপজেলা কুশিয়ারা নদীর উভয় তীরে অবস্থিত এবং কানাইঘাট, বিয়ানীবাজার, জকিগঞ্জ, সিলেট সদর, বিশ্বনাথ উপজেলা সুরমা নদীর উভয় তীরে অবস্থিত। যেখানে কুশিয়ারা ও সুরমা নদীতীর সংলগ্ন কোনো স্থায়ী তীর প্রতিরক্ষা প্রকল্প না থাকায় প্রতিনিয়ত তীরভাঙন প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। এ ছাড়া জেলার কোথাও স্থায়ী বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নেই। যেগুলো আছে, সেগুলোও জরাজীর্ণ।
জানা যায়, কুশিয়ারা ও সুরমা নদীর ভাঙনে স্থাপনা ও কৃষিজমি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। নদীভাঙন প্রতিরোধে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বিশেষজ্ঞ টিম দিয়ে সরেজমিন পরিদর্শন করে সমন্বিত ও টেকসই প্রকল্প প্রণয়নের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ২০১৯ সালের ১৩ মে সিলেট-৫ আসনের
সংসদ সদস্য হাফিজ আহমদ মজুমদার, ২৬ জুন সিলেট-৩ আসনের প্রয়াত সংসদ সদস্য মাহ্মুদ উস সামাদ চৌধুরী পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী বরাবর আধা সরকারি পত্র (ডিও) দেন।
প্রতিমন্ত্রী এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন দাখিলের জন্য পাউবো সিলেটের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলীকে নির্দেশ দেন। তৎকালীন পাউবো ঢাকার ডিজাইন সার্কেল-১’র তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আব্দুল বাছিতকে আহ্বায়ক ও সিলেটের নির্বাহী
প্রকৌশলী মুহাম্মদ শহীদুজ্জামান সরকারকে সদস্য সচিব করে আট সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। নাব্যতা, নৌ চলাচল, মৎস্য খাত, সেচ ও পরিবেশের ওপর কী প্রভাব পড়বে তা বিশ্লেষণ করে কারিগরি প্রতিবেদনের নির্দেশ দেওয়া হয় কমিটিকে।
২০১৯ সালের ২১ সেপ্টেম্বর নদীভাঙন কবলিত এলাকা পরিদর্শন করে কমিটি। এরপর সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তারা প্রতিবেদন দাখিল করেন।
নদীভাঙনের ফলে আর্থ-সামাজিক, জলজ ও বন্যপ্রাণি, পরিবেশসহ সার্বিক বিষয় তুলে ধরে সব ধরনের ক্ষয়ক্ষতির পর্যালোচনাসহ ৩২ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন দাখিল করেন।
প্রতিবেদনে সিলেটের বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ, বালাগঞ্জ, ওসমানীনগর উপজেলায় কুশিয়ারায় ৩৮টি স্থানে প্রায় ২৪ হাজার ২৫০ মিটার নদীতীর প্রতিরক্ষা ও ৪৮ কিলোমিটার বাঁধ পুনর্বাসন কাজ ও কানাইঘাট,
বিয়ানীবাজার, জকিগঞ্জ, সিলেট সদর, বিশ্বনাথ উপজেলায় সুরমা নদীর উভয় তীরে প্রায় ১২০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যে ৫৪টি স্থানে ৩৯ হাজার ৬২০ মিটার তীর প্রতিরক্ষা ও ১৩৪.২৫০ কিলোমিটার বাঁধ পুনর্বাসন কাজ ভাঙন রোধে দ্রুত প্রয়োজন বলে মতামত দেয় তৎকালীন কারিগরি কমিটি।
এ ছাড়া ২০০৫ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত শুধু সুরমার ভাঙনে নদীতীর বিশ্বনাথ থেকে সিলেট সদর উপজেলার দিকে প্রায় ৯০ মিটার স্থানান্তরিত হয়েছে।
প্রতিবেদনের আলোকে ২০২০ সালের অক্টোবর মাসে চার হাজার ৯৯ কোটি টাকা ব্যয় ধরে ‘কুশিয়ারা ও সুরমা নদীর উভয় তীরে বেড়িবাঁধ পুনর্বাসন ও তীর সংরক্ষণ’ শীর্ষক প্রকল্প ও দুই হাজার ২৫১ কোটি টাকা ব্যয় ধরে ‘সিলেট জেলার জকিগঞ্জ উপজেলাধীন সীমান্ত নদীতীর সংরক্ষণ ও উন্নয়ন’ প্রকল্প দাখিল করে পাউবো।
জানা যায়, কিন্তু দীর্ঘ ১০ মাস পর ১২ আগস্ট পাউবোর অতিরিক্ত মহাপরিচালকের (পরিকল্পনা) সভাপতিত্বে প্রকল্প দুটির ডিপিপি যাচাই সভা অনুষ্ঠিত হয়।
সভায় পাউবোর প্রধান প্রকৌশলী (পরিকল্পনা) বলেন, পরিকল্পনা কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৫০ কোটি টাকার অধিক ব্যয়ের প্রকল্পগুলোর প্রয়োজনীয়তা ও সম্ভাব্যতা নির্ধারণ করার নিমিত্তে বিস্তারিত সমীক্ষা করে দাখিল করতে হবে।
পুনরায় প্রকল্প দুটির ডিটেইল ফিজিবিলিটি (সম্ভাব্যতা সমীক্ষা) স্টাডির নির্দেশ দেওয়া হয়। পাউবো সিলেট রোববার প্রকল্প দুটির সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করার জন্য সব নথিপত্র পাঠানো হয় পাউবোর অতিরিক্ত মহাপরিচালকের (পরিকল্পনা) কাছে। পাউবো সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী আসিফ আহমেদ বলেন, সম্ভাব্যতা সমীক্ষায় ছয় মাস থেকে এক বছর লাগতে পারে।
বৃহৎ প্রকল্প বলে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ছাড়া অনুমোদন করবে না বলে সরকার নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ জন্য ডিটেইল ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি করতে হবে। কারিগরি কমিটির রিপোর্ট দিয়ে কাজ হবে না। তিনি বলেন, ফিজিবিলিটি স্ট্যাডির পর ডিপিপি সাবমিট করতে আরও দু-তিন মাস সময় লাগবে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় প্রকল্প অনুমোদন হতে হতে আরও কয়েক হাজার মানুষ সর্বস্বান্ত হয়ে যাবে। তবুও তাদের অবহেলার শেষ হবে না। এরপর সামান্য কিছু কাজ করিয়ে বাকি টাকায় নিজেদের পকেট ভরবেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পাউবোর স্থানীয় একাধিক কর্মকর্তা বলেন, কারিগরি কমিটি যে প্রতিবেদন দিয়েছে এরপর আর কোনো ধরনের স্ট্যাডির প্রয়োজন নেই।
প্রতিবেদনে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। কারিগরি কমিটির প্রতিবেদনের দেওয়া মতামত ও ৬ দফা সুপারিশে বলা হয়-কুশিয়ারা নদীর উভয় তীরে ৩৮টি ভাঙনকবলিত স্থানে স্থায়ী তীর প্রতিরক্ষা কাজ বাস্তবায়নসহ উভয় তীরে বিদ্যমান বাঁধগুলো (বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ) নতুনভাবে ডিজাইন করে পুনর্বাসনের কাজ ও একই সুরমা নদীর উভয় তীরসংলগ্ন ৫৪টি ভাঙনকবলিত স্থানে নতুনভাবে ডিজাইন করে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ পুনর্বাসনের কাজ বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন।
কারিগরি কমিটির প্রতিবেদন যথাযথ কর্তৃপক্ষ অনুমোদন করলে দ্রুততার সঙ্গে প্রস্তাবিত প্রকল্পের ডিপিপি প্রণয়নের ব্যবস্থা গ্রহণ প্রয়োজন। কেননা আগামী বর্ষা মৌসুমের আগেই প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়নের ব্যবস্থা গৃহীত না হলে ভাঙনকবলিত এলাকায় পাউবোর ভাবমূর্তি চরমভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে।