ডেস্ক: তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইয়েপ এরদোয়ান আগামী বছরের গোড়ার দিকে ঢাকা সফর করবেন বলে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। এর আগে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে ঢাকা সফরের আমন্ত্রণ জানান। যুদ্ধাপরাধের বিচারকে কেন্দ্র করে ২০১২ সালের পর আঙ্কারা-ঢাকা সম্পর্ক হঠাৎ করেই শীতল হয়ে পড়েছিল। কিন্তু সম্পর্ক সম্প্রতি উষ্ণ হয়েছে। নতুন ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এর গুরুত্ব কী? বিশ্লেষণ করেছেন বিবিসি বাংলার আকবর হোসেন।
মাত্র চার বছর আগের কথা, যখন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইয়েপ এরদোয়ান শেখ হাসিনার সরকারের উপর ভীষণ অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন।
যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামীর নেতা মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসি কার্যকর করার পর তুরস্কের প্রেসিডেন্ট মি. এরদোয়ান এতোটাই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন যে তিনি ঢাকায় নিযুক্ত তুরস্কের রাষ্ট্রদূতকে ফিরিয়ে নিয়েছিলেন।
দু’হাজার ষোল সাল পর্যন্ত পরিস্থিতি এমনই ছিল। কিন্তু চার বছরের মাথায় এসে তুরস্ক এবং বাংলাদেশের মধ্যকার সম্পর্ক এখন নতুন মোড় নিচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে।
মাত্র কয়েকদিন আগেই তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারায় বাংলাদেশ দূতাবাস ভবন উদ্বোধন করা হয়।
সেই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অনলাইনে অংশ নিয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এবং তখন তিনি তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান।
এরপর তুরস্ক সফররত বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন দেখা করেন তুরস্কের প্রেসিডেন্টের সাথে।
আর এখন জানানো হলো, আগামী বছরের শুরুতে ঢাকায় অনুষ্ঠেয় ডি-৮ সম্মেলনে যোগ দিতে মি. এরদোয়ান ঢাকা আসবেন।
যুদ্ধাপরাধের বিচার ও তুরস্কের ক্ষোভ
বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচারকে কেন্দ্র করে ২০১২ সালে থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত তুরস্কের সাথে সম্পর্কে এক ধরণের অচলাবস্থা তৈরি হয়েছিল।
যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের ক্ষমা প্রদর্শন করতে ২০১২ সালে বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের কাছে চিঠি দিয়েছিলেন তুরস্কের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ গুল।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির কাছে লেখা ওই চিঠিতে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট লিখেছিলেন, জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের ফাঁসি হলে বাংলাদেশের উপর এর একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
যুদ্ধাপরাধের বিচার পর্যবেক্ষণ করতে তুরস্কের একটি ইসলামপন্থী এনজিও’র ১৪ সদস্যের দল ঢাকায় এসেছিল ২০১২ সালে ডিসেম্বরে। পরিচয় গোপন করার অভিযোগে তখন তাদের আটক করে তুরস্কে ফেরত পাঠায় বাংলাদেশ সরকার।
তুরস্কের থিঙ্ক ট্যাঙ্ক সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক রিসার্চ-এর উপদেষ্টা সেলচুক কোলাগ্লু ২০১৯ সালে মিডল-ইস্ট ইন্সটিটিউটে প্রকাশিত এক নিবন্ধে লিখেছেন যে দেশটির ক্ষমতাসীন জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি ২০১১ সালে ইসলাম-ভিত্তিক রাজনীতির মতাদর্শ গ্রহণ করেছিলো।
এরই অংশ হিসেবে তুরস্কের ক্ষমতাসীন দলটি মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুডকে যেমন সমর্থন দিয়েছিল, তেমনি বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামীর প্রতিও তাদের সমর্থন ছিল বলে মনে করেন মি. কোলাগ্লু।
তুরস্ক-বাংলাদেশ সম্পর্কে নাটকীয় মোড়
দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কে বেশ নাটকীয় উন্নতি ঘটে ২০১৬ সালের জুলাই মাসে তুরস্কে একটি সেনা অভ্যুত্থানের চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর।
ওই সময় বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কর্মরত থাকা একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বিবিসি বাংলাকে বলেন, ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানের নিন্দা জানিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানকে বার্তা পাঠিয়েছিলেন।
মি. এরদোয়ান তখন রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল সময় পার করছিলেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক ওই কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশ কেন যুদ্ধাপরাধের বিচারের উদ্যোগ নিয়েছে সেটি তুরস্ককে বোঝানো হয়েছে এবং তুরস্ক সেটি অনুধাবনও করতে পেরেছে।
সেই ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানের পর তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান চেয়েছিলেন যত বেশি সম্ভব আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায় করা। আর তাই তিনি বাংলাদেশে আবার রাষ্ট্রদূতকে ফেরত পাঠান।
তুরস্কের সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক রিসার্চ-এর উপদেষ্টা সেলচুক কোলাগ্লু লিখেছেন, ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে ওআইসি সম্মেলনে যোগ দিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ তুরস্কে যান। এর কিছুদিন পরে তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে আসেন।
এর মাধ্যমে দুই দেশের সম্পর্ক আরো জোরদার হয়েছে বলে উল্লেখ করেন সেলচুক কোলাগ্লু।
রোহিঙ্গা সংকট শুরুর পর তুরস্ক দ্রুততার সাথে এগিয়েআসে। রোহিঙ্গা সংকট শুরুর পরপরই মি. এরদোয়ানের স্ত্রী তুরস্কের ফার্স্ট লেডি এমিনি এরদোয়ান রোহিঙ্গা ক্যাম্প দেখতে বাংলাদেশে এসেছিলেন।
রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী এবং বাংলাদেশের পক্ষে জাতিসংঘ ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে তুরস্ক সক্রিয় ভূমিকা রাখা শুরু করে।
এর ফলে তুরস্ক এবং বাংলাদেশের মধ্যকার সম্পর্ক জোরালো হয়েছে বলে উল্লেখ করেন মি. কোলাগ্লু।
সৌদি আরব ও তুরস্ক: বাংলাদেশ কোন দিকে
বেশ কয়েক বছর শীতল সম্পর্ক থাকার পর বাংলাদেশের সাথে তুরস্কের সম্পর্ক এমন এক সময়ে উষ্ণ হয়েছে, যখন মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব নিয়ে সৌদি আরবের সাথে তুরস্কের এক ধরণের ঠাণ্ডা লড়াই চলছে।
বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলো বহু বছর যাবত সৌদি আরবের প্রতি অনুগত থাকলেও রেচেপ তাইয়েপ এরদোয়ান তুরস্কের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকে পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে।
মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরবকে টেক্কা দিতে ইরান, তুরস্ক, কাতার এবং সিরিয়াকে নিয়ে নতুন এক মেরুকরণ তৈরি হয়েছে। আবার এদের মধ্যে ইরান এবং তুরস্কের সাথে চীনের ভালো সম্পর্ক রয়েছে।
অন্যদিকে, দক্ষিণ এশিয়ায় দু’টি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান দীর্ঘদিন ধরে সৌদি আরবের ঘনিষ্ঠ দেশ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি পাকিস্তান ভূ-রাজনীতির এক নতুন পটভূমিতে ইরান এবং তুরস্কের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলছে বলে মনে করা হচ্ছে।
ভূ-রাজনীতির নতুন এই প্রেক্ষাপটে তুরস্কের সাথে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক এই উষ্ণ সম্পর্ক কি কোন বার্তা দিচ্ছে?
আন্তর্জাতিক রাজনীতির পর্যবেক্ষক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তারেক শামসুর রেহমান মনে করেন, তুরস্কের সাথে সম্পর্ক আগের চেয়ে জোরদার হলেও তা এখনো খুব উঁচু মাত্রায় পৌঁছেনি।
“তুরস্কের সাথে খুব উঁচু পর্যায়ের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এটা আমার মনে হয় না। আমার বিবেচনার এটা একটা নরমাল রিলেশনশিপ (সাধারণ সম্পর্ক)। তুরস্কের সাথে বাংলাদেশের খুব আহামরি গোছের সম্পর্ক হবে না।”
অধ্যাপক রেহমান আরও মনে করেন যে সৌদি আরব এবং তুরস্কের মধ্যে যে ঠাণ্ডা লড়াই চলছে সেটি বাংলাদেশকে প্রভাবিত করবে না।
তিনি বলেন, “বাংলাদেশ সৌদি আরবকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয় এবং ভবিষ্যতেও সেটা করবে। মুসলমানদের জন্য অতি পবিত্র দুটো মসজিদ সৌদি আরবে অবস্থিত হওয়ার কারণে এ গুরুত্ব দেয়া হয়।”
সৌদি আরব মনঃক্ষুণ্ণ হয়, এমন কাজ করে বাংলাদেশ কখনোই তুরস্কের দিকে ঝুঁকবে না বলে মত দেন এই বিশ্লেষক।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব শহিদুল হক বিবিসি বাংলাকে বলেন, তুরস্ক এখন তাদের প্রতিবেশীদের ছাড়াও বৈশ্বিক-ভাবে চিন্তা করছে।
তিনি মনে করেন, তুরস্কের সাথে ভালো সম্পর্ক হলেও সৌদি আরবের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।
“আমাদের ইরানের সাথে ভালো সম্পর্ক, তুরস্কের সাথেও ভালো সম্পর্ক, সৌদি আরবের সাথে ভালো সম্পর্ক,” বলেন মি. হক।