ডেস্ক: ২০১৩ সালের ডিসেম্বরের ৪ তারিখ সন্ধ্যা ৬টার দিকে টিউশনির কথা বলে ঢাকার নাখালপাড়ার বাসা থেকে বের হন আয়েশা আলীর ছেলে আবদুল কাদের মাসুম।
তিতুমীর কলেজের ফিন্যান্স বিভাগের ছাত্র ছিলেন তিনি। তখন বয়স ছিল ২৪ বছর।
ওইদিন রাতে ছেলে বাড়িতে না ফিরলে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন বসুন্ধরা এলাকা থেকে তার ছেলের সাথে আরও তিন জনকে র্যাবের পোশাক পরা কয়েকজন দুটো মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে গেছে।
তারপর সাত বছর ধরে কারও কোন খোঁজ মেলেনি। একমাত্র ছেলের সন্ধানে এই মা আইনের দরজায় কড়া নাড়লেও সাড়া পাননি কোথাও।
বিবিসি বাংলার কাছে আক্ষেপের স্বরে তিনি বলেন, “আমরা র্যাব অফিস, ডিবি পুলিশ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সবখানে গিয়েছি। থানায় জিডি করেছি। এখনও খোঁজ খবর করে যাচ্ছি, কিন্তু তারা কিছুই করে না। খালি বলে হচ্ছে, হবে। আমার ছেলে কোন অপরাধ করে থাকলে তাকে আইনের মাধ্যমে বিচার করেন। এভাবে তাকে গুম করতে তো পারেন না।”
একইদিন ঢাকার শাহীনবাগ এলাকা থেকেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয় দিয়ে ৭ জনকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়।
তাদের মধ্যে একজন ছিলেন মিনু আক্তারের স্বামী মোহাম্মাদ কাওসার হোসেন।
তিন বছর বয়সী মেয়েকে নিয়ে বরিশালে নিজ গ্রামের বাড়িতে থাকায় স্বামীকে কে বা কারা কোথায় নিয়ে গিয়েছিল কিছুই জানতে পারেননি তিনি।
পরে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান র্যাবের পোশাকে কয়েকজন তাদেরকে গাড়িতে তুলে নিয়ে গেছে।
স্ত্রী মিনু আক্তার পরে ঢাকায় এসে স্বামীর সন্ধানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারে দ্বারে ঘুরলেও তাকে আশাহত হয়েই ফিরে আসতে হয়েছে বার বার।
মিসেস আক্তার বলেন, “আমার মেয়ের বয়স এখন ১০ বছর। ও এখনও আশা করে ওর আব্বু আসবে। জানতে চায় আব্বু কোথায়। আমি কি বলব? আমি তো জানিনা, আসবে নাকি আসবে না। খোঁজ নিতে অসংখ্যবার র্যাব অফিসে গিয়েছি। তারা স্বীকারই করে না। বলে যে ওই দিন তাদের কোন টিম ওখানে ছিল না। পুলিশের কাছে গিয়েছি জিডি করতে। জিডিও করতে রাজী হয়নি।”
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে গত ১৪ বছরে ৬০৪ জন গুম হয়েছেন।
তাদের মধ্যে পরবর্তীতে ৭৮ জনের লাশ উদ্ধার হয়, ৮৯ জনকে গ্রেফতার দেখানো হয় এবং ফেরত আসেন ৫৭ জন। বাকি ৩৮০ জনের খোঁজ আজ পর্যন্ত মেলেনি।
অন্যদিকে এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশনের তথ্যমতে, গত ১০ বছরে বাংলাদেশে ৫৫৯ জন গুমের শিকার হয়েছেন।
এই নিখোঁজদের স্বজন, প্রত্যক্ষদর্শী ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী গুম হওয়া অধিকাংশ ব্যক্তিদের সাদা পোশাকে আসা র্যাব, ডিবি পুলিশ বা গোয়েন্দা বিভাগের পরিচয়ে এসে তুলে নিয়ে যেতে দেখা গেছে।
এ নিয়ে মামলা হলেও নিখোঁজদের সন্ধানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী শুরু থেকে উদাসীন ভূমিকায় ছিল বলে অভিযোগ করেছেন মানবাধিকার কর্মী নিনা গোস্বামী।
একে ন্যায় বিচারের চরম লঙ্ঘন বলে তিনি উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, “গুম হওয়া প্রত্যেকের খুঁজে বের করার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এবং তাদের যথেষ্ট সক্ষমতা আছে সবাইকে খুঁজে বের করার। এখন হয় তারা সক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহার করেনি। না হলে তারা সব তথ্য জানে, কিন্তু বলতে চায় না। কেউ অপরাধী হলে তার বিচার করুক। গুম তো করতে পারে না।”
বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে গুমের ঘটনা বরাবর অস্বীকার করা হলেও দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংগঠন এবং জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিটি বারবার উদ্বেগ জানিয়েছে।
গুমের শিকার হওয়া এই ব্যক্তিদের মধ্যে রাজনৈতিক নেতাকর্মী যেমন আছেন তেমনি আছেন সাধারণ মানুষ।
আবার যাদের খোঁজ পাওয়া গেছে তাদেরকে কারা এবং কেন ধরে নিয়ে গেছেন, তারা এতদিন কোথায় ছিলেন সেই রহস্য ভেদ হয়নি।
যেসব বাহিনীর বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ এসেছে তাদের সাথে বার বার যোগাযোগ করেও কোন সাড়া মেলেনি।
তবে গুম হওয়া বিষয়ে যেসব অভিযোগ ও পরিসংখ্যান আসছে সেগুলোর সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি শামসুল হক।
“যে সমস্ত তথ্য আছে সব যে পুরোপুরি সত্য তা নয়। কোনটা সত্য কোনটা মিথ্যা এটার জন্যও তদন্ত হওয়া দরকার, কারণ খুঁজে বের করা যাচ্ছে না, এটার সম্পূর্ণ সত্য নয়। যদি এ ধরণের ঘটনার কোন সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকে, সে বিষয়ে তদন্ত করা হবে। আসলে সত্য মিথ্যা সব বিষয়ই গুরুত্ব দিয়ে তদারকি করা হচ্ছে।”
এর আগে আইন ও সালিশ কেন্দ্র নিখোঁজ ব্যক্তিদের খুঁজে বের করা, প্রতিটি গুমের অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্ত নিশ্চিতে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ কমিশন গঠন, দায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া এবং গুমের শিকার ব্যক্তি ও তার পরিবারের যথাযথ পুনর্বাসন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানায়।
গুম প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর করতেও সরকারের প্রতি দাবি জানায় সংস্থাটি।
সৌজন্যে: বিবিসি বাংলা