ডেস্ক: হ্যাকিং আতঙ্কে বাড়তি সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে ব্যাংকিং খাতে। এটিএম বুথগুলোতে নিরাপত্তাকর্মীদের পাশাপাশি ব্যাংক কর্মকর্তাদের নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। হ্যাকাররা যাতে ব্যাংকগুলোর আইটি নেটওয়ার্কে ঢুকতে না পারে সে জন্য অতিরিক্ত নিরাপত্তামূলক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সতর্কতামূলক নির্দেশনা জারির পর থেকেই ব্যাংকগুলোর আইটি খাতের নিরাপত্তায় বাড়তি পদক্ষেপ নেয়া হয় বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো: আব্দুল হালিম চৌধুরী সংবাদমাধ্যমকে জানান, ব্যাংকের আইটি সেক্টর অত্যন্ত স্পর্শকাতর খাত। ব্যাংকের আইটি নেটওয়ার্কে ঢুকে হ্যাকাররা ব্যাংক ও গ্রাহকের তথ্য চুরি করতে না পারে সে জন্য আমরা সতর্ক থাকি। প্রতিনিয়তই নিরাপত্তাব্যবস্থা হালনাগাদ করা হয়।
সর্বাধিক এটিএম বুথের মাধ্যমে গ্রাহকদের সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান ডাচ বাংলা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কাশেম মো: শিরিন গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকের সতর্কতামূলক চিঠির বিষয়ে জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চিঠি পাওয়ার সাথে সাথে আমরা আইটি বিভাগ ও এটিএম বুথগুলোতে বাড়তি সতর্কতামূলক নির্দেশনা জারি করেছি।
এটিএম বুথগুলোতে কোনো ব্যক্তি সন্দেহজনক লেনদেন করছে কী না সে বিষয়ে বাড়তি সতর্ক থাকতে নিরাপত্তা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে পরামর্শ দেয়া হয়েছে। আবার বেশির ভাগ বুথে ডাচ বাংলা ব্যাংকের কর্মকর্তা লেনদেনের দায়িত্বে থাকেন। কোনো গ্রাহক একাধিকবার টাকা উত্তোলন করছেন কি না, সেটা করে থাকলে প্রকৃত গ্রাহক কী না সে বিষয়ে খেয়াল করতে ব্যাংক কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কেউ যেন গ্রাহকের টাকা হাতিয়ে নিতে না পারে সে জন্য আইটি বিভাগকেও বাড়তি সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে। হ্যাকাররা যাতে আইটি নেটওয়ার্কে ঢুকতে না পারে সে জন্য বাড়তি নিরাপত্তামূলক পদক্ষেপ নেয়ার পাশাপাশি নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
এর আগে ২০১৬ সালে বড় ধরনের এটিএম কার্ড জালিয়াতি হয় দেশের ব্যাংকিং খাতে। ব্যাংকগুলোর দেয়া ভিডিও ফুটেজ ও লেনদেনের তথ্য বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক দেখতে পায়, জালিয়াতচক্র ওই বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ১২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চারটি ব্যাংকের এটিএম বুথে ডিভাইস ও ভিডিও ক্যামেরা স্থাপন করে ১ হাজার ২০০ কার্ড জালিয়াতি করে। এর মাধ্যমে গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট থেকে ২০ লাখ ৫৯ হাজার টাকা হাতিয়ে নিতে সক্ষম হয় চক্রটি। তবে, কার্ড জালিয়াতি হওয়ার দুই দিনের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক অবহিত হওয়ায় এবং জালিয়াতি প্রতিরোধে দ্রুত ব্যাংকগুলোকে সতর্ক করায় কার্ড জালিয়াতচক্র জালিয়াতি হওয়া কার্ডের ১০ শতাংশও ব্যবহার করতে পারেনি। চক্রটি সময় পেলে হয়তো জালিয়াতির পরিমাণ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারত বলে ওই সময় আশঙ্কা করা হয়। পরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশে ব্যাংকগুলো গ্রাহকের অর্থ ফেরত দিতে বাধ্য হয়েছিল।
স্থানীয় কার্ড জালিয়াতির রেশ কাটতে না কাটতেই ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে প্রিমিয়ার ব্যাংকের আন্তর্জাতিক ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতির ঘটনা ঘটে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে জালিয়াতির তথ্য বেরিয়ে আসে। আন্তর্জাতিক ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতির মাধ্যমে ৩৪ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় জালিয়াতচক্র। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এ ঘটনার আগে আন্তর্জাতিক ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতির ঘটনা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আসেনি। ওই সময় প্রিমিয়ার ব্যাংকের ঘটনায় রীতিমতো বিস্মিত হয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।
ব্যাংকাররা জানান, এটিএম বুথগুলোতেও বাড়তি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ব্যাংকের নিজস্ব কর্মীদের পাশাপাশি সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো থেকেও এ ব্যাপারে নজরদারি করা হচ্ছে। সব মিলে এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। ম্যালওয়্যার সফটওয়্যারটি অকেজো বা ক্লিন করতে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বাণিজ্যিক ব্যাংক, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা কাজ করছে।
সূত্র জানায়, গত সপ্তাহে বাংলাদেশের আর্থিক খাতের অনলাইন সিস্টেমে একটি ম্যালওয়্যার সফটওয়্যার বা ভাইরাসের সন্ধান পায় বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল (বিসিসি)। সাথে সাথে তারা বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে এ ব্যাপারে সতর্ক করে দেয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোও এ ব্যাপারে সতর্ক হয়ে ওঠে। অনলাইন লেনদেন সীমিত করা হয়। একইসাথে আরোপ করা হয় বাড়তি সতর্কতা, যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। অনেক ব্যাংকের এটিএম বুথে নিজস্ব কার্ড ছাড়া অন্য ব্যাংকের কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক কার্ডের লেনদেনেও সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে। আগে এটিএম বুথগুলো সারারাত খোলা থাকত। এখন জনবহুল এলাকায় রাত ১১টা পর্যন্ত এবং গ্রামে রাত ৮টা পর্যন্ত খোলা রাখা হচ্ছে। এরপর বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে এটিএম বুথগুলো।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানান, ম্যালওয়ারের কার্যকারিতার একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ থাকে। এই মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে। তবে এটির মেয়াদ কত দিন আছে সেটি নিয়ে গবেষণা হচ্ছে। এখনই চূড়ান্ত করে কিছু বলা যাচ্ছে না।
সূত্র জানায়, ম্যালওয়্যারের মাধ্যমে সিস্টেম হ্যাক করে বিভিন্ন দেশে তথ্য ও অর্থ চুরির ঘটনা ঘটছে। এগুলো প্রতিরোধে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআইসহ বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সাইবার সিকিউরিটি বিভাগ কাজ করছে। বাংলাদেশেও সাইবার সিকিউরিটি বিভাগের গোয়েন্দারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাথে সমন্বয় করে কাজ করছে।